"মানুষের অস্তিত্বর জন্য প্রাণী ও প্রানীর প্রতি সহানুভুতিই মনুষ্যত্বের পরিচয়"

রোটারিয়ান ড. মো. হেমায়েতুল ইসলাম আরিফ: মানবজাতির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আমরা অনেক প্রাণীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছি। প্রাণী আমাদের খাদ্য, পোশাক, চিকিৎসা এবং বিভিন্ন কাজে সাহায্য করে আসছে প্রাচীনকাল থেকেই। কিন্তু সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আমরা তাদের প্রতি দায়িত্ববোধ এবং সহানুভূতি হারাতে বসেছি।

প্রাণীদের প্রতি সহানুভূতি মানবতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। কেননা আমাদের মানবিক গুণাবলীর অন্যতম একটি মাপকাঠি হলো আমরা দুর্বল, নিরীহ ও অসহায় জীবের প্রতি কেমন আচরণ করছি। মানব সমাজে জীবজন্তুর সঙ্গে সদাচার করা একটি মহৎ গুণ, যা প্রকৃত মানবিকতা হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসা ও সহানুভূতি আমাদের সমাজ এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক। প্রাকৃতিক পরিবেশের অংশ হিসেবে, প্রাণীরা পরিবেশের ইকোসিস্টেমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যদি আমরা প্রাণীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হই এবং তাদের রক্ষা করার জন্য সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করি, তাহলে আমাদের পরিবেশও সুস্থ ও টেকসই থাকবে।

বিশ্বব্যাপী অনেক প্রাণীই আজ বিলুপ্তির পথে, যা প্রাকৃতিক ভারসাম্য এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য হুমকি স্বরূপ। এই পরিস্থিতিতে মানব জাতির দায়িত্ব হলো প্রাণীর প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করা এবং তাদের সুরক্ষার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সর্বোপরি, মানুষের আসল পরিচয় হয় তার সহানুভূতির মাধ্যমে। আমরা যদি প্রাণীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে শিখি, তবে আমাদের মানবিকতা পূর্ণতা পাবে, এবং পৃথিবী আরও সুন্দর, নিরাপদ এবং সবার জন্য বাসযোগ্য হবে। প্রতি বছর ৪ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব প্রাণী দিবস, যা প্রাণীর অধিকার রক্ষা ও কল্যাণার্থে উৎসর্গিত একটি বিশেষ দিন। এ দিবসটি প্রাণীর প্রতি মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্যের স্মারক, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, প্রাণীর প্রতি সহানুভূতি ও যত্ন নেওয়াই প্রকৃত মানবতার পরিচায়ক।

বিশ্ব প্রাণী দিবসের ইতিহাস
বিশ্ব প্রাণী দিবসের সূচনা হয়েছিল ১৯৩১ সালে, ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে অনুষ্ঠিত পরিবেশ বিজ্ঞানীদের এক সম্মেলনে। সেই সম্মেলনে ৪ অক্টোবরকে বিশ্ব প্রাণী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এটি মূলত বাস্তুসংস্থানবিদ্যার সন্ত, সেন্ট এসিসির ফ্রান্সিসের ভোজ উৎসবের সঙ্গে সংগতি রেখে পালন করার উদ্দেশ্যে নির্ধারিত হয়েছিল। এর আগে, ১৯২৫ সালে জার্মান লেখক এবং প্রকাশক হেনরীক জিম্মারমেন প্রথমবারের মতো বার্লিনে এই দিবস উদযাপন করেন। যদিও প্রথমদিকে এটি কেবলমাত্র জার্মানি, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড এবং চেকোস্লোভাকিয়ায় পালন করা হয়, পরবর্তীতে এটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

বর্তমান বিশ্ব প্রাণী দিবস ২০২৪ এর প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘পৃথিবীটা প্রাণিদেরও বাড়ি'
পৃথিবী মানবজাতির মতোই প্রাণিদেরও একটি সমান অধিকার ভিত্তিক বাসস্থান। এই গ্রহের প্রতিটি প্রান্তে, প্রতিটি জীব তার নিজস্ব পরিবেশে টিকে থাকার জন্য নির্ভরশীল। কিন্তু মানুষের আধিপত্য বিস্তারের প্রবণতায় এবং আধুনিক উন্নয়নের ধারায় আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে, আমাদের সঙ্গে এই পৃথিবী ভাগাভাগি করে বেঁচে আছে অগণিত প্রাণী। এই পৃথিবী শুধুমাত্র মানুষের নয়, এটি প্রাণিজগতেরও বাড়ি।

প্রাণিজগতের বৈচিত্র্য
পৃথিবী জুড়ে বিস্তৃত প্রাণিজগতে রয়েছে অসংখ্য প্রজাতি—স্তন্যপায়ী, উভচর, সরীসৃপ, পাখি, মাছ, এবং বিভিন্ন ক্ষুদ্রতর প্রজাতি। তাদের প্রত্যেকটি প্রজাতি তাদের নিজস্ব অনন্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মেছে এবং তাদের টিকে থাকার নিজস্ব উপায় রয়েছে। পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলেই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশের সাথে মানানসই নানা প্রজাতির প্রাণী। এদের জীববৈচিত্র্য আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মানবজাতির প্রভাব
মানবজাতির বিস্তৃত কার্যক্রম যেমন—শিল্পায়ন, নগরায়ন, বনভূমি ধ্বংস, এবং পরিবেশ দূষণ—প্রাণীদের বাসস্থানকে হুমকির মুখে ফেলেছে। বন উজাড় এবং জলাশয় শুকিয়ে ফেলা প্রাণীদের আবাসস্থলকে সংকুচিত করছে, ফলে প্রাণীরা তাদের নিজস্ব পরিবেশ থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। এছাড়াও, বন্যপ্রাণী শিকার, পাচার এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মতো কাজের মাধ্যমে তাদের অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে।

প্রাণীদের অধিকার
প্রাণীদের অধিকার বিষয়টি এখন ধীরে ধীরে গুরুত্ব পাচ্ছে। অনেক দেশেই বন্যপ্রাণী রক্ষা, তাদের বাসস্থান সংরক্ষণ এবং অবৈধ শিকার বন্ধের জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। পৃথিবীতে সব প্রাণীরই বাঁচার অধিকার রয়েছে। তাদের বেঁচে থাকার পরিবেশ ধ্বংস করা, শিকার করা কিংবা অত্যাচার করা মানবতা বিরোধী কাজ হিসেবে গণ্য করা উচিত।

প্রাণীদের জন্য মানবিক আচরণ
আমাদের মনে রাখা উচিত যে, আমরা একা নই এই গ্রহে। মানবজাতি এবং প্রাণিজগতের মধ্যে একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই প্রাণীদের প্রতি সম্মান এবং দায়িত্বশীলতা প্রদর্শন করা উচিত। তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করে আমরা একটি সুস্থ ও টেকসই পৃথিবী গড়তে পারি।

উপসংহার
পৃথিবীটা শুধু আমাদের নয়, এটি প্রাণীদেরও বাড়ি। এই পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণী আমাদের মতোই টিকে থাকার অধিকার নিয়ে জন্মেছে। তাদের বাসস্থান এবং অধিকার রক্ষায় সচেতন পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং আমাদের আচরণে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। আমরা যদি প্রাণীজগতকে তাদের ন্যায্য অধিকার দেই এবং তাদের প্রতি যত্নবান হই, তবেই আমরা একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী পৃথিবী নির্মাণ করতে সক্ষম হবো, যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও বাসযোগ্য হয়ে উঠবে।

প্রাণী দিবস কেবলমাত্র একটি দিন নয়, বরং এটি আমাদের জীবনের একটি বার্তা বহন করে। মানুষ এবং প্রাণী উভয়েরই পৃথিবীতে সমানভাবে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো এবং তাদের কল্যাণের দিকে মনোযোগ দেওয়া আমাদের মানবিক দায়িত্ব। মানবতার প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ পায় তখনই, যখন আমরা আমাদের চারপাশের প্রাণীদের সঙ্গে সহানুভূতির সাথে আচরণ করি। এভাবে, আমরা শুধুমাত্র তাদের অধিকার নিশ্চিত করছি না, বরং আমাদের মানবেত্বকেও নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছি।

লেখক: ডেপুটি চিফ ভেটেরিনারি অফিসার, ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ লাইভস্টক সোসাইটি (বিএলএস) সাধারন সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দলোন (বাপা) রাজশাহী, আইপিপি, রোটারী ক্লাব অব রাজশাহী সেন্ট্রোল, , যুগ্ম নির্বাহী সম্পাদক (বাংলাদেশ লাইভস্টক জার্নাল; ISSN 2409-7691), সম্পাদক সুজন, (রাজশাহী মেট্রোপলিটন), ও সভাপতি, বিবিসিএফ, রাজশাহী।