রোটারিয়ান ড. মো. হেমায়েতুল ইসলাম আরিফ: ডিম বাংলাদেশের জন্য সহজলভ্য প্রোটিনের অন্যতম প্রধান উৎস, যা সাধারণ মানুষের খাদ্যতালিকায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রতি ১৬-১৭টি ডিম থেকে প্রায় ১ কিলোগ্রাম উন্নতমানের প্রথম শ্রেণীর প্রোটিন পাওয়া যায়, যার বাজারমূল্য আনুমানিক ২০০-২২৫ টাকা।
অন্যদিকে, একই মানের প্রোটিনের জন্য গরু বা ছাগলের মাংসের মূল্য ৭৫০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এটি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে ডিম হলো একটি সাশ্রয়ী এবং কার্যকর প্রোটিন উৎস, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য। তাই, এটির বাজার সুরক্ষার জন্য সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ডিম আমদানি বাংলাদেশের স্থানীয় পোল্ট্রি শিল্পের জন্য একটি আত্মঘাতী পদক্ষেপ। কারণ এটি দেশের অন্যতম প্রধান প্রোটিন উৎস এবং জনগণের সহজলভ্য খাদ্য সরবরাহকে বিপর্যস্ত করতে পারে। বর্তমান ২০২৪ সালের প্রেক্ষাপটে, ডিম বাংলাদেশের মানুষের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে যুক্ত হয়েছে, যা সাশ্রয়ী মূল্যে প্রথম শ্রেণির প্রোটিন সরবরাহ করে।
বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর (DLS) এই খাতে উৎপাদন এবং বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণের কাজ করে থাকলেও, ডিম আমদানির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সাধারণত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় উৎপাদন ও চাহিদা অনুযায়ী আমদানির অনুমতি প্রদান করলেও, স্থানীয় শিল্পের প্রেক্ষাপট এবং এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বিবেচনা করতে প্রায়ই ব্যর্থ হয়। এর ফলে স্থানীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কর্মসংস্থান হ্রাস পায়। বিশেষ করে যখন আন্তর্জাতিক ডিম সরবরাহকারীরা কম দামে ডিম সরবরাহ করে, তখন দেশীয় উৎপাদকরা বিপদে পড়েন এবং তাদের বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়ে।
স্থানীয় পোল্ট্রি খাত লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান ও আয়ের সুযোগ তৈরি করেছে। ডিম উৎপাদনের সাপ্লাই চেইন বেশ জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। একজন নতুন উদ্যোক্তা ডিম উৎপাদন শুরু করতে ৪-৬ মাস সময় ব্যয় করতে হয়, যেখানে তাকে পোল্ট্রি খাদ্য, মুরগির স্বাস্থ্য এবং বাজারের চাহিদার দিকে নজর রাখতে হয়। এই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হলে পুরো সাপ্লাই চেইনে আঘাত আসবে এবং স্থানীয় উৎপাদকদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
ডিম আমদানির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারের সস্তা ডিমের সরবরাহ বাড়লে দেশীয় ডিমের দাম কমে যায়, যা স্থানীয় উৎপাদনকে বিপদে ফেলে। বিশেষত, বাংলাদেশের প্রায় ৮০% মুসলিম জনগোষ্ঠীর খাদ্যাভ্যাস এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে হালাল খাদ্য সরাসরি সম্পর্কিত। তবে যদি কোনো কারণে ডিম আমদানির প্রয়োজন পড়ে, তাহলে সেই আমদানিকৃত ডিমের উৎস এবং উৎপাদন পদ্ধতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য দেওয়া উচিত। যদি ডিম এমন কোনো দেশ থেকে আমদানি করা হয়, যেখানে মুরগিদের হালাল নয় এমন খাদ্য খাওয়ানো হয়, তাহলে সেটি মুসলিমদের ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে আঘাত করতে পারে। তাই, আমদানিকৃত ডিমের উপর হালাল সার্টিফিকেশন থাকা অত্যন্ত জরুরি।
অতএব, ডিম আমদানি করলে তা স্থানীয় শিল্পের ওপর দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সরকারের উচিত এই আমদানি প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা এবং দেশীয় উৎপাদকদের রক্ষায় একটি শক্তিশালী নীতিমালা প্রণয়ন করা। উন্নত বিশ্বের মতো আমদানিকৃত ডিমের প্যাকেজিংয়ে জিএমও খাদ্যের মতো লেবেলিং থাকতে হবে, যাতে ভোক্তারা জানেন তারা কী কিনছেন এবং খাচ্ছেন।
একটি টেকসই এবং সুষম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হলে দেশীয় উৎপাদকদের সুরক্ষায় সরকারকে নির্ভরযোগ্য নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত শুধুমাত্র চাহিদা এবং সরবরাহের উপর নির্ভর না করে স্থানীয় উৎপাদকদের সমস্যা বিবেচনায় নিয়ে আমদানি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে, সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে কেবল চাহিদা-সরবরাহের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত না নিয়ে স্থানীয় উৎপাদকদের সুরক্ষায় কাজ করা উচিত। ডিম আমদানির বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে, টেকসই এবং সুষম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশীয় উৎপাদনবান্ধব নীতিমালা গ্রহণ করা জরুরি।
লেখক: ডেপুটি চিফ ভেটেরিনারি অফিসার, ভেটেরিনারি ও এনিমেল সায়েন্সেস বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ লাইভস্টক সোসাইটি (বিএলএস), সাধারন সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দলোন (বাপা) রাজশাহী, সভাপতি (২০২৩-২৪), রোটারি ক্লাব অফ রাজশাহী সেন্ট্রাল; যুগ্ম নির্বাহী সম্পাদক (বাংলাদেশ লাইভস্টক জার্নাল; ISSN 2409-7691), সম্পাদক সুজন, (রাজশাহী মেট্রোপলিটন) এবং সভাপতি, বিবিসিএফ, রাজশাহী।