কৃষিবিদ ড. মো. রওশন জামাল (জুয়েল): ফসলের ক্ষেত, কৃষি, কৃষক জীবন-সভ্যতার এক অপরিহার্য অনুসঙ্গ হওয়া সত্ত্বেও সুশিল সমাজে কৃষি এখনও একটা অবহেলিত পেশা। পেটে-ভাতের সেকেলে কৃষিতে প্রযুক্তির ছোঁয়া দিতে ১৯৬১ সালের ১৮ আগষ্ট প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। তৎকালীন গভর্ণর মোনায়েম খাঁ ময়মনসিংঘের মানুষ হওয়ায় দেশের একমাত্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়টি ময়মনসিংহ শহরের অদুরে এক বিজন প্রান্তরে গড়ে ওঠে।
সুতিয়াখালির নৈঃশব্দ, আধার, আর নিঃসঙ্গতা ভেঙ্গে ডাক দিয়ে যায় নতুন সৃষ্টির, নতুন সম্ভাবনার, হাতছানি দেয় কৃষি উন্নয়নের নতুন দিগন্তের। সামাজিকভাবে অবহেলিত কৃষি, কৃষক ও কৃষি জীবিকায়ন নিয়ে গড়ে ওঠা বাকৃবিকে সুশীলরা আখ্যা দিলো ‘ক্ষেত ভার্সিটি’ বলে। কালের পরিক্রমায় ক্ষেত-খামার, গবাদিপশু, মাছ চাষ নিয়ে গড়ে ওঠা ক্ষেত ভার্সিটি হয়ে উঠলো উন্নয়নের মহাক্ষেত্ররুপে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যে স্বপ্নের বীজ বুনেছিলাম খুব নিরবে - নিকষ আঁধারে সেই স্বপ্নবৃক্ষ আজ মহিরুহ, পত্রপল্লব আর ফুলে-ফলে শোভিত এক ‘গ্লোবাল ক্যানভাস’।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজন গাঁওয়ে কী এক মায়ার টানে প্রতি বছরই ভর্তি হওয়া শুরু করলো দশদিগন্তের এক ঝাঁক দ্বীপশিখা। ব্রিলিয়ান্টদের চোখে-মুখে তখনও বুয়েট-মেডিকেলের স্বপ্ন। কলেজ ডিঙ্গিয়ে ব্রিলিয়ান্টরা যুদ্ধে নেমেছিলো বুয়েট-মেডিক্যালে ভর্তির। কিন্তু রাজাধিরাজের পরিকল্পনা ছিলো ভিন্ন। তিনি এদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ‘গোল্ডেন স্কোয়াডে’ তালিকাভুক্ত করেছিলেন কিছু তুখোড় তরুণ-তরুণীকে। আপাত ব্যর্থ (মেডিকেল-বুয়েটে চান্স পাওয়া) একদল বুনো তরুণ, একদল গেছো তরুনী লোটা-কম্বল আর থালা-বাটি নিয়ে আস্তানা গেড়েছিলো সুতিয়াখালীর ছায়ানীড়ে। বাকৃবি’র উর্বর অথচ নবীন জমিনে শুরু হয়েছিলো এক দ্বিধান্বিত স্বপ্নের চাষাবাদ।
ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে স্বপ্নের আবাদ করতে আসা রবীন্দ্রনাথের ‘রাখাল বালক’, Willium Wordsworth এর ‘সলিটারী রিপার’, আর জসীম উদ্দিনের রুপা-নূপুররা মেধা-মননের সবটুকু ঢেলে দিয়েছিলো ক্লাস-ল্যাবরেটরিতে। সেদিনের রাখাল বালক, মলিন পোশাকের স্বপ্নবীর, গ্রাম থেকে আসা শ্যামা বুবু ব্রহ্মপুত্রের পলল মাটির স্পর্শে হয়ে ওঠে একেকজন কৃষি বিজ্ঞানী, বরেণ্য কৃষি অর্থনীতিবিদ, স্বপ্নদৃষ্টা কৃষি উদ্যোক্তা। ওদের হাতের স্পর্শে ৬৩ বছরের বাকৃবি হয়ে ওঠে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক যাদুর কাঠি।
বাকৃবি’র মৃত্তিকা বিজ্ঞানী, উদ্যান তত্ত্ববিদ, ব্রিডার, প্যাথলজিস্ট, কৃষি প্রকৌশলী, পশুপালন বিশেষজ্ঞ, প্রাণী চিকিৎসক, এ্যাকুয়াকালচারিস্ট ও কৃষি অর্থনীতিবিদ মিলে বদলে দিতে থাকে এদেশের গ্রামীন অর্থনীতি ও জীবিকায়ন। ল্যাবরেটরির অন্ধকার কুঠির আর বিজন ট্রায়াল প্লটে জন্ম নিতে থাকে নতুন নতুন কৃষি প্রযুক্তি। দ্রুত বাড়তে থাকে ফসল, মাছ, দুধ, ডিম আর মাংসের উৎপাদন। ১৩০০ একরের এক টুকরো জমিন এখন বিশ্বের বিষ্ময়। এমন উর্বর হতে পারে কোন জমিন! এমন সুফলা হতে পারে কোন মাঠ! ১৯৬১ সালে যখন সুতিয়াখালির ধান ক্ষেতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নযাত্রা শুরু হয় তখন হয়তো অনেকেই অবাক হয়েছিলো, বিরোধিতাও করেছিলো কেউ কেউ। পল্লী জননীর একেকটি আশার প্রদ্বীপ - একেক জন কৃষিবিদ স্বপ্নের জাল বুনেছে, জীবনের প্ল্যান করেছে বাকৃবি’র সম্ভাবনাময় সবুজ ক্যানভাসে।
বাকৃবি’র যে আধার-দুর্গমতা বিচ্ছিন্ন করেছিলো নগরের কোলাহল থেকে, জীবনের জৌলুস থেকে-সেই আধারেই অংকুরিত হয়েছিলো স্বপ্নের বীজ হাজারো অন্তরে। মনস্বলের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া সম্ভাবনার বারুদগুলোকে ওরা ‘ক্ষেতু’, ‘গেঁও’, ‘রাখাল’, ‘গরুর ডাক্তার’ বলে গালি দিতো। আমরা ছিলাম ‘ক্ষেত ভার্সিটি’র ‘ক্ষেতু’। বন্ধুরা কেউ কেউ বলতো শেষ পর্যন্ত ক্ষেত ভার্সিটিতে ভর্তি হলে। সুতিয়াখালির সেই ‘ক্ষেত ভার্সিটি’ এখন দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়, সেরা গবেষণা কেন্দ্র। সিভিল সার্ভিস থেকে ব্যাংক পাড়া, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রিসার্স ইনস্টিটিউট, বিজনেস সেন্টার থেকে কর্পোরেট জগত, এনজিও থেকে কনসাল্টিং ফার্ম সকল ক্ষেত্রেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সেই সেদিনের স্বপ্নযোদ্ধা ক্ষেতু যাদের কাছে এগ্রি ভার্সিটির অচেনা গলি মনে হয়েছিলো অনিশ্চিত এক গন্তব্য।
ক্ষেত ভার্সিটির ক্ষেতুরা আজ ওয়াশিংটন থেকে সিডনি, লন্ডন থেকে প্যারিস, নাইরোরি থেকে মন্ট্রিল, জেনেভা থেকে দোহা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তার দক্ষতা, ভিশন আর স্বপ্ন নিয়ে। বাংলাদেশে পার্লামেন্ট থেকে সচিবালয়, টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া কী এক দ্বীপ্ত পথ চলা বাকৃবি’র কৃষিবিদদের। ক্ষেত ভার্সিটির ক্ষেতুদের নিবিড় ক্লাস-পরীক্ষা, নিবিড় একাডেমিক পরিবেশ আর শিক্ষকদের নিবিড় উৎসাহ প্রজ্জ্বলিত করে দিয়েছেলো যে মশাল, সেই মশালের আলোতেই আলোকিত বাংলা মায়ের আধার চরাচর।
ইমেজ ক্রাইসিস নিয়ে ভর্তি হওয়া বাকৃবিয়ানরা আজ মর্যাদার মুকুটে সজ্জিত। ‘কৃষিবিদ’ এখন এক সাহসী, স্বপ্নবান পেশাজীবির নাম, একটা ‘প্রফেশনাল ব্র্যান্ড’। ২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইংল্যান্ড এ পিএইচডি করতে গিয়ে দেখি ৩৪ জন বাংলাদেশী পেশাজীবি পিএইচডি করছে। এর মধ্যে ২২ জন কৃষিবিদ যার ১৬ জনই বাকৃবিয়ান ক্ষেতু। অন্যরা টিপ্পনি কাটতো- কৃষিবিদরা নাকি ইজম করে, একাট্টা হয়ে থাকে, দল পাকায়। কেন থাকবে না। এদের অন্তর যে এক সুতোয় বাঁধা সুতিয়াখালির নদীর পাড়ে। এরা যে হৃদয় দিয়ে হৃদয়ের ভাষা বুঝার মন্ত্র জানে। আন্তরের ভালবাসায় অন্তর বাঁধার এক কালজয়ী মন্ত্র শিখেছে বাকৃবির গ্রাজুয়েটরা। গুগল স্কলার, রিসার্স গেট, কিউ এস, টাইম হাইয়ার এডুকেশন সহ কত-শত সফটওয়ার-সিস্টেম এখন বাকৃবির গুণ গায়, ক্ষেতুদের প্রতিভা ও সফলতার স্বীকৃতি দেয়।
ব্রহ্মপুত্রের আবহ, নদীর নির্মল বাতাস ক্ষেতুদের শক্তি-সাহসকে শাণিত করেছিলো আগামির পথ চলায়। বাংলাদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোলঘেসে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র নদ কৃষিবিদদের অস্তিত্বের সারথি, অন্তরের বান্ধব। এই নদীই ছিলো আমাদের বেলা-অবেলার- দুঃখ-সুখের নিত্যসঙ্গী । বুকের ভিতর স্বপ্ন-আশার দ্রুত পল্লবিত হওয়ার দিনগুলিতে এই শান্ত নদীর জলই অদৃশ্য সাহস যুগিয়েছিলো নিশিদিন। এই নদীই প্রতিদিন শুষে নিতো অন্তরের যত কষ্ট-কালিমা, দিতো সতেজ হওয়ার মন্ত্র। ব্রহ্মপুত্রের জলের ব্যঞ্জনা, নিশিরাতে বাসরীর সুর, নৈশব্দ- হাহাকার কৃষিবিদদের এক অর্বাচীন উপাখ্যান, স্বপ্নিল কাব্যগাথা, আর সিনেমাটিক বাংলার বিস্তির্ণ প্রান্তর থেকে আসা তরুণ প্রাণের প্রথম ভালবাসা এই ব্রহ্মপুত্র। দুরন্ত তারুণ্য, অশান্ত যৌবন, উদ্ভ্রান্ত স্বপ্ন-আশার নিরব সাক্ষি এই নদী। বর্ষায় প্রমত্ত ব্রহ্মপুত্র দুকুল ছাপিয়ে অঞ্জলি ভরা স্বপ্ন দিতো। বানের জল আর পলি মাটির ঘ্রানে অশান্ত ক্ষেতুরা বিপ্লবী হয়েছে, সাহসী হয়েছে; এদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছে।
নিরবতা, নিস্তব্ধতায় হৃদয় কাছে আসে, সৃজনশীল হয় অন্তর। সেদিনের ঘর ছড়ার সাহস আমাদের বিশ্ব জয়ের পথ দেখিয়েছিলো। একদিন শীতের সকালে চোখের জলে ঘর ছেলেছিলাম ময়মনসিংহের উদ্যেশ্যে। সেই জল এখনও বারুদ হয়ে জলে ওঠে নতুন কিছু করার, নতুন কিছু ভাবার। বাকৃবির সোনার ছেলেরা টেমস্-রাইন, মুরেডার্লিং-নীলনদের পাড়ে হাটতে হাটতে ব্রহ্মপুত্রের নিবিড় ভালবাসা খুঁজে, ফেলে আসা সময় আর স্বপ্ন খুঁজে। বিনেসুতার অদৃশ্য বন্ধনে কৃষিবিদরা জোট বাধে, মালা গাথে, ছুঁয়ে নেয় প্রানের মুকুল।
বন্ধুরা, আমাদের এখনও যেতে হবে বহুদুর। ক্যাম্ব্রিজ, অক্সফোর্ড, হারভার্ড এর হাজার বছরের ইতিহাস আছে স্বপ্ন বুননের। এ্যালামনাইরা বুকের পাঁজরে মশাল জ্বেলে নিয়ে সেই আলো ছড়িয়ে দিয়েছে সবখানে। বাকৃবি এ্যালামনাইরাও বহন করে চলেছে দ্বীপ্ত মশাল, প্রক্ষেপিত স্বপ্ন। আমরা যদি দুর থেকে একটু একটু করে আলো দিই তাহলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে আর একটি টেক্সাস এ এন্ড এম ইউনিভার্সিটি, আরেকটি মোনাশ অথবা আরেকটি অক্সফোর্ড। টাইম হাইয়ার এডুকেশন বা কিএস র্যাংকিং এ বাকৃবি’র নাম জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকবে।
বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তায়, নেট জিরো আন্দোলনে, প্রোটিন ফিউচার মিশনে, সয়েল জাস্টিস মুভমেন্ট এ বাকৃবি’র মহান বীররা, ক্ষেত ভার্সিটির ক্ষেতুরা নেতৃত্ব দিবে সম্মুখ সমরে। আসুন নিবিড় ভালবাসায় আরেকটিবার ছুয়ে দিই বাকৃবির স্নিগ্ধ ললাট, চুম্বন এঁকে দিই বাকৃবি’র দু’চোখ, চিবুকে। দশদিগন্তে ছড়িয়ে থাকা বাকৃবি’র বীর সন্তানদের হাতের ছোঁয়ায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠুক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণার সেন্টার অব এক্সেলেন্স। আসুন আমরা সেই ক্ষেত ভার্সিটির ক্ষেতুরা মিলে বদলে দিই বিশ্ব চরাচর। জনম জনম বন্ধনে থাকি, ভালবাসায় রাখি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি প্রাণ।
লেখক বাংলাদেশ সরকারের একজন উপসচিব