এগ্রিলাইফ২৪ ডটকম: নতুন বাংলাদেশে জলবায়ু ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় ১৪ দাবি উত্থাপন করেছেন দেশের ২ শতাধিক তরুণ জলবায়ু আন্দোলনকারীরা। জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় তৃণমূল থেকে তরুণদের কণ্ঠস্বরকে জোরদার এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারণীতে তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের মধ্য দিয়ে জলবায়ুর ন্যায়বিচার নিশ্চিতে এসব দাবি উত্থাপন করা হয়।
আজ বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর আলোকি কনভেনশন সেন্টারে একশনএইড বাংলাদেশ এবং ব্রাইটার্স ইয়ুথ সোসাইটির যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত তিনদিন ব্যাপী বাংলাদেশ ইয়ুথ কপ ২০২৪ সম্মেলনের সমাপনী দিনে এসব দাবিসমূহ পেশ করা হয়। গত ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে হাইব্রিড পদ্ধতিতে শুরু হয় এই সম্মেলন। আজ সমাপনী দিনে তরুণ প্রজন্মের দুই শতাধিক প্রতিনিধি এই সম্মেলনে যুক্ত হয়ে নিরাপদ সুপেয় পানি, জলাধার সংকট, খরা এবং বন্যা প্রভাবিত এলাকার দুর্ভোগসহ জলবায়ু সংকট দূর করতে নানান দাবি তুলে ধরেন এবং এ বিষয় সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সাথে মতবিনিময় করেন।
যুব-নেতৃত্বাধীন উদ্যোগ এবং সবুজ অথনীতির উপর জোর দিয়ে জলবায়ু সুবিচার বাস্তবায়নে নবায়নযোগ্য জ্বালানী, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশেষ করে নারী ও কিশোরীদের অগ্রাধিকারসমূহের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয় এই সম্মেলনে।
এর আগে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে প্রান্তিক পর্যায়ের যুবদের মতামত গ্রহণে সাতক্ষীরা, কক্সবাজার, কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জ ও বান্দরবন যুবদের সাথে ধারবাহিক মতবিনিময় করা হয়। এর পাশাপাশি তিনদিন ব্যাপী সম্মেলনের বিভিন্ন অধিবেশনে যুব নেতৃত্বে দুর্যোগ মোকাবেলা, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অর্থায়ন, জলবায়ু ন্যায্যতার নারীবাদী প্রেক্ষিত, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় গণমাধ্যমের ভূমিকা ও জলবায়ু সংশ্লিষ্ট নীতি ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়। এসব অধিবেশনের বিভিন্ন পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা।
বিভিন্ন অধিবেশনের আলোচনায় বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় এবং জলবায়ু ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংবেদনশীল নীতিমালা ও সকল পর্যায় থেকে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। আলোচকরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় যুবদের দক্ষতা উন্নয়ন ও যুব নেতৃত্বে উদ্যোগ গ্রহণে রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগের দাবি জানিয়েছেন এবং একই সাথে এ সকল উদ্যোগ গ্রহণে তহবিল বরাদ্দের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন।
সমাপনী অধিবেশনে একশনএইড বাংলাদেশে-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, “নতুন বাংলাদেশে জলবায়ু সুবিচার প্রতিষ্ঠায় তরুণরা উদ্যোগ গ্রহণ করছে, তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশ ইয়ুথ কপ এর দাবিসমূহ জাতীয় পর্যায়ের পাশাপাশি আগামী আজারবাইজানে অনুষ্ঠিতব্য কপ-২৯ এর নীতি নির্ধারকদের কাছে পৌঁছাতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, ‘বাংলাদেশে ইয়ুথ কপ’ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং জাতীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।”
তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি জান্নাতুল নাঈম বলেন, “বাংলাদেশের একেবারে প্রান্তিক এলাকার মানুষজন বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটের শিকার হচ্ছেন। দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে দেশের প্রান্তিক এলাকার প্রায় ৮ শতাধিক জলবায়ু আন্দোলনকারীদের কষ্টের কথা আমরা শুনেছি গত মাসখানেক ধরে। সেগুলো ১৪টি দাবির মাধ্যমে আমরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী আলোচনায় পৌঁছাতে চাই। আমরা সমাধান চাই। যাতে জলবায়ু সংকটে বিপদাপন্ন এলাকা ও মানুষদের জলবায়ু ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত হয়।”
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, ড. আইনুন নিশাত বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা কোনও বিচ্ছিন্ন সমস্যা নয়। দেশে আইন আছে। প্রত্যেক সমস্যার সমাধান কতটুকু স্থানীয় পর্যায়ে বাস্তবায়নযোগ্য সেটা বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তরুণদের নেতৃত্বে স্থানীয় পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা করতে হবে। একইসাথে জলবায়ু পরিবর্তনের যে মানদণ্ড তা হতে হবে জেন্ডার ও যুব সংবেদনশীল।”
অস্ট্রেলিয়া হাইকমিশনের ভারপ্রাপ্ত হাই-কমিশনার নার্দিয়া সিম্পসন বলেন, “জলবায়ু সংকট নিরসনে ধারাবাহিকভাবে আওয়াজ তুলে যেতে হবে। একইসাথে তরুণদের একতাবদ্ধ হয়ে জলবায়ুর দাবিতে সমবেত হয়ে সবাইকে সচেতন করতে হবে। যারা জলবায়ু সংকটকে স্বীকৃতি দেয় না তাদেরকে বারবার জানাতে হবে পলিসি অ্যাডভোকেসির মাধ্যমে। আরও বড় পর্যায়ে এই প্রচেষ্টা নিয়ে যেতে হবে।”
সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের মাধ্যমে জলবায়ু সংকট নিরসন সম্ভব উল্লেখ করে ড্যানিশ দূতাবাসের ডেপুটি হেড অব মিশন অ্যান্ডার্স বি কার্লসেন বলেন, “জলবায়ু সংকট হচ্ছে বৈশ্বিক ও সার্বজনীন সমস্যা। এই সংকট নিরসনে তরুণদের দাবি শুনতে হবে। জলবায়ু ন্যায্যতা নিশ্চিতে তরুণদের কথাই স্থানীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে তুলে আনতে হবে।”
বাংলাদেশে ফরাসি দূতাবাসের অর্থনৈতিক বিভাগের প্রধান জুলিয়েন ডিউর বলেন, “যখন মানুষ কোন সমস্যা সমাধানের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসে তখন সমস্যার সমাধান বের হয়ে আসে। আমাদের সবাইকে দলবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। জলবায়ু সুবিচারের ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি তরুণ নেতৃত্বকে জায়গা করে দিতে হবে।
সুইডিশ দুতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি নায়োকা মার্টিনেজ বলেন, তরুণরাই আগামীর কাণ্ডারী। নতুন বাংলাদেশে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছেন তারা। তাদের জোরালো আওয়াজের ফলে দেশের সকল পর্যায়ে জবাবদিহিতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। তরুণরাই সবাইকে শেখাতে পারে জলবায়ু সুবিচার কীভাবে নিশ্চিত করা যায়। পারেন কীভাবে সবাইকে একই রেখায় সংযোগ করতে।
সমাপনী অধিবেশনে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জাগো ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা করভি রাখসান্দ, ইউএনডিপি বাংলাদেশের প্রোগ্রাম বিশেষজ্ঞ আরিফ এম ফয়সাল, ব্র্যাকের সিনিয়র জলবায়ু অ্যানালিস্ট মোজাম্মেল হক, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য আরিফুল ইসলাম আদিব ও মনিরা শারমিনসহ প্রমূখ। এছাড়াও বিভিন্ন দূতাবাসের বিশিষ্ট কর্মকর্তা, সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা, একাডেমিয়া ও গণমাধ্যমকর্মীসহ দুই শতাধিক তরুণ জলবায়ু কর্মী উপস্থিত ছিলেন।
জলবায়ু ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় যুবদের দাবিসমূহ:
১. জলবায়ু প্রভাবজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা বিশেষ করে প্রান্তিক নারী ও কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যা মোকাবেলায় স্বাস্থাসেবা কার্যক্রমের পর্যাপ্ততা নিশ্চিতকরণ ও সেবাদানকারীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ। ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করা। দুর্যোগকালীন আশ্রয়কেন্দ্রভিত্তিক ও ভ্রাম্যমাণ স্বাস্থ্যসেবা চালু রাখা।
২. সরকারি সেবার আওতায় সকল নাগরিকদের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা। দুর্যোগকালীন সুপেয় পানি ও খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। উপকূলীয় অঞ্চলে টেকসই বাঁধ নির্মাণ ও পানীয় জলের সমস্যা মোকাবেলায় পুকুর খননসহ অন্যান্য উদ্যোগ গ্রহণ।
৩. প্রান্তিক পর্যায়ে অভিযোজন উদ্যোগকে শক্তিশালী করা এবং যুবদের উদ্যোগে স্থানীয় পর্যায়ে অভিযোজন উদ্যোগ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান।
৪. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় যুবদের সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষা কার্যক্রমে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়সমূহ গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপন করা। জলবায়ু বিবেচনায় শিক্ষা ক্যালেন্ডার পর্যালোচনা করা ও সুপারিশ বাস্তবায়ন।
৫. জলবায়ু পরিবর্তনে বিবেচেনায় যুবদের কর্মসংস্থান ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং এ বিষয়ে গবেষণা ও বিনিয়োগ বাড়ানো। প্রান্তিক কৃষক ও জেলেসহ পারিবারিক, ঐতিহ্যভিত্তিক পেশাজীবীদের দুর্যোগকালীন বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
৬. সবুজ অর্থনীতি ও সার্কুলার অর্থনীতি তৈরিতে যুবদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও সরকারের পক্ষ থেকে নীতি সহায়তা প্রদান করা।
৭. দুর্যোগ মোকাবেলায় সকল পর্যায়ে সবুজ বেষ্টনী তৈরি করা, অবকাঠামো নির্মাণে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্লেষণ করা ও বিবেচনা করা।
৮. পরিবেশের সুরক্ষা ও দূষণ মোকাবেলায় বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ। প্লাস্টিকের ব্যবহার রোধে যথাযথ আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
৯. জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন সমাজিক অভিঘাত যেমন বাল্যবিবাহ, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ইত্যাদির ওপর প্রভাব মোকাবেলায় উদ্যোগ গ্রহণ। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে উদ্যোগ গ্রহণ।
১০. জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবেলায় নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অসাহয়ত্ব মোকাবেলায় সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোকে নারী শিশু ও প্রতিবন্ধী বান্ধব করে তোলা।
১১. জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা অনুযায়ী যুব উদ্যোগে অভিযোজন কার্যক্রম পরিচালনা করতে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা ও বাজেট বরাদ্দ দরকার।
১২. জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নীতিনির্ধারণীতে যুবদের অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি ও তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে উদ্যোগ গ্রহণ।
১৩. অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত পরিবারসমূহের টেকসই পুনর্বাসন নিশ্চিত করা।
১৪. দুর্যোগের সময় বিপদাপন্ন অঞ্চলগুলোতে বিকল্প যোগাযোগ মাধ্যম নিশ্চিতকরণ।