ড. এএইচ সাদেক: কোন বিষয়ের খন্ডিত বা আংশিক ব্যাখ্যা মানব মনে ভুল বার্তা দেয়। সন্দেহ ও উদ্বেগের ডালপালা বিস্তার করে। সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ঝাপসা ও সন্দেহ নিরসনের বিকল্প হতে পারে না। দেশে বিগত ৫ আগস্ট, ২০২৪ কি ঘটে গেল তা অনেকেই আন্দাজ করতে পারছে না। হুঁশে হোক, জোশে হোক, রক্ত সাগরের বিনিময়ে হোক জাতি এখনো ট্রমাতে আছে। জাতি ও পতিত শাসক উভয়েই ট্রমাটাইজড। কি হলো, কি ঘটে গেল এমন একটা ফিলিংস ভাববোধ জাতির মধ্যে এখনো বিদ্যমান।
জাতিকে স্বাভাবিক অবস্থা আগে ফিরে আসতে হবে। কঠিন পরিস্থিতি ও দীর্ঘ সময়ের কর্তৃত্ববাদী এক স্বৈরশাসনের কবর রচনা কোন সাধারণ কাজ নয়। স্বাধীনতার স্বাদ ও বিজয়ের আনন্দ ভোগ ও ভাগ করার পরিপক্ব সময় এখনো আসেনি। জাতি এখন এক অস্থির সময় পার করছে। স্বাধীনতা ও বিজয় রক্ষা করা বিজয় অর্জনের চেয়ে কঠিন। যেমন কিনা স্বৈরশাসকেরা কেবল মুকুট পরতে জানে কিন্তু তারা মুকুট ছাড়ার পথ জানে না বা চিনে না। চাটুকারবেষ্টিত চরম কর্তৃত্ববাদ ও স্বেচ্ছাচারীদের ধ্বংস ও বিনাশের চাবি কোন বাতিঘরে লুকায়িত থাকে তা তারা আন্দাজ করতে পারে না। বিশ্বের সকল স্বৈরাচারদের রীতিনীতি ও মূলমন্ত্র প্রায় এক ও অভিন্ন। তারা অনেকখানি নেশার ঘোরে চলে। হুঁশ ও জোশের তাললয় ঘাটতি থাকে।
ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়, হঠাৎ কোন ছোট্ট ঝড়ের কবলে পড়ে স্বৈরাচারদের সুরক্ষিত নিরাপদ নিবাস তছনছ হয়ে যায়। অথচ বৃহৎ ইনফ্লুয়েন্সিয়াল প্যারামিটার (আভ্যন্তরীন ও বহিঃশক্তি), প্রচুর রক্তপাত, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, জন-অসন্তোষের প্রতিধ্বনির পারদ চরমে উঠলেও গদির বিনাস হয় না।অথচ ক্ষুদ্র কারণে মসনদের পতন হয়। এটির বাস্তব উদাহরণ বাংলাদেশ।
বিশ্বমঞ্চে ৫ আগস্ট বাংলাদেশের বিপ্লব ও গনঅভ্যুত্থান অধ্যায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও বিশ্বরাজনীতির পাঠচক্রে এক আর্কষনীয় আবেদন নিবেদন থাকবে। এটির প্রয়োজনীয়তা সাউথ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সহসাই ফুরিয়ে যাবে না বরং আবেদন থাকবেই মনে হচ্ছে। এটি একটা থিম গেইম। উত্থান পতন।
খেয়াল করলে দেখা যায় যেই "রাজাকার" স্বাধীনতাবিরোধী চটকদার স্টিগমা শব্দের সুকৌশল ব্যবহারে পতিত অথরিটারিয়ান হাসিনা রেজিমের জয়যাত্রা ও উত্থান - কি লীলা, সেই একই শব্দের (রাজাকার) অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগের মধ্যে পতন নিশ্চিত হলো। বিধির কি খেলা।
বস্তুত যখন কোন সরকার বা প্রশাসন অবজেক্টিভলি দূরাচার হয় ও নৈতিক অবক্ষয়ের বাহক হয় এবং তার চতুঃপার্শ্ব তোষামোদি চাটুকার পরিবেষ্টিত হয় তখন কর্ণকুহরে কেবল কোকিলের গানই শুনতে পায়, শুনতে পায় না জনগণের হাহাকার ধ্বনি ও নির্যাতিত নিষ্পেষিত মজলুলের গোংরানি। এ গোংরানির ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে সমাজের ভেতরেই, জনগণের ভেতরেই তৈরি হয় স্পার্টাগাস, গ্ল্যাডিয়েটর। এই স্পার্টাগাস, গ্ল্যাডিয়েটরা তখন তক্ত মসনদের শেকড়কে তুলার মতো উড়িয়ে দেয় যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাংলাদেশ।
সবকিছু মজবুত, সব ঠিক আছে, উন্নয়নের তাবিজ, তজবিহ বারবার জাতির সামনে সগৌরবে বলার পর এমন অপমানজনক ও অসম্মানজনক পতন কেন হলো ? এ পতনের উত্তর জনগন জানে, পতিত শাসকগোষ্টিও জেনেছিল ও বুজেছিল কিন্তু সমস্যা হলো মানেনি, মানতে চায়নি। ঐ যে আমিত্ববোধ, আমিই সব। এখানেই সব আটকে ছিল যার ফল বড্ড তিতা হলো।
রাষ্ট্রযন্ত্রের সরকার ও দল-এক ও সমান্তরাল নয়। সরকার ও সরকারি দল একাকার বানানো মানে শাসনযন্ত্র, সরকার ও সরকারি দলের ধ্বংস ত্বরান্বিত করা। কারন সবাই তখন সরকার ও সরকারি দল হয়ে যাওয়ার চরম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় আর এর খেসারত পুরো জাতিকে বহন করতে হয়। বিগত ১৬ বছরের ইতিহাস এর জলন্ত প্রমাণ। রাষ্ট্র কাঠামো বলে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
হাসিনা রেজিম রাষ্ট্র কাঠামোর এমন কোন অঙ্গ নেই যেখানে হাত দেয়নি, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায়ের সামাজিক ধাপেও ( সোসাল বন্ডিং) প্রভাব পড়েছে। রাষ্ট্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অর্গান আইন বিভাগ, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ তছনছ করে দেওয়া হয়েছে। শাসনযন্ত্র নিপুন ও সূচারূভাবে চালানোর অন্যতম হাতিয়ার হলো পুলিশ বিভাগ। এটি কেবল দলীয়করণ করা হয় নাই বরং আতংক বাহিনীতে পরিনত করেছিল। অথচ বিশ্বের অন্যান্য দেশের জনগন পুলিশকে তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ও আস্থার প্রতিক মনে করে।
শিক্ষাঙ্গনে চলছে চরম নৈরাজ্য। মানহীন ও সার্টিফিকেট সর্বস্ব শিক্ষা ব্যবস্থা জাতিকে মেধাশূন্য ও হতাশায় গ্রাস করছে। প্রাইমারি থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষা পর্যায় পর্যন্ত চলছে এক বিভৎস ও লেজেগোবরে অবস্থা ও হযবরল চিত্র। কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকগন দিশেহারা। সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকন্ঠায় আতঙ্কিত। অন্যদিকে শিক্ষায় বানিজ্যকরন, অস্বচ্ছ নিয়োগ, চাকুরি বানিজ্যকরন, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য ও নানান অসংগতির কারনে মেধাবীদের দেশ ছাড়ার হিড়িক ব্রেন ড্রেইন (মেধা পাচার) জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে।
অর্থনীতির বেহাল দশা। রাজকোষ ফোকলা। ঋণনির্ভর উচ্চ বিলাসী প্রকল্প বাস্তবায়ন, লুটপাট, নানান অর্থনৈতিক কেলেংকারী ও সর্বোপরি আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলা। এতসব কিছুর সংশোধন ও কার্যকর পদক্ষেপ ও পদ্ধতিগত উন্নয়ন করা রাষ্ট্রের জন্য জরুরি।
পরিবহন সেক্টর তথা যোগাযোগ খাতে চাঁদাবাজি, দূর্নীতি ও অরাজকতা দেশের বিশাল জনগোষ্টির কাঙ্ক্ষিত চাহিদার পরিপন্থী। এ খাত জনতুষ্ঠির অন্যতম প্রধান খাত ও সেবাখাত। উন্নত বিশ্বের জনগন এ খাতটিকে খুব গুরুত্ব দেয় ও মূল্যায়ন করে। এসব খাতে কার্যকরী টেকসই নীতিমালা প্রনয়ণ করে জনগনের ভোগান্তি ও কষ্টলাগবে মনযোগী হওয়া।
ব্যুরোক্রেসি তথা আমলাতন্ত্র ও দূর্বৃত্তায়ন প্রতিরোধে কঠোর অবস্থান, সচ্ছ জবাবদিহিতামূলক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং জন সন্তুষ্টির স্বার্থে টেকসই নীতিমালা প্রনয়ণ করা রাষ্ট্রের জন্য জরুরি।
নাজুক ও অপ্রতুল স্বাস্থ্যসেবা খাতকে প্রকৃত সেবামূলক খাতে পরিনত করা, লুটপাট ও দূর্নীতি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন। পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবায় কাঠামোগত পদ্ধতিগত উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন করে যুগোপযোগী সেবাদান নিশ্চিত করা।
ঘুষ দূর্নীতি বন্ধ, সরকারি প্রকল্পের অর্থের যথেচ্ছ ব্যবহার ও স্বেচ্ছাচারীতা বন্ধ করে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
সর্বোপরি দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বছরে নূন্যতম একটি "জাতীয় ডায়ালগ সেশন বা অধিবশন" ব্যবস্থা করা। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নূন্যতম পারস্পরিক সৌহার্দপূর্ণ ও সদ্ভাব বজায় রাখার স্বার্থে একটি রূপরেখার যা জাতীয় ঐক্য ধরে রাখার প্রয়াস। জাতীয় স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলো এক ও অভিন্ন থাকবে এবং দেশ বিরোধী চক্রান্ত ষড়যন্ত্র ও চুক্তি জনগনকে সাথে নিয়ে মোকাবেলা অর্থাৎ একটি আন্ডারস্ট্যান্ডিং ঘোষণাপত্র রচনা করা।
এ বিবেচনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে একদিকে যেমন রাষ্ট্রযন্ত্র সংস্কার ও মেরামতের জন্য নি:সন্দেহে একটি যৌক্তিক সময় দিতে হবে, তেমনি ছাত্র জনতা ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস সুদৃঢ় করতে একটি স্পষ্ট নির্দেশনা ও ন্যাশনাল রোডম্যাপ ঘোষণা করা। এতে সন্দেহ ও আস্থার সংকট কমে যাবে এবং জাতি একটি বার্তা পাবে যে, এ সরকার সামগ্রিক জনগনের কল্যানে কাজ করছে এবং এ সরকার আমাদের সকলের সরকার।
একটি কল্যাণমূখী ও ভবিষ্যত সম্মৃদ্ধিশালী জাতি গঠনে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার জায়গা অনেক বেশি। এটি জাতি সত্যিকার অর্থে ডিজার্ভ করে। ছাত্র জনতার এ বিপ্লবী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি জঞ্জালমুক্ত ও পদ্ধতিগত টেকসই পরিবর্তনের মাধ্যমে এমন এক বাংলাদেশ উপহার দিবে যা নয়া (নতুন) বাংলাদেশ - নয়া বাতাস নামে বিশ্ব দরবারে পরিচিত হবে, সেই আস্থা ও বিশ্বাস দেশবাসী রাখতে চায়।
-লেখক-ডেপুটি রেজিস্ট্রার বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।