সমীরণ বিশ্বাস: সূর্যের জ্বলন্ত রশ্মিতে যেন টগবগে আগুন ঝরছে । নিজের উত্তাপ শক্তিমত্তা জানান দিতে বিন্দুমাত্র ছাড় দিচ্ছে না শহর গ্রাম, পথ-ঘাট ,সড়ক-মহাসড়ক সবখানেই সূর্যের খরতা ! পিচঢালা পথ যেন জ্বলন্ত উনন ! জীবিকার তাগিদে ছুটে চলা এ জীবন যেন অষ্টাগত ! গত কয়েক দিন , দেশ জুড়ে মৃদু থেকে- তীব্র তাপ প্রবাহে তেতে উঠেছে প্রাণীকূলও। বাতাসেও আগুনের ছটা । মৌসুমের প্রথম তাপ প্রবাহই চলতি মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে ।
টানা কয়েকদিন ধরেই তাপমাত্রার পারদ চড়াই হয়ে উঠেছে চুয়াডাঙ্গায়। এখন থেকে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড সীমান্তবর্তী এ জেলায়। তাপমাত্রার উত্তাপ ছড়িয়েছে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর উপরে- যাহা অতি তীব্র তাপদেহ ! এরই প্রভাবে কোথাও কোথাও গলে যাচ্ছে রাস্তার পিচ ! দেশের অন্য জেলাগুলিও পুড়ছে খরতাতে । পশ্চিম-দক্ষিণ অঞ্চলে বয়ে যাচ্ছে ৪১ ডিগ্রি তীব্র তাপদাহ । দেশের অন্য জেলাগুলিও পুড়ছে অতি তাপ প্রবাহে। এদিকে প্রচন্ড গরম সহ্য করতে না পেরে অনেকেই অচেতন হয়ে পড়ছেন । দেখা দিচ্ছেন নানাবিধ রোগব্যাধি ও স্বাস্থ্য সমস্যা । তীব্র গরমে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে জনজীবন। প্রয়োজন ছাড়া কেউই বের হচ্ছে না ঘর থেকে। অনেকেই বের হচ্ছেন ছাতা নিয়ে। গরমে সবচেয়ে বেশি দূর্ভোগে পড়েছেন কর্মজীবীরা। আবহাওয়া অফিসের মতে দেশজুড়ে গরমের তীব্রতা আরও বাড়তে পারে ।
আমাদের দেশের ক্ষেত্রে কোনো অঞ্চলের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে সেটাকে মৃদু দাবদাহ বলে ধরা হয়। তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পেরিয়ে গেলে ধরা হয় মাঝারি দাবদাহ। আর তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করলে ধরা হয় তীব্র দাবদাহ চলছে। ঢাকায়, চুয়াডাঙ্গা ও যশোহর সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বর্তমানে তীব্র দাবদাহের চলিতেছে।
আমাদের প্রিয় ঢাকা শহর সহ সারা দেশই আজ শ্যামল সবুজ উন্মুক্ত প্রান্তরের অত্যন্ত অভাব। কিন্তু বিদেশে এমনটি হয় না। সেখানে নগর পরিকল্পনার সময়ে উদ্যান ও প্রান্তরের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা রাখা হয়। সুতরাং মানুষকে বাঁচতে হলে তার আদিম জীবনের প্রতিবেশী গাছ -তরুলতাকেও বাঁচাতে হবে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে তাই বিজ্ঞানীরা রব তুলেছেন, পরিবেশ দূষণ থেকে বাঁচতে হলে গাছ-তরুরাজির শ্যামল ছায়ায় প্রত্যাবর্তন করতে হবে তাই বৃক্ষরোপনের প্রয়োজনীতা আছে।
ঐতিহ্যের শহর ঢাকা । চারশত বছরের পুরাতন ঢাকাকে বলা হয়ে থাকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শিক্ষা-সংস্কৃতি ও বানিজ্যের নগরী। ১৩৪ বর্গ মাইলের এ শহরে বাস করে ১ কোটি ৪১ লক্ষ মানুষ। বর্তমানে জনসংখ্যা আরো অনেক বেশি। ধারণা করা হয় প্রায় ২ কোটির কাঁছাকাছি। প্রতি বর্গ মাইলে ১ লক্ষ ১৫ হাজার মানুষের বসবাস বলা চলে এটি বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ নগরী। বিশ্ব ব্যাংক বলছে ২০৩৫ সাল নাগাদ জনসংখ্যা ৩ কোটি ৫০ লক্ষ হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে খাল, নদী, ডোবা, বৃক্ষ নিধন করে ঘর-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রাস্তা, স্কুল কলেজ সহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে ফলে পরিবেশের উপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। কমে যাচ্ছে সবুজের পরিমাণ।
জাপানের কিয়োটো ও হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন গবেষক ঢাকা শহরের সবুজ নিয়ে গবেষণা করেন, তাদের মতে ১৯৯৫ সালে ঢাকার সবুজ অঞ্চল ছিল ১২ %, ২০১৫ সালে ৮% এবং বর্তমানে ৬-৭% এর বেশি না। ঢাকাতে যত পরিমাণে গাছ কাঁটা হয় তার অল্প পরিমাণই রোপণ করা হয়। বৃক্ষ নিধনের ফলে ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের সর্বত্রই এই একই চিত্র বিরাজমান।
প্রকৃতির এই আগুনঝরা তীব্র তাপদাহ বাড়িয়ে দিয়েছে; দেশজুড়ে বৈধ অবৈধ ইটের ভাটা, শহর ও নগর অঞ্চলে মিল কারখানা, শপিংমল, দোকান মার্কেট, হোটেল মোটেল, বাসা বাড়ি, সর্বক্ষেত্রে এসির ব্যবহার প্রচন্ডভাবে বেড়ে গিয়েছে। তারই সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অপরিকল্পিত বৈধ অবৈধ ব্যাটারি সিএনজি ডিজেল পেট্রোল চালিত গাড়ি রিকশা অটো রিক্সা বিভিন্ন যানবাহন ,যার প্রতিটি কর্মকান্ড তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে কার্যকারী প্রভাব ফেলছে। পাশাপাশি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন রকমের ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহারের ফলেও প্রতিনিয়ত উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। দেশ জুড়ে নদী নালা,খাল বিল ,পুকুর ডোবা, ভরাটের যেন একটি মহৎসব চলছে ! এসব কর্মকাণ্ডই আজকের এই অনাকাঙ্খিত তীব্র তাপ প্রবাহের জন্য দায়ী। আমাদের দৈনিক কৃতকর্ম সংবরণ ছাড়া এই সমস্যার সমাধান করা কষ্টসাধ্য এবং চ্যালেঞ্জিং হবে। শুধুমাত্র বৃক্ষরোপণ করেই এই সার্বিক অবস্থার উন্নয়ন করা কঠিন হবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটগুলো ফসলের উপকারী পোকামাকড়ের অস্তিত্বকেও এখন হুমকির দিকে ঠেলে দিয়েছে। আবার এ সমস্যাকে আরো প্রকট করে তুলেছে কৃষিতে নির্বিচারে রাসায়নিক ও কীটনাশক প্রয়োগ। যার ফলে এই অযাচিত কীটনাশক ফসলের মাটিতে মিশে মাটির কার্বন নিঃস্ফোরণকে বাড়িয়ে তুলছে; যার কারণে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে।
দাবদাহে কৃষিখাতে বিপর্যয়ের শঙ্কা ও করনীয়:
তীব্র তাপদাহে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের কৃষি খাত। দিন দিন দেশব্যাপী তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। ৩৫ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা ধানের জন্য অসহনীয়, দেশে চলছে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ! যা সার্বিক ধান উৎপাদন এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি
বড় অন্তরায় ! এই অতি তাপদাহে ধান ছাড়াও আম,কাঠাল, লিচু ও তুলা সহ অন্যান্য ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। ভুট্টা ও সোয়াবিন উৎপাদনেও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
তীব্র তাপদাহে ফল-ফসলের ব্যবস্থাপনা:
বোরো ধানে হিটশক ( তাপ জনিত ক্ষতি) বা গরম বাতাস (৩৫ ডিগ্রীC +) প্রবাহ হলে ধান চিটা হতে পারে । তাই জমিতে ২-৩ ইঞ্চি পানি, কাইচথোর (Panicle stage of rice) হতে ফুল ফোটা পর্যায় পর্যন্ত ধরে রাখতে হবে। আম, কাঠাল এবং লিচু গাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত (৭ থেকে ১০ দিন অন্তর) সেচ প্রদান করতে হবে। প্রয়োজনে গাছের শাখা-প্রশাখায় পানি স্প্রে করে দিতে হবে। প্রয়োজনে প্লাবন পদ্ধতিতে সেচ দেওয়া যেতে পারে। এতে ফল ঝরে পড়া কমবে এবং ফলন বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া মাটিতে রস ধরে রাখার জন্য সেচের পর গাছের গোড়ায় মালচিং দেয়া যেতে পারে।
তীব্র তাপদাহে সবজি ফসলের ব্যবস্থাপনা:
ফল এবং পাতা জাতীয় সবজির জমিতে আগামী এক সপ্তাহে মাটির ধরন বুঝে প্রয়োজনীয় দুই থেকে তিনটি সেচ ব্যবস্থা করতে হবে । জৈব সারের পানি ধারণ ক্ষমতা বেশি, সেজন্য জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে । ফল এবং সবজির চারা কে তাপ প্রবাহের ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য মালচিং ও সেচ নিশ্চিত করতে হবে। চলমান তাপ প্রবাহের কারণে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি নিরসনে স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিতে হবে।
তীব্র তাপদাহে প্রাণি-সম্পদ ব্যবস্থাপনা:
প্রাণিসম্পদের তাপ প্রবাহ জনিত পীড়ন ( স্ট্রেস) সহনশীল করতে, গবাদি প্রাণী, পোলট্রির ঘর শীতল রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। গবাদি প্রাণীকে দিনে একাধিকবার গোসল করিয়ে দিতে হবে অথবা পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে। গবাদি পশুকে পানির সাথে অতিরিক্ত লবণ, ভিটামিন সি এবং গ্লোকোজ ইত্যাদি মিশিয়ে খেতে দিতে হবে। তাপদাহের এই সময় গবাদি পশুকে ঘরে আবদ্ধ না রেখে গাছের বা প্রাকৃতিক ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে। গবাদি পশুকে এই সময় শুকনো খড় না দিয়ে কচি সবুজ ঘাস খেতে দিতে হবে । অতি তাপদাহে খাবার কমিয়ে দিতে হবে। প্রচন্ড গরমের সময় গবাদি পশুকে কৃমিনাশক, টিকা কিংবা প্রাণীর পরিবহন পরিহার করতে হবে। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি হলে স্থানীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
তীব্র তাপদাহে মৎস্যসম্পদ বাঁচাতে ব্যবস্থাপনা:
তুলনামূলক কম গভীরতার পুকুরে নতুন পানি যোগ করে গভীরতা কমপক্ষে ৫ ফুট করতে হবে যাতে নিচের পানি কিছু ঠান্ডা থাকে এবং মাছ সেখানে থাকতে পারে। পুকরের দক্ষিণ পাড়ে পানির মধ্যে মাঁচা করে লাউ জাতীয় গাছ লাগিয়ে পুকুরে ছাঁয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পুকুরের মোট আয়তনের ১০ শতাংশ জায়গায় চারদিকে বাঁশের ঘেরাও দিয়ে কচুঁরি পানা/ নারকেল গাছের পাতা রাখা যেতে পারে। দিনের বেলায় রোদের সময় অর্থাৎ দুপুর ১২ টা থেকে বিকাল ৩ টা পর্যন্ত গভীর নলকূপ থেকে পানির সরবরাহ করে কমপক্ষে ৫ ফুট বা তার বেশি পানির উচ্চতা বজায় রাখতে হবে ।
সকাল বেলায় শতকে ২০০- ২৫০ গ্রাম লবন বা ১০০ গ্রাম ভেট স্যালাইন গুলে পুকুরে ছিটিয়ে দেওয়া যেতে পারে। রাতের বেলায় এরেটর/ব্লোয়ার/মেশিন (পুকুরের পানিকে ফোয়ারা বা ঘূরনী তেরী করে বাতাসের অক্সিজেনকে পানিতে দ্রুত মিশাতে সহায়তা করে ) চালিয়ে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যাবস্থা করতে হবে অন্যথায় শতকে ১০ গ্রাম হারে অক্সিজেন ট্যাবলেট পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। পুকুরের পানি স্বাভাবিক ঠান্ডা না হওয়া পর্যন্ত পুকুরে খাবার সরবরাহ কমিয়ে দিতে হবে, বা প্রয়োজনে সাময়িক বন্ধ রাখতে হবে। সকালে এবং সন্ধ্যার পর খাবার অল্প করে দিতে হবে। ভিটামিন-সি মিশিয়ে (৭-৮ গ্রাম/কেজি খাদ্যে) খাদ্যের সাথে খাওয়াতে হবে তাপমাত্রা স্বভাবিক না হওয়া পর্যন্ত। এ সময় দিনের বেলায় মাছ/পোনা স্থানান্তর বন্ধ রাখতে হবে বা অত্যান্ত সতর্কতার সাথে করতে হবে। গত কয়েকদিন যাব বাংলাদেশের উপর দিয়ে মারাত্মক দাপদহ বয়ে যাচ্ছে। তাই আসুন আমরা সকলে সতর্ক হই এবং অন্যকে সতর্ক করি ।
-লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।