এগ্রিলাইফ২৪ ডটকম: ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। এই মাছ স্বাদে অতুলনীয় ও গন্ধের জন্য দেশ ও বিদেশে রয়েছে এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা। এই অতুলনীয় স্বাদের জন্য ইলিশকে মাছের রাজাও বলা হয়। ইলিশ দিয়ে তৈরি হয় নানান ধরনের মুখরোচক খাবার। তবে ইলিশ দিয়ে প্রথমবারের মত কৌটাজাতকৃত খাদ্য তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (শেকৃবি) এর এক দল গবেষক যার নেতৃত্ব দেন অধ্যাপক ড. কাজী আহসান হাবীব।
ইলিশ অধিক আমিষ ও চর্বিযুক্ত মাছ। ইলিশের চর্বিতে বিদ্যমান ওমেগা-৩ নামক অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড যা রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমিয়ে হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমায় এবং শরীরকে সুস্থ ও সতেজ রাখে। ইলিশে অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড থাকার কারণে হিমায়িত করা হলেও এটি জারিত হয়ে এর গুণগত মান দীর্ঘ সময় ভাল থাকে না। আবার চর্বিযুক্ত হওয়ায় ইলিশ মাছ শুঁটকি হিসাবেও দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায় না। এই প্রেক্ষাপটে প্রায় দুই বছর সময় ধরে গবেষণা করে ইলিশের স্বাদ অক্ষুণ্ণ রেখে দীর্ঘদিন সংরক্ষণযোগ্য কৌটাজাতকৃত পণ্য তৈরির প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন শেকৃবি এর এই গবেষকদল। এই গবেষণাটি বাংলাদেশ সরকারের মৎস্য অধিদপ্তরের সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট (SCMFP) এর অর্থায়নে পরিচালিত হয়।
গত ৩০ মার্চ শনিবার সকাল ১০ টায় শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলিশ ও অন্যান্য সামুদ্রিক মাছের ক্যানিং প্রযুক্তি হস্তান্তরের উপর একটি কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাছের কৌটাজাতকরণের বিভিন্ন দিক এবং বাংলাদেশে এই শিল্পের সম্ভাবনা তুলে ধরেন গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক ড. কাজী আহসান হাবীব। তিনি বলেন, তার পরিচালিত গবেষণায় কৌটাজাতকৃত ইলিশকে এক বছর পর্যন্ত রেখে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, এর গুনগত মান অনায়াসেই ভাল থাকে। এই সময়ের মাঝে জারণ ক্রিয়াও তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না এবং এর মাঝে কোনো অনুজীবেরও বিকাশ ঘটেনি। উদ্ভাবিত এই কৌটাজাত ইলিশের বিশেষ বৈশিষ্ট হচ্ছে এর কাঁটা নরম হয়ে মাছের সাথে মিশে যায়। কিন্তু কৌটায় ইলিশের টুকরোর আকৃতি নষ্ট হয় না। ফলে এই ইলিশ খেতে কাঁটা বাছার ঝামেলা নেই। উপরন্তু এই নরম হয়ে যাওয়া কাঁটা বরং ক্যালসিয়ামের উৎস হিসাবে কাজ করে।
উক্ত কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া, গেস্ট অফ অনার হিসেবে মঞ্চ অলংকৃত করেন মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জনাব সৈয়দ মোঃ আলমগীর । এছাড়াও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. অলোক কুমার পাল, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোঃ নজরুল ইসলাম এবং সাস্টেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের পরিচালক জনাব মোঃ জিয়া হায়দার চৌধুরী। কর্মশালাটি সভাপতিত্ব করেন ফিশারিজ, একোয়াকালচার এবং মেরিন সায়েন্স অনুষদের ডীন অধ্যাপক ড. আসিফ ওয়ারেস নেওয়াজ। উক্ত কর্মশালাটিতে অংশ নেয়া মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকারক ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি এবং উদ্যোক্তাদের মাঝে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করে এবং মৎস্য কৌটাজাতকরণ শিল্প প্রতিষ্ঠায় তাদের ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের পক্ষ থেকে সাগর ফিশ এক্সপোর্ট এর কর্ণধার জনাব আবেদ আহসান সাগর বলেন, যে বিশ্বে এই মৎস্যজাত পন্যের ক্যান শিল্পের বিরাট বাজার রয়েছে। তাই রপ্তানির সম্ভাবনাও প্রচুর। কিন্তু দেশে এই শিল্পটি একেবারে নতুন হওয়ায় তারা এই শিল্পে বিনিয়োগ করলে এসংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে মৎস্য অধিদপ্তরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দপ্তরের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা কামনা করেন।
মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ মোঃ আলমগীর বলেন, সরকার মৎস্য শিল্পের উন্নয়নে সবসময় আন্তরিক। সরকার তার নির্বাচনী ইস্তেহারে মৎস্য ও মৎস্যজাত পন্য রপ্তানী করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তার পরিমান হলো পনের হাজার কোটি টাকা। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কৌটাজাত ইলিশসহ অন্যান্য কৌটাজাত মাছ হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য। তাই তিনি টিনজাত মাছ উৎপাদনে এগিয়ে আসার জন্য মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকারক ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি আহবান জানান এবং এবিষয়ে সরকারের সকল ধরণের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া বলেন, ইলিশ আমাদের একটি জিআই পন্য। জিআই পন্যের গুরুত্বকে কাজে লাগিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারলে এটি আরও সার্থকতা পায়। অধ্যাপক হাবীবের গবেষণা লব্ধ ফল অর্থাৎ টিনজাত ইলিশ তৈরির এই প্রযুক্তি নিঃসন্দেহে এক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অবদান। গবেষণাটিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে বিশেষ করে এর শেল্ফলাইফ ন্যূনতম ০২ বছর পর্যন্ত পরীক্ষা করা দরকার, এতে করে রপ্তানি সহজতর হবে।
ড. মোঃ শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া টিনজাত ইলিশের মত এই ধরণের উদ্ভাবনীমূলক গবেষণায় মৎস্য অধিদপ্তরকে অর্থায়নের আহবান জানান। তিনি ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সহযোগিতার মাধ্যমে গবেষণার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন এবং বলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তি উদ্ভাবনমূলক গবেষণায় ইন্ডাস্ট্রিকেও এগিয়ে আসতে হবে ও অর্থায়ন করতে হবে। এতে করে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো উদ্ভাবিত নতুন প্রযুক্তি বা পণ্যকে কাজে লাগিয়ে যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও গবেষণায় এগিয়ে যেতে পারে।
দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এই প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন ও প্রশিক্ষণ নেন মৎস্য কৌটাজাতকরণ শিল্প স্থাপন ও ব্যবসায়ে আগ্রহী প্রায় ৩০টি মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এবং উদ্যোক্তা সৃষ্টিকারী স্বনামধন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও।
প্রতিষ্ঠানগুলো হলো বেঙ্গল মিট প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ, সী রিসোর্স গ্রুপ, সাগর ফিশ এক্সপোর্ট, কাজী ফার্মস, এম এ তায়েব লিঃ (টিকে গ্রুপ), ব্র্যাক ফিশারিজ এন্টারপ্রাইজ, পল্লী-কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ), রোজেমকো ফুডস লিঃ, টোটাল ফুড প্রসেসিং প্রাইভেট লিঃ, আলফা এক্সেসরিস এন্ড এগ্রো এক্সপোর্ট লিঃ, বাগেরহাট সী ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ, সাউদার্ন ফুডস লিঃ, জাপান ফাস্ট ট্রেড লিঃ, এসিআই এগ্রোলিঙ্ক লিঃ, জাহানাবাদ সী ফুডস লিঃ, নিরাপদ শুঁটকি ঘর, এমইউসী ফুডস লিঃ, জেমিনি সী ফুড লিঃ, পিকো কর্পোরেশন, ইশারা এগ্রিভেঞ্চারস, থ্রিসিক্সটি সার্ভিসেস লিঃ, সাইদুল্লাহ (প্রাইভেট) এন্টারপ্রাইজ লিঃ, এস আর ট্রেডার্স, ভিজিল্যান্স এক্সপ্রেস লিঃ, চাখার এগ্রো কমপ্লেক্স, ইউনিপেক্স ট্রেড কর্পোরেশন লিঃ, সলিডারিড্যাড নেটওয়ার্ক এশিয়া।
এই কর্মশালায় ধাতব কৌটা উৎপাদন শিল্পের স্বত্বাধিকারী, খাদ্য কৌটাজাত কারখানায় হ্যাসাপ ও গুণমান যাচাইকারী নিরীক্ষক ও সনদপ্রদানকারী, এবং একজন ব্যবসা পরামর্শক আমন্ত্রিত বিশেষজ্ঞ হিসাবে মৎস্য কৌটাজাতকরণ শিল্প ও ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়াদি উদ্যোক্তাদের সামনে তুলে ধরেন।
গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক ড. কাজী আহসান হাবীব এই গবেষণায় তার অভিজ্ঞতা এবং প্রাপ্ত ফলাফল কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের মাঝে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন। পাশাপাশি এই কর্মশালায় ইলিশ মাছ কৌটাজাতকরণ পদ্ধতি গবেষণাগারে সরেজমিনে পরিদর্শন করানো এবং হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দেয়ানোর মাধ্যমে উদ্ভাবিত ইলিশ মাছের কৌটাজাতকরণ প্রযুক্তিটি অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে হস্তান্তর করেন।