আবুল বাশার মিরাজ: বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) বাংলাদেশের কৃষি ও খাদ্য সয়ংসম্পূর্ণতার এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। ১৯৬১ সালের ১৮ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যাপীঠটি কৃষি শিক্ষা, গবেষণা, এবং সম্প্রসারণে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছে। দেশের কৃষি বিপ্লবের মূলে রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরলস প্রচেষ্টা ও দিকনির্দেশনা। দেশের কৃষিক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে এই প্রতিষ্ঠানটি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।
১৯৬১ সালে যখন বাকৃবি প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন দেশের কৃষি খাতের অবস্থা ছিল অনুন্নত এবং অপ্রতুল। তখনকার পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের কৃষি খাত ছিল মূলত প্রাচীনপন্থী এবং কৃষকরা আধুনিক প্রযুক্তি ও জ্ঞানের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। এমন একটি সময়ে দেশকে খাদ্য সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে, এবং কৃষিক্ষেত্রে উন্নতির জন্য কৃষি শিক্ষা ও গবেষণার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই লক্ষ্যেই ১৮ আগস্ট, ১৯৬১ সালে বাকৃবি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. এম ওসমান গনি প্রথম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
প্রতিষ্ঠার সময়ে বাকৃবি শুধু দুটি অনুষদ নিয়ে তার শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে—ভেটেরিনারি এবং কৃষি অনুষদ। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টির উদ্দেশ্য ছিল আরও বিস্তৃত। কৃষি শিক্ষার পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠানটি কৃষি গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষি শিক্ষা ও গবেষণা দেশের কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিতে বাকৃবি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
বাকৃবির গবেষকরা বিভিন্ন ফসলের উন্নত জাত, সেচ পদ্ধতি, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা, এবং ফসলের রোগবালাই প্রতিরোধে নানা রকম উদ্ভাবনী গবেষণা করেন। এসব গবেষণার ফলস্বরূপ দেশে ধান, গম, সবজি, ফল, এবং অন্যান্য খাদ্যশস্যের উৎপাদনে বিপ্লব ঘটে।
শুধু শিক্ষাই নয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় দেশের কৃষিক্ষেত্রের সম্প্রসারণে অসামান্য অবদান রেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা শুধু গবেষণাগারেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং সেসব গবেষণার ফলাফল দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জনে বিশ্ববিদ্যালয়টি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম পরিচালনা করে।
বাকৃবি থেকে প্রকাশিত কৃষি প্রযুক্তি ও গবেষণার তথ্যাদি স্থানীয় কৃষকদের হাতে পৌঁছানোর মাধ্যমে তাদের কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করা হয়েছে। এতে করে কৃষকরা আধুনিক প্রযুক্তি ও জ্ঞান সম্পর্কে জানার এবং তা প্রয়োগ করার সুযোগ পেয়েছে, যা দেশের কৃষি উৎপাদনের ধারাবাহিক উন্নতিতে সহায়ক হয়েছে।
বাকৃবি প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল দেশের কৃষিকে উন্নত করা এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। এই লক্ষ্য অর্জনে বিশ্ববিদ্যালয়টি বিভিন্ন ধরণের কৃষি গবেষণা ও প্রযুক্তির উদ্ভাবন করে যা কৃষকদের ফসল উৎপাদনের পরিমাণ ও গুণগত মান উভয়ই বৃদ্ধি করতে সহায়ক হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসলের উদ্ভাবন করেছেন, যা বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদনে বিপ্লব ঘটিয়েছে। যেমন, উচ্চ ফলনশীল ধান ও গমের জাতগুলো দেশের খাদ্য শস্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। এছাড়া, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ ক্ষেত্রেও বিশ্ববিদ্যালয়টির অবদান প্রশংসনীয়। বিশেষ করে, পোল্ট্রি ও মাছ উৎপাদনে তাদের গবেষণা দেশের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা মেটাতে সাহায্য করেছে।
বর্তমানে বাকৃবি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কৃষি শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত। বিশ্ববিদ্যালয়টি তার শিক্ষা কার্যক্রমে আরও নতুন নতুন অনুষদ ও বিভাগ যোগ করেছে, যা দেশের কৃষি খাতকে আরও উন্নত করতে সহায়ক হচ্ছে।
বাকৃবির বর্তমান গবেষণাগুলো বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে নানান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। উদাহরণস্বরূপ, জলবায়ু পরিবর্তন, মাটির অবক্ষয়, এবং ক্ষুদ্র চাষীদের সমস্যা সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয়টি বিভিন্ন গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে চলেছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় দেশের কৃষি বিপ্লবের এক আলোকিত পথিকৃৎ। তার নিরলস প্রচেষ্টা ও অবদান দেশের কৃষিক্ষেত্রকে আধুনিক, উন্নত এবং প্রযুক্তি-ভিত্তিক করে তুলেছে। এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষাবিদ, গবেষক ও সম্প্রসারণ কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের কৃষকরা নতুন প্রযুক্তি ও জ্ঞান লাভ করেছেন, যা তাদের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বাকৃবির অবদান অবিস্মরণীয়।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৪ তম প্রতিষ্ঠা দিবসে এই বিদ্যাপীঠের সকল সদস্যকে জানাই শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। দেশের কৃষিক্ষেত্রকে আরও উন্নত ও সমৃদ্ধ করতে বাকৃবি তার মাইলফলক সাফল্য ধরে রাখবে এই আশা ও বিশ্বাস আমাদের সকলের।
লেখক: কৃষিবিদ ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ কৃৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি, ময়মনসিংহ