বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি প্রতিরোধ ও প্রস্তুতি

সমীরণ বিশ্বাস: বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিকভাবে ভূমিকম্প-প্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত। দেশটি তিনটি প্রধান টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে রয়েছে : ইউরেশিয়ান প্লেট, ইন্ডিয়ান প্লেট ও বার্মা মাইক্রোপ্লেট। এই প্লেটগুলোর সংঘর্ষ ও সঞ্চিত ভূতাত্ত্বিক চাপের কারণে বাংলাদেশে মাঝারি থেকে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের সম্ভাবনা রয়েছে। চলতি বছর জানুয়ারি মাসে প্রথম সপ্তাহে তিনটি ভূমিকম্প হয়েছে বাংলাদেশ। ২০২৪ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ৬০টি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে এ অঞ্চলে। এই ছোট ছোট ভূকম্পন কি আমাদের কোন সতর্কবার্তা দিচ্ছে ? বড় কোন ভূকম্পন কি ঘটতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ? বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় যদি ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হয় তাহলে ৮ লাখ ৬৪ হাজার ভবন ধ্বসে পড়বে যা শতকরার হিসেবে মোট বিল্ডিংয়ের ৪০% । এই ভূমিকম্প যদি দিনের বেলায়  হয়, তা হলে ২১০০০০ মানুষের মৃত্যু হবে। ভূমিকম্পটি যদি রাতের বেলায় হয়,  তা হলে ৩২০০০০ মানুষের মৃত্যু হবে।  এই তথ্য উঠে এসেছে ২০২৩ সালে রাজুকের গবেষণায়। বর্তমান সময়ে বিশেষজ্ঞদের মতে ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ । বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৭.৫ - ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। 

ভূমিকম্প-প্রবণ এলাকা: উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা: সিলেট, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রাঙামাটি, বান্দরবান। মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা: ঢাকা, কুমিল্লা, ফরিদপুর। কম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা: খুলনা, বরিশাল। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামে ৭.৫ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঘটনা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাত্রায় রেকর্ড করা হয়েছে। ২০০১ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৭ বছরে মোট ৫৯০টি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, যা বছরে গড়ে প্রায় ৩৫টি ভূমিকম্পের সমান। এই গড় অনুসারে, গত ৮ বছরে (২০১৭ থেকে ২০২৫) ২৮০টি ভূমিকম্প হয়েছে। তবে, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পেতে আবহাওয়া অধিদপ্তর বা ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের সর্বশেষ তথ্য পর্যালোচনা করা উচিত। বাংলাদেশে বছরে গড়ে ৩৫টি মৃদু ভূমিকম্প (সাধারণত ৪.০ বা তার কম মাত্রার) বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূতাত্ত্বিক এবং ভূমিকম্প সংক্রান্ত ইঙ্গিত বহন করে।

ভূতাত্ত্বিক চাপে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি: প্রতিটি ছোট ভূমিকম্প আসলে ভূগর্ভস্থ টেকটোনিক প্লেটের মধ্যে চাপ নির্গমনের ফলাফল। কিন্তু যদি এই চাপ ধীরে ধীরে জমতে থাকে এবং নিয়মিতভাবে মুক্ত না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা থাকে।

ফল্ট লাইনের সক্রিয়তা: বাংলাদেশের নিচ দিয়ে কয়েকটি প্রধান ভূমিকম্প-প্রবণ ফল্ট লাইন রয়েছে, যেমন: দাউকি ফল্ট (Dauki Fault) – সিলেট অঞ্চলে, মধুপুর ফল্ট (Madhupur Fault) – ঢাকার কাছাকাছি, চিটাগাং-আরাকান ফল্ট (Chittagong-Arakan Fault) – চট্টগ্রাম ও পার্বত্য অঞ্চলে। মেঘনা ফল্ট (Meghna Fault) এই ফল্ট লাইনগুলো যদি সক্রিয় থাকে, তবে ভূমিকম্পের হারও বেশি হবে এবং এটি ভবিষ্যতে বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস হতে পারে। এই ফল্ট লাইনগুলো সক্রিয় হলে ঘনঘন ভূমিকম্প অনুভূত হতে পারে, যা একটি বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তোলে।

ভূতাত্ত্বিক চাপে বৃদ্ধি: বারবার ছোট মাত্রার ভূমিকম্প ইঙ্গিত দেয় যে টেকটোনিক প্লেটগুলোর মধ্যে চাপ জমছে। যদি এই চাপ ধীরে ধীরে মুক্ত না হয়, তবে এটি একটি বৃহৎ ভূমিকম্পের (Major Earthquake) পূর্বাভাস হতে পারে।

মাটির গঠন দুর্বল হয়ে পড়া: একটি এলাকায় বারবার ভূমিকম্প হলে মাটির শক্তি কমে যেতে পারে, বিশেষ করে ঢাকার মতো জায়গায় যেখানে অনেক নদী থেকে আসা নরম পলি রয়েছে। ফলে ভবন ও অবকাঠামোর ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ে।

ভবিষ্যৎ বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত: বিজ্ঞানীরা মনে করেন, একাধিক ছোট ভূমিকম্প একটি বড় ভূমিকম্পের আগাম সংকেত হতে পারে। বিশেষ করে যদি এটি একই অঞ্চলে বারবার ঘটে এবং কম্পনের মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।

ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিয়ে গবেষণা ও সতর্কবার্তা: বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে সতর্কবার্তা আসতে পারে যে বাংলাদেশ বড় ভূমিকম্পের জন্য প্রস্তুত কি না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরের ভবন ও অবকাঠামো বড় ভূমিকম্প সহ্য করার মতো উপযুক্ত নয়, তাই যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করা জরুরি।

সিসমিক গ্যাপ (Seismic Gap) তৈরি হওয়া:  যদি কোনো অঞ্চলে দীর্ঘদিন বড় ভূমিকম্প না ঘটে, তবে এটি "সিসমিক গ্যাপ" তৈরি করে, যা ভবিষ্যতে একটি ভয়াবহ ভূমিকম্পের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে। ছোট ভূমিকম্পগুলো যদি পর্যাপ্তভাবে শক্তি নির্গমন না করতে পারে, তাহলে এক সময় জমে থাকা শক্তি হঠাৎ করে বড় ধরনের ভূমিকম্প ঘটাতে পারে।

ভবন ও অবকাঠামোর ওপর প্রভাব: নিয়মিত ছোট ভূমিকম্পের কারণে দুর্বল ভবনগুলো আরও দুর্বল হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে পুরনো ও অপরিকল্পিত ভবনগুলোর কাঠামোগত সমস্যা দেখা দিতে পারে, যা বড় ভূমিকম্পে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।

ভবিষ্যৎ ভূমিকম্পের পূর্বাভাস: বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ছোট ভূমিকম্পগুলো যদি নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলে ঘনঘন হয়, তবে এটি সেখানে বড় ভূমিকম্পের প্রস্তুতির ইঙ্গিত দিতে পারে। বিশেষত, ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় নিয়মিত ভূমিকম্প হলে, এটি বড় বিপর্যয়ের সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে।

প্রতিরোধ ও প্রস্তুতি: ভূমিকম্প সহনীয় ভবন নির্মাণ বাধ্যতামূলক করা। ফল্ট লাইনগুলোর পর্যবেক্ষণ বৃদ্ধি করা। জনগণকে ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রশিক্ষণ দেওয়া। জরুরি উদ্ধার ও ত্রাণ ব্যবস্থার উন্নতি করা। সচেতনতা বৃদ্ধি করা ও মহড়া চালানো । জরুরি উদ্ধার ও ত্রাণ ব্যবস্থার উন্নতি করা। ফায়ার সার্ভিস ও উদ্ধার বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। হাসপাতাল ও চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ভূমিকম্প পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত করা। সেনাবাহিনী ও অন্যান্য বাহিনী ভূমিকম্প পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত করা। স্কুল, কলেজ, অফিসে ভূমিকম্প মহড়া বাধ্যতামূলক করা। জনগণকে ভূমিকম্পকালীন করণীয় সম্পর্কে সচেতন করা। উন্নত ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা। আন্তর্জাতিক গবেষণা ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।

বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে, তবে তা মোকাবিলার সক্ষমতা এখনও অনেক সীমিত। ভূমিকম্প-সহনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, সচেতনতা বৃদ্ধি ও জরুরি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন জরুরি, নাহলে বড় ভূমিকম্প হলে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশে বছরে ৩৫টি মৃদু ভূমিকম্প একটি স্বাভাবিক ঘটনা মনে হলেও, এটি ভবিষ্যতে বড় ভূমিকম্পের জন্য একটি সতর্কবার্তা হতে পারে। তাই এখন থেকেই ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। সুতরাং, বাংলাদেশের ঘনঘন ছোট ভূমিকম্প ভবিষ্যতে বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাই এখন থেকেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।