বাংলাদেশে ইউরিয়া সাশ্রয়ের নতুন দিগন্ত: ব্রি দানাদার ইউরিয়া সার প্রয়োগ যন্ত্র

এগ্রিলাইফ২৪ ডচকমঃ বাংলাদেশের কৃষি খাত দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতির মূল ভিত্তি। দেশের অধিকাংশ কৃষক ধান চাষের ওপর নির্ভরশীল, এবং ফসলের উৎপাদন বাড়াতে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক সারের মধ্যে ইউরিয়া সার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, ইউরিয়া সার পরিবেশের জন্য মোটেও টেকসই নয়। বিশ্বব্যাপী ইউরিয়া সারের ব্যবহার প্রতি বছর ১.১৩ গিগা টন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের জন্য দায়ী, যা বৈশ্বিক কৃষি নির্গমনের ১০.৬ শতাংশ এবং গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গমনের ২.১০ শতাংশ। এই গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের ৩৮.৮ শতাংশ ইউরিয়া সারের উৎপাদনের জন্য এবং ৫৮.৬ শতাংশ সরাসরি মাঠ পর্যায়ে ব্যবহারের জন্য ঘটে।

বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৩৪ লক্ষ টন ইউরিয়া সার ব্যবহার হয়, যার ৮০ শতাংশ বা প্রায় ২৭ লক্ষ টন শুধুমাত্র ধান চাষে ব্যবহৃত হয়। অধিকাংশ কৃষক সনাতন পদ্ধতিতে ছিটিয়ে ইউরিয়া প্রয়োগ করেন, যার দক্ষতা মাত্র ৩০-৩৫ শতাংশ। ফলে, ৬৫-৭০ শতাংশ সার অপচয় হয়ে পরিবেশে মিশে যায়। এই অপচয়ের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় ১১,৭১৮ কোটি টাকা। একইসাথে ইউরিয়া সার ছিটিয়ে প্রয়োগের ফলে তা বাতাসে মিশে পরিবেশ দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে এনসিসি ব্যাংক। তাদের কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি (সিএসআর) কর্মসূচির আওতায় পরিচালিত “Dissemination of Prilled Urea Applicator Project” দেশের কৃষি খাতে সারের অপচয় রোধ এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই প্রকল্পে ব্যবহৃত ব্রি উদ্ভাবিত "দানাদার ইউরিয়া সার প্রয়োগ যন্ত্র" মাটির ৭-৮ সেন্টিমিটার গভীরে সরাসরি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে সক্ষম, যা সারের প্রায় ৪০ শতাংশ সাশ্রয় করতে সহায়ক। এই উদ্ভাবন দেশের কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমিয়ে আয় বৃদ্ধিতে এবং টেকসই কৃষি চর্চা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) এই উদ্ভাবনী যন্ত্রটি দেশের কৃষিতে এক যুগান্তকারী ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশে ইউরিয়া সারের অপচয় এবং পরিবেশ দূষণ উল্লেখযোগ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ সনাতন পদ্ধতিতে ইউরিয়া ছিটিয়ে প্রয়োগের ফলে প্রায় ৬৫-৭০ শতাংশ সার পরিবেশে মিশে যায়। এর ফলস্বরূপ প্রতি বছর প্রায় ১১,৭১৮ কোটি টাকার সার অপচয় হয় এবং নাইট্রাস অক্সাইড নির্গমনের মাধ্যমে এটি জলবায়ু পরিবর্তনেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। ইউরিয়া সারের এই অপচয় রোধ করতে নতুন উদ্ভাবনী প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা ছিল, যা "দানাদার ইউরিয়া সার প্রয়োগ যন্ত্র" পূরণ করতে সক্ষম।

এই যন্ত্রটি ইউরিয়া সারের অপচয় কমিয়ে মাটির গভীরে সরাসরি সার প্রয়োগ করতে পারে, যা সারের পুষ্টি দ্রুততরভাবে শিকড়ে পৌঁছায় এবং ফলে ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়ে। এই পদ্ধতিতে সারের কার্যকারিতা ৩০-৩৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৭০ শতাংশে পৌঁছানো সম্ভব। এই প্রযুক্তি একদিকে যেমন কৃষকদের জন্য সাশ্রয়ী, তেমনই এটি পরিবেশ সুরক্ষায়ও ভূমিকা রাখে। কৃষকেরা এতে সারের খরচ কমাতে পারবে, যা তাদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতায় বিশেষভাবে সহায়ক হবে।

সম্প্রতি এই প্রকল্পের গবেষণা মাঠ পরিদর্শনে গেছেন এনসিসি ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোঃ মাহবুব আলম, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোঃ শাহিদুল ইসলাম এবং ব্রি’র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. গোলাম কিবরিয়া ভূঁইয়া। মাঠ পরিদর্শন শেষে কর্মকর্তারা প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং ব্রি ও এনসিসি ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগের প্রশংসা করেন। এনসিসি ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা তাদের সিএসআর কর্মসূচির আওতায় এই প্রকল্পকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন এবং কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে দেশের কৃষকরা প্রতি বছর প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ সাশ্রয় করতে সক্ষম হবেন, যা তাদের উৎপাদন খরচ কমিয়ে আয় বাড়াবে। ইউরিয়া সাশ্রয়ের মাধ্যমে সার ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্য বজায় থাকবে এবং আমদানির উপর নির্ভরশীলতা কমবে। এই যন্ত্রের ব্যবহার নাইট্রাস অক্সাইড (NO2) নির্গমন কমাতে সহায়ক, যা পরিবেশ দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব কমানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। একইসাথে এই প্রযুক্তি ফসলের পুষ্টিগুণ বাড়ায়, যা দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় সহায়ক ভূমিকা রাখে।

ব্রি উদ্ভাবিত দানাদার ইউরিয়া সার প্রয়োগ যন্ত্রটি সহজেই পরিচালনা করা যায় এবং অধিকাংশ কৃষকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে। এর দাম প্রায় ১০,০০০ টাকা, যা এককালীন বিনিয়োগ হিসেবে কৃষকের জন্য দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক। এটি দুটি স্কিড, একটি ফারো ওপেনার, দুটি সিলিন্ড্রিক্যাল হপার, একটি মিটারিং ডিভাইস এবং একটি ড্রাইভ হুইল নিয়ে গঠিত। মূলত পিভিসি এবং মাইল্ড স্টিলের তৈরি এই যন্ত্রটির কার্যক্ষমতা প্রতি ঘণ্টায় ১ বিঘা জমি আচ্ছাদন করতে সক্ষম, এবং এটি প্রায় ৯৮ শতাংশ দক্ষতায় কাজ করে।

এছাড়াও এই প্রযুক্তি বাংলাদেশের কৃষকদের সাশ্রয়ী ও টেকসই কৃষি পদ্ধতিতে অভ্যস্ত করতে সহায়ক হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, কৃষকের মুনাফা বৃদ্ধি, এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এনসিসি ব্যাংকের এই উদ্যোগ দেশের কৃষি উন্নয়নে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। "দানাদার ইউরিয়া সার প্রয়োগ যন্ত্র" কেবল সারের অপচয় রোধ নয়, বরং পরিবেশের সুরক্ষা এবং খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে এক কার্যকরী প্রযুক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।