ড. এম মনির উদ্দিন: মৌমাছি প্রকৃতির সবচেয়ে পরিশ্রমী এবং অপরিহার্য প্রানীদের মধ্যে একটি যারা বৈশ্বিক ইকো-সিস্টেম ও কৃষি ব্যবস্থায় গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা পালন করে। বিশ্বব্যাপী, শীর্ষস্থানীয় ১১৫টি খাদ্য ফসলের মধ্যে প্রায় ৯০টির পরাগায়ন মৌমাছির মাধ্যমে হয় যা বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদনের ৩৫ শতাংশ অবদান রাখে। পরাগায়ন হলো একটি জৈবিক প্রক্রিয়া যা ফসলের বা গাছের বংশবৃদ্ধি তথা ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন এবং মৌমাছি হলো ফসলের প্রধান পরাগায়নকারী। মৌমাছি যখন ফুল থেকে ফুলে যায়, তখন ফুলের পুরুষ পরাগরেনু ফুলের স্ত্রী স্টিগমাটাতে পরাগায়ন ঘটিয়ে নিষিক্ত করে যার ফলে ফল বা ফসলের বীজ উৎপাদিত হয়। এভাবে, বিশ্বব্যাপী মৌমাছির পরাগায়ন পরিষেবার মুল্য প্রায় ১৫৩ বিলিয়ন ইউরো যা সরাসরি মানুষের খাদ্যের জন্য ব্যবহৃত কৃষি উৎপাদনের মোট অর্থনৈতিক মুল্যের ৯.৫ শতাংশ।
বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপুর্ন খাদ্য ফসলের প্রায় ৭৫ শতাংশ আংশিকভাবে পরাগায়নের উপর নির্ভরশীল এবং মৌমাছির মাধ্যমে পরাগায়িত এই সমস্ত ফসলের ফলন বৃদ্ধি পায় এবং ফসলের গুনগতমান বাড়ায় (ঋঅঙ ধহফ ওচইঊঊঝ, ২০১৬)। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষন এবং ইকো-সিস্টেমের উন্নয়নে মৌমাছির ভুমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন। বন্য উদ্ভিদের প্রজনন, জিনগত বৈচিত্র্য বজায় রাখা এবং জীববৈচিত্র্য বজায় রাখতে মৌমাছি সহায়তা করে। মৌমাছি কেবল কৃষি উৎপাদনশীলতাকেই বাড়ায় না বরং বন্য উদ্ভিদের প্রজনন সক্ষমতা বাড়িয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় রাখে। মৌমাছি ফুলের বৈচিত্র্যতা রক্ষা, খাদ্য শৃংখলকে শক্তিশালী করা, মাটি ও জলের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়ক ভুমিকা পালন করে। জলবায়ু সহনশীল কৃষি, পুষ্টি সংবেদনশীল খাদ্য শৃংখল এবং প্রকৃতি ভিত্তিক সমাধানের প্রেক্ষাপটে, মৌমাছি পালন একটি আন্তঃ কাটিং সমাধান হিসেবে আবির্ভুত হয়। এটি একাধিক টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (ঝউএ) কে সমর্থন করে যার মধ্যে এসডিজি-২ (শুন্য ক্ষুধা), এসডিজি-৮ (শালীন কাজ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি), এসডিজি-১৩ (জলবায়ু পদক্ষেপ) এবং এসডিজি-১৫ (ভুমিতে জীবন) অন্যতম।
বাংলাদেশে আম, লিচু, পেয়ারা, সরিষা, শসা, কুমড়া জাতীয় ফসল, ডাল ফসল, সুর্যমুখী এবং মশলা জাতীয় ফসল মৌমাছির দ্ধারা পরাগায়নের ফলে ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে দেখা যায় যে, ফসলের ক্ষেতের কাছাকাছি মৌমাছির কলোনী স্থাপন করলে ফলন ২০-৬০ শতাংশ বাড়ে, ফলের গঠন উন্নত হয়, আকৃতি ও আকার বৃদ্ধি পায় এবং ফসলের পরিপক্কতার সময় কমে আসে। বিশেষ করে, সরিষা এবং লিচুতে মৌমাছির পরাগায়নের ফলে তেল বা রসের পরিমান উল্লেখযোগ্য পরিমানে বাড়ে। কিন্তু, মারাত্বক ক্ষতিকারক কীটনাশকের ব্যবহার, একক ফসলের চাষাবাদ বৃদ্ধি, মৌমাছির আবাস্থলের ক্ষতি, জলবায়ুর পরিবর্তন বিশেষ করে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারনে মৌমাছির সংখ্যা হ্রাস কেবল ফসল উৎপাদনকেই নয় বরং পরিবেশের সামগ্রিক ভারসাম্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে। বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক গবেষণায় বলা হয়েছে, গত কয়েক বছরে প্রায় ৯০ শতাংশ মৌমাছি এবং অন্যান্য পরাগায়নকারী কমে গেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ইতিমধ্যে সতর্কতা জারি করে বলেছে যে, বিশ্বব্যাপী মৌমাছির সংখ্যা হ্রাস ক্ষুধা ও অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এক বিরাট হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে।
নিওনিকোটিনয়েড এক ধরনের সিস্টেমিক কীটনাশক যা কেবল কীটপতঙ্গ, পোকামাকড়ই নয় বরং মৌমাছিসহ সকল ধরনের উপকারী পোকামাকড় এমনকি মাটির অনুজীবকেও ধ্বংস করে। শত শত গবেষণার ফলাফল থেকে এটাই নির্দেশিত হয় যে, নিকোটিনয়েড বিশ্ব জুড়ে মৌমাছি এবং পরাগরেনু মৃত্যুর প্রধান কারন। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০০ ব্র্যান্ডের বিভিন্ন কীটনাশক রয়েছে যার মধ্যে বিভিন্ন মাত্রায় নিওনিকোটিনয়েড রাসয়নিক রয়েছে যা দেশের মৌমাছি ধ্বংস হওয়ার মুল কারন। বিস্ময়কর বিষয় হলো, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এই জাতীয় কীটনাশকের অনুমোদন দিয়েই চলেছে। ফসলের সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত অ্যাসিটামিপ্রিড, ক্লোথিয়ানিডিন, ডাইনোটেফুরান, ইমিডাক্লোপ্রিড, নাইটেনপাইরাম, থিয়াক্লোপ্রিড, থায়ামেথক্সাম জাতীয় সকল কীটনাশকে নিওনিকোটিনয়েড রয়েছে। এই জাতীয় কীটনাশকের প্রয়োগের ফলে মৌমাছি ও পরাগরেনু মারা যাওয়ায় ফসলের ফলনের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
মৌমাছি পালনকে উৎসাহিত করার জন্য কৃষক ও উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বাড়াতে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ ও সম্প্রসারন পরিষেবা প্রদান করা প্রয়োজন। বিষাক্ত ও অযৌক্তিক কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে মৌমাছি রক্ষার ব্যবস্থা গ্রহন করার জন্য জাতীয় কৃষি ও জীববৈচিত্র্য কৌশলে মৌমাছি পালনকে একীভুত করার জন্য নীতি সহায়তা প্রয়োজন। মৌমাছি পালন কেবল একটি কৃষি সংশ্লিষ্ট কার্যকলাপ নয় বরং পরিবেশগত ভারসাম্য, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং টেকসই উন্নয়নের একটি শক্তিশালী চালিকাশক্তি। কাজেই, মৌমাছির উপকারী ভুমিকা অনুধাবন করে আরও উৎপাদনশীল, জীববৈচিত্র্যময় এবং স্থায়ীত্বশীল খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। যেহেতু, প্রকৃতিতে মৌমাছির সংখ্যা আশংকাজনকভাবে কমে গিয়েছে যার ফলশ্রæতিতে ফসলের পরাগায়ন বাধাগ্রস্থ হয়ে ফসলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এমতাবস্থায়, দেশের সার্বিক ফসল উৎপাদন ব্যবস্থাকে ঠিক রাখার জন্য মৌমাছি পালনের উপর ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহন করা জরুরী। কারন, মৌমাছি একদিকে যেমন ফসলের পরাগায়ন ঘটিয়ে ফসলের উৎপাদনের ধারাকে সমুন্নত রাখতে সহায়তা করবে সেইসাথে এর চাষের মাধ্যমে দেশে উৎপাদিত হবে লক্ষ টন মধু, মোম, পরাগরেনু ও প্রোপোলিন, তৈরী হবে গ্রামীন বেকার যুবক ও মহিলাদের কর্মসংস্থান।
২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট মধু উৎপাদনের পরিমান ১.৮৯ মিলিয়ন টন। পাশ্ববর্তী দেশ ভারত, ২০২২ সালে শুধু আমেরিকায় ৭০ হাজার টন মধু রপ্তানী করেছে যার রপ্তানী মুল্য ৩৫০ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত থেকে ধারনা করা হয় যে, দেশে বাৎসরিক মধু উৎপাদনের পরিমান প্রায় ৪০ হাজার টন যার অধিকাংশ আসে সুন্দরবন এবং মৌমাছি পালন থেকে। দেশে ১২-১৫ হাজার ভ্রাম্যমান মৌমাছি পালনকারী রয়েছে যাদের প্রতিজনের সাথে ৩-৭ জন লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। এই সকল মৌমাছি পালনকারীরা মুলত সরিষা ফুল থেকে বেশী পরিমান মধু সংগ্রহ করে এবং সরিষার পর দেশের বিভিন্ন এলাকায় চাষ হওয়া মশলা জাতীয় ফসলের ফুল এবং আম, লিচু ও অন্যান্য মৌসুমী ফলের ফুল থেকে মধু আহরন করে। এরপর, এপ্রিল-মে মাসে যখন সুন্দরবনে বিভিন্ন বন্য ফুল ফোটে তখন মৌমাছি পালনকারীদের অনেকেই সুন্দরবনের আশেপাশে মৌমাছির মৌচাক নিয়ে যায় মধু সংগ্রহের জন্য। বর্ষাকালে, ৪ মাস দেশে তেমন ফুল জাতীয় ফসল বা গাছ না থাকায় মধু সংগ্রহ করা যায় না।
বাংলাদেশে এখনো যে ফসলের বৈচিত্র্যতা রয়েছে তাতে এই সমস্ত ফসলের সফল পরাগায়ন নিশ্চিত করার মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি সেইসাথে মধরু উৎপাদন বর্তমানের চেয়ে কয়েকগুন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, এক একর সরিষা ক্ষেতে ২০-২৫টি মৌমাছির বাক্স স্থাপন করলে মধু উৎপাদন এবং ফসলের পরাগায়ন উভয়ের জন্যই ভালো। অন্যান্য ফসলের জন্যও একইহারে মৌমাছির বাক্স স্থাপন করা যায়। দেশের ৮৭,২২৩টি গ্রামের প্রতিটি গ্রামে যদি ১০ জন করে মৌমাছি পালনকারী তৈরী করা যায় এবং প্রতিজনের কাছে যদি ২০টি মৌমাছির বাক্স থাকে আর বছরে একটি মৌমাছির বাক্স থেকে যদি ন্যুনতম ২০ কেজি মধু সংগ্রহীত হয় তাহলে দেশে বছরে মধু উৎপাদিত হবে ৩,৪৮,৮৯২ টন এবং পরাগায়নে সহায়ক হওয়ায় ফসলের মান ও ফলন দুটোই বাড়বে।
মাত্রাতিরিক্ত এবং অযৌক্তিক কীটনাশক দেয়ার ফলে বন্য মৌমাছি অনেকটাই হারিয়ে গেছে। মৌমাছি পালনের জন্য অবশ্যই আমাদেরকে তাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরী করতে হবে। ফসলের ফুল ফোটা অবস্থায় কীটনাশক প্রয়োগ না করার ব্যবস্থা করতে হবে বা মৌমাছি বান্ধব কীটনাশক প্রয়োগ করার পদক্ষেপ নিতে হবে অথবা সন্ধ্যায় যখন মৌমাছি জমিতে কম সক্রিয় থাকে তখন কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। সর্বোপরি, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান; কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের এই বিষয়ে বেশি সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন এবং যৌক্তিকভাবে সহনশীল কীটনাশকের অনুমোদন দেয়ার কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন যাতে দেশে নিওনিকোটিনয়েড মুক্ত কীটনাশক আগামীদিনে আর ব্যবহার না হয়। বলাবাহুল্য, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই ভিত্তিক এগ্রিভেঞ্চার-এফজেডই নামক প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বব্যাপী নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য পরিবেশ বান্ধব বিভিন্ন প্রকারের সার, কীটনাশক এবং ছত্রাকনাশক বাজারজাত করছে যা আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানী করে দেশে বাজারজাত করতে পারে। সর্বোপরি, মৌমাছি পালন একদিকে যেমন গ্রামীন বেকার যুবকদের জন্য একটি অন্যতম কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী করে দিবে এবং আগামীদিনে দেশে পর্যাপ্ত মৌমাছি পালনের মাধ্যমে দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষি অধিকতর টেকসই এবং স্থায়ীত্বশীল হবে।
লেখকঃ এগ্রোনমিস্ট এবং কনসালট্যান্ট, গেইন বাংলাদেশ