ডিম বিক্রি করে খামারিরা যে লাভ করেন মধ্যস্বত্ত¡ভোগীরা করেন তার তিনগুণ
এগ্রিলাইফ২৪ ডটকম: বাংলাদেশে তৈরি পোষাক শিল্পকে প্রাধান্য দেয়া হয় কারণ তাঁদের ব্যবসার কারণে বড় অংকের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জিত হয়; বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের গুরুত্ব দেয়া হয় কারণ তাঁরা রেমিট্যান্স পাঠায় কিন্তু যে খামারিদের কারণে আমরা খাদ্য পাই, সুস্থ থাকি, বেঁচে থাকি তাঁদের কথা কেউ বলেন না।
শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) রাজধানীতে অনুষ্ঠিত "Cost-Effective and Sustainable Poultry Production" শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মিজ্ ফরিদা আখতার এ মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, আমরা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষিখাতের দিকে তাকাই। কৃষিখাত থেকে চাল, ডাল, সব্জি পাওয়া যায় ঠিকই কিন্তু মাছ, মাংস, ডিম, দুধ পেতে হলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদখাত ছাড়া বিকল্প নেই। মিজ্ ফরিদা আখতার বলেন- ছাত্র-জনতার আন্দলনে আহতদের চিকিৎসার সময় অনেকের ক্ষেত্রে বারবার এন্টিবায়োটিক পরিবর্তন করতে হয়েছে; কারণ অনেক এন্টিবায়োটিক কাজ করছে না। তাই ডিম, দুধ, মাংসকে এন্টিবায়োটিকমুক্ত ও নিরাপদ করা অত্যন্ত জরুরি।
প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা বলেন- ডিম আমদানির মত এমন ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবেনা কারণ ডিমের সাথে রোগও আমদানি হতে পারে। খামারিরা নিরুৎসাহিত হলে কষ্টে গড়ে তোলা খামারগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। খামারিদের লাভ আর আমদানিকারকের লাভের মধ্যে পার্থক্য আছে।
মিজ্ ফরিদা বলেন- বাংলাদেশের প্রায় ১ লাখ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়। গরুরা বুদ্ধিমান কারণ তারা তামাক পাতা খায়না। চাষিরা তামাক চাষ থেকে করে আসতে চান কিন্তু বিপণনের ঝামেলা কিংবা অন্য ফসল করে লাভ করতে পারবেন কীনা সে অনিশ্চয়তার কারণে চাষ ছাড়তে পাচ্ছেন না। সেক্ষেত্রে ভুট্টা চাষ বাড়ালে তামাক চাষ কমতে পারে। ‘বাণিজ্যিক পোল্ট্রি ফার্মিং’ এর পাশাপাশি বিকল্পধারার ‘পোল্ট্রি ফার্মিং’ ও ‘ফ্রি রেঞ্জ ফার্মিং’ কিভাবে জনপ্রিয় করা যায় তা নিয়ে ভাবা উচিত বলে মনে করেন মিজ্ আখতার। শুধুমাত্র ডিম-মুরগির দাম বাড়ার খবর নয় বরং এখাতের সম্ভাবনার কথাও সর্বসাধারণের সামনে তুলে ধরার জন্য সংবাদমাধ্যমের প্রতি আহবান জানান প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা।
ওয়াপসা-বাংলাদেশ শাখা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন- একটি সংগঠনের পতাকাতলে এত বিশাল সংখ্যক বিজ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষক, খামারি ও উদ্যোক্তা রয়েছেন তা জানা ছিল না। ‘ওয়াপসা-বাংলাদেশ শাখা’কে বাংলাদেশের একটি সম্পদ বলে উল্লেখ করেন মিজ্ ফরিদা।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি- মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন- ডিমের দামের কারণে আমরা সবসময় অস্থির থাকি। ডিমের দাম বাড়লে যে স্পর্শকাতরতা তৈরি হয়, অন্য কিছুর দাম বাড়লে তা হয়না। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ডিমের যে যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে বাজারে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছেনা।
জনাব বেলাল হায়দর বলেন- একজন উৎপাদক যে লাভ করে; তার দুই থেকে তিনগুণ লাভ করছে মধ্যস্বত্ত¡ভোগীরা। এটা হতে পারেনা। যেখানে আবাদি জমির পরিমাণ কমছে, সেখানে পোল্ট্রি সেক্টর দিন দিন আরও বড় হচ্ছে। এই ইতিবাচক অগ্রগতি ধরে রাখতে হবে। তিনি বলেন- ফিড তৈরির সিংহভাগ কাঁচামাল আমদানি করতে হচ্ছে। অতএব কিভাবে সাশ্রয়ী দামে এগুলো পাওয়া যেতে পারে তা নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন। সচিব বলেন- এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামীতে পোল্ট্রিখাতে বড় কোনো বিপর্যয় দেখা দিলে, সামাল দেয়া কঠিন হবে। ফিডের কাঁমামাল আমদানি কমিয়ে কিভাবে উৎপাদন বাড়ানো যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডাঃ মোহাম্মদ রিয়াজুল হক বলেন- ছোট খামারগুলোকে বড় করতে হবে; লাইভবার্ড মার্কেট ক্রমান্বয়ে বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন- ব্রয়লার মাংস সংরক্ষণে যতক্ষণ পর্যন্ত না কোল্ডস্টোরেজ সুবিধা নিশ্চিত করা যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত একদিন বয়সী ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার দামে স্থিতিশীলতা আনা কঠিন হবে।
ওয়াপসা-বাংলাদেশ শাখার সভাপতি মসিউর রহমান বলেন- ডিম-মুরগির উৎপাদন যত বাড়বে, উৎপাদন খরচ ততই কমবে। বিভিন্ন এজেন্সীর মাধ্যমে চাপ দিয়ে কখনও দাম কমানো সম্ভব না। খামারিদের কে উৎসাহ ও সাহস দিতে হবে এবং মধ্যস্বত্ত¡ভোগীদের সবসময় নজরদারিতে রাখতে হবে। ফিডের উৎপাদন খরচ কমলে ডিম-মুরগির দাম এমনিই কমবে।
তিনি বলেন- ফিড তৈরির প্রায় সব কাঁচামাল ভারতে উৎপাদিত হয়। সে কারণে তাদের উৎপাদন খরচ কিছুটা কম হবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে তারপরও বাংলাদেশে এক কেজি ফিডও আমদানি হয়না কারণ বাংলাদেশের ফিডের মান অনেক ভাল। পোল্ট্রি লিটারকে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে জৈব সার ও বায়োগ্যাস উৎপাদন করে; মুরগির উচ্ছিষ্ট হাড়-মাংস-রক্ত কে পোল্ট্রি মিলে রূপান্তরিত করে এবং পোল্ট্রি খামারের রুফটপগুলোতে সোলার স্থাপনের মাধ্যমে গ্রীণ রুফটপে রূপান্তরিত করার মাধ্যমে পোল্ট্রি সেক্টরকে “জিরো কার্বন ইমিশন সেক্টর” হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। ”NET-ZERO” অর্জন করা সম্ভব।
ওয়াপসা-বাংলাদেশ শাখার সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব কুমার প্রামানিক বলেন- পোল্ট্রি হচ্ছে সেই শিল্প যা- সুলভ মূল্যে নিরাপদ ও স্বাস্থসম্মত খাদ্য ও পুষ্টির যোগান নিশ্চিত করছে। তাই এ শিল্পকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এ কথাটি বলা যত সহজ, ততটাই কঠিন। সরকারের সহযোগিতা ছাড়া এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। সরকার, বেসরকারি উদ্যোক্তা ও খামারিদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই এ লক্ষ্য অর্জনকে সহজতর করবে।
পোল্ট্রি বিষয়ক আন্তর্জাতিক সেমিনারটির মূল প্রবন্ধ উপস্থাপক- বিপিআইসিসি এবং ফিড ইন্ডাষ্টিজ এসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ফিআব) এর সভাপতি- শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, প্রতিদিন ৬ কোটি ডিমের চাহিদা আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই নিজস্ব উৎপাদনের মাধ্যমেই এ চাহিদা পূরণ করতে হবে। তিনি বলেন- পোল্ট্রি সেক্টরের ছোট খামারিরাই সবচেয়ে বড় অবদান রাখছেন। তবে তাঁদের পেছনে সহায়ক হিসেবে কাজ করছে ফিড মিল, ব্রিডার খামার ও বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। ছোট খামারিরা যদি বড়দের দ্বারা নির্যাতিত-নিষ্পেশিত হতো; তবে এ খাতটি আজকের অবস্থানে আসতে পারত না।
তিনি বলেন- পোল্ট্রি সেক্টর শ্রমিক নয় বরং উদ্যোক্তা তৈরি করে। ভারত ও ইরানকে বাদ দিলে বাংলাদেশে ডিমের দাম সবচেয়ে কম। জনাব খালেদ বলেন- ভুট্টা ও সয়াবিনের দাম যে হারে বেড়েছে সে হারে ফিডের দাম বাড়েনি। প্রতি কেজি ফিডে ওয়ার্কিং ক্যাপিট্যাল ১ টাকা, জ্বালানী খরচ ১ টাকা; অপারেশনাল খরচ ৩-৫টাকা বেড়েছে। বিপিআইসিসি সভাপতি বলেন- বিগত কয়েক বছওে অনেক মাঝারি ও ছোট ফিড মিল বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমান সময়ে ব্রয়লার ও সোনালী মুরগির খামারিরা লোকসান করছেন। তিনি বলেন, খামার থেকে ভোক্তার হাত পর্যন্ত পোঁছাতে একটি মুরগি ৭ বার হাত বদল হয়। সঙ্গত: কারণেই দাম বৃদ্ধি পায়। তাই দাম কমাতে হলে ধাপগুলোও কমাতে হবে।
আরেফিন খালেদ বলেন- খামার ও খুচরা বাজারের মাঝে প্রতি কেজি মুরগিতে দামের পার্থক্য ২০-২৫ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয় অথচ পার্থক্য হচ্ছে ৪৫-৫০ টাকা। ডিম-মুরগির-ফিডের উৎপাদন খরচ কমাতে হলে- বোভাইন সোর্স থেকে ‘মিট এন্ড বোন মিল’ আমদানির অনুমতি দিতে হবে; শুল্ক সুবিধায় ‘রাইস ডিডিজিএস’ এবং অন্যান্য বিকল্প কাঁচামাল আমদানির সুবিধা দিতে হবে; তেলের মূল্য নির্ধারণের সময় ট্যারিফ কমিশনকে একই বৈঠকে সয়াবিন মিলের দামও নির্ধারণ করে দিতে হবে; পোল্ট্রিতে কৃষির হারে সুদের হার নির্ধারণ করতে হবে। বিদ্যুৎ বিলও কৃষির হারে বিবেচনা করতে হবে। কনট্যাক্ট ফার্মিং কে কিভাবে খামারি-বান্ধব করা যায় সে বিষয়ক কৌশলপত্র তৈরি করতে হবে। জনাব খালেদ বলেন- পোল্ট্রিখাতের সাথে ৯টি মন্ত্রণালয় ও ১৩টি অধিদপ্তর-সরকারি সংস্থার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এত নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাদ দিয়ে কেবলমাত্র মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে একক তদারকি সংস্থা হিসেবে ক্ষমতায়িত করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর মো. রফিকুল ইসলাম বলেন- আমাদের মত দেশের জন্য পোল্ট্রি হচ্ছে আশির্বাদ। এ সেক্টরকে বড় করার এখনও অনেক সুযোগ আছে। প্রফেসর রফিক মনে করেন- ডিম-মুরগির উৎপাদন দুই থেকে তিনগুণ বাড়ানো সম্ভব। তবে খাতটিকে টেকসই করতে হলে ‘কস্ট ইফেকটিভ’ করতে হবে, ‘প্রোডাকটিভিটি’ বাড়াতে হবে।
সেমিনারের বিভিন্ন সেশনে যাঁরা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন- প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক-খামার, ড. এবিএম খালেদুজ্জামান, ভারত থেকে আগত এনিমেল নিউট্রিশন কনসালট্যান্ট ডাঃ অমিত দাস, বাংলাদেশ সিসটেমস স্ট্রেনদেনিং ফর ওয়ানহেলথ এর চীফ অব পার্টি প্রফেসর নীতিশ চন্দ্র দেবনাথ এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রফেসর মো. রফিকুল ইসলাম।
প্রথম সেশনটি সভাপতিত্ব করেন - ইউজিসি প্রফেসর এস.ডি. চৌধুরী। সহ-সভাপতি ছিলেন কেজিএল এর নির্বাহী পরিচালক, ড. নাথু রাম সরকার। দ্বিতীয় সেশনটি সভাপতিত্ব করেন- বাকৃবি’র প্রফেসর মো. বাহানুর রহমান। সহ-সভাপতি ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের সিএসও-লাইভস্টক ডিভিশন ডিরেক্টর (নিউট্রিশন বিভাগ), ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম।
দিনব্যাপী এ আন্তর্জাতিক সেমিনারে প্রায় চার শতাধিক বিজ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং পোল্ট্রি স্টেকহোল্ডারগণ অংশগ্রহণ করেন।
===============