রোটারিয়ান ড. মো. হেমায়েতুল ইসলাম আরিফঃ জলাতঙ্ক বা র্যাবিস তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে একটি মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা এবং উদ্বেগের অন্যতম কারণ। বাংলাদেশেও র্যাবিস একটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা, এবং এটি সাধারণত কুকুরের কামড়ের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়। র্যাবিস ভাইরাসটি প্রাণীদের, বিশেষত কুকুর, বিড়াল, শিয়াল এবং বাদুড়ের মধ্যে পাওয়া যায় এবং যখন একটি সংক্রমিত প্রাণী কাউকে কামড়ায় বা চাটে, তখন ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে।
জলাতঙ্ক: একটি গুরুতর ও প্রতিরোধযোগ্য রোগ
জলাতঙ্ক হলো এক প্রকার ভাইরাসজনিত সংক্রমণ, যা মূলত পশু কামড়ের মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করে এবং প্রায় শতভাগ মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায় যদি সঠিক সময়ে চিকিৎসা করা না হয়। প্রতি বছর প্রায় ৬০,০০০ মানুষ জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারায়, এবং এর বেশিরভাগই ঘটে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে, যেখানে স্বাস্থ্যসেবা ও প্রতিরোধমূলক ভ্যাকসিন সহজলভ্য নয়। যদিও এটি সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধযোগ্য একটি রোগ, তথাপি সচেতনতার অভাব এবং সীমিত সম্পদের কারণে এর নির্মূলের পথে বড় বাধা রয়ে গেছে।
বাংলাদেশের র্যাবিসের বর্তমান পরিস্থিতি:
রোগের বিস্তার: বাংলাদেশে র্যাবিস মূলত কুকুরের মাধ্যমে ছড়ায়। শহর এবং গ্রাম উভয় এলাকাতেই কুকুরের মাধ্যমে এই রোগের বিস্তার ঘটে। প্রতি বছর প্রায় ২০০,০০০ মানুষ কুকুরের কামড়ের শিকার হয় এবং তাদের মধ্যে অনেকেই র্যাবিসের ঝুঁকিতে থাকে।
মৃত্যুর হার: প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ২,০০০ থেকে ২,৫০০ জন র্যাবিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। যদিও এই সংখ্যা বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হতে পারে, তবুও এটি জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয়।
প্রতিরোধ ও চিকিৎসা: বাংলাদেশ সরকার ও বিভিন্ন এনজিও র্যাবিস প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে কুকুরের ভ্যাক্সিনেশন ক্যাম্পেইন, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং কামড়ের পর দ্রুত চিকিৎসা প্রদান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্যও নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, যেমন কুকুরদের ধরার অভিযান এবং তাদের নিরপেক্ষকরণ।
বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর ২৮ সেপ্টেম্বর পালিত হয় বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস। এটি সেই দিন, যখন সমাজের সব স্তরের মানুষকে জলাতঙ্ক নির্মূলে একত্রিত করা হয় এবং রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এবারের বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবসের থিম হলো "রেবিস সীমানা ভেঙ্গে ফেলা বা উত্তরণ," যা মূলত রোগটির নির্মূলের পথে দাঁড়িয়ে থাকা বাধাগুলি দূর করার লক্ষ্যে তৈরি হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ফাঁক
জলাতঙ্ক নির্মূলের একটি প্রধান বাধা হলো আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অভাব। যদিও অনেক দেশেই জলাতঙ্কের প্রকোপ রয়েছে, তবে তাদের মধ্যে সহযোগিতার পরিমাণ অনেকটাই কম। এক দেশ থেকে আরেক দেশে জলাতঙ্কের সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি থাকার পরও যথাযথ আন্তর্জাতিক সমন্বয় ও সহযোগিতা অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় না। সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সংস্থা এবং সরকারগুলো একসাথে কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছে, যা এই সমস্যার সমাধানে নতুন পথ খুলে দিয়েছে। এই সম্মিলিত উদ্যোগগুলোই জলাতঙ্ক নির্মূলের প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠছে।
প্রয়োজনীয় সংস্থানগুলিতে অ্যাক্সেসের অভাব
জলাতঙ্ক নির্মূলে সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি হলো গুণমানসম্পন্ন ভ্যাকসিন এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সংস্থানের অভাব। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভ্যাকসিন এবং পশুদের টিকা দেওয়ার উপকরণ প্রায়ই পাওয়া যায় না। সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে চিকিৎসা ও ভ্যাকসিনেশনের অভাবের কারণে জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। এজন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং দাতা সংস্থাগুলো একত্রে কাজ করে সাশ্রয়ী মূল্যে গুণমানসম্পন্ন ভ্যাকসিন সরবরাহ এবং সংক্রমণ প্রতিরোধের ব্যবস্থা করেছে।
জনসাধারণের সীমিত জ্ঞান
জলাতঙ্ক সম্পর্কে সচেতনতার অভাবও একটি বড় বাধা। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় বা পশুপালনকারী সম্প্রদায়গুলির মধ্যে এই রোগ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান নেই। অনেকেই জানেন না কীভাবে জলাতঙ্ক প্রতিরোধ করতে হয় বা কামড়ানোর পরে কী ব্যবস্থা নিতে হবে। এই কারণে, রোগটি অনেক ক্ষেত্রে মারাত্মক আকার ধারণ করে। এই অবস্থার উত্তরণে স্কুল, কমিউনিটি সেন্টার, এবং স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলিতে সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। মিডিয়া এবং সামাজিক মাধ্যমের মাধ্যমেও ব্যাপক প্রচারনা চালানো হচ্ছে, যার ফলে ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে।
র্যাবিস তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে একটি বড় উদ্বেগের কারণ, এবং এই সমস্যার সমাধান করতে হলে আরও কার্যকরী স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, এবং ভ্যাকসিন সরবরাহের উন্নয়ন প্রয়োজন। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই রোগের প্রকোপ কমিয়ে আনা সম্ভব এর কারণগুলো নিম্নে ব্যাখ্যা করা হলো:
উচ্চ সংক্রমণের হার:
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে, বিশেষ করে আফ্রিকা ও এশিয়ার কিছু দেশে, র্যাবিসের সংক্রমণের হার অনেক বেশি। কুকুরের মাধ্যমে রোগটির বিস্তার সাধারণত ঘটে, এবং এই অঞ্চলে ঘুরে বেড়ানো কুকুরের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় সংক্রমণের ঝুঁকি আরো বেড়ে যায়।
স্বাস্থ্যসেবা এবং সচেতনতার অভাব:
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে স্বাস্থ্যসেবা এবং সচেতনতার অভাবের কারণে জলাতঙ্কের প্রতিরোধ ও চিকিৎসা কার্যকরভাবে করা সম্ভব হয় না। অনেক মানুষ কুকুরের কামড়ের পরে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসা নেয় না বা র্যাবিস ভ্যাকসিন গ্রহণ করে না, যা মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
অপ্রতুল ভ্যাকসিন সরবরাহ:
এই দেশগুলোতে র্যাবিস প্রতিরোধের জন্য ভ্যাকসিন সহজলভ্য নয় বা পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই। অনেক ক্ষেত্রেই ভ্যাকসিনের মূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থাকে, যা রোগের বিস্তার রোধে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
পশুদের টিকাদান কার্যক্রমের সীমাবদ্ধতা:
পশুদের মধ্যে, বিশেষ করে কুকুরদের মধ্যে, র্যাবিস প্রতিরোধে টিকাদান কার্যক্রম তেমনভাবে পরিচালিত হয় না বা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। এর ফলে পশুদের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে র্যাবিস সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে।
বৈষম্যপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো:
তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো অপ্রতুল এবং অসম, যা বিশেষ করে গ্রামীণ এবং প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে র্যাবিসের চিকিৎসা পাওয়াকে আরও কঠিন করে তোলে।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব:
র্যাবিসের কারণে মানুষজনের মৃত্যু ও রোগগ্রস্ত হওয়া কেবল ব্যক্তিগত ক্ষতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর মাধ্যমে সমাজ ও দেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব পড়ে। যেসব পরিবারে একজন র্যাবিসে আক্রান্ত হয়, তারা মানসিক, শারীরিক, এবং আর্থিক চাপের মধ্যে পড়ে, যা তাদের জীবনের মানকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।
জলাতঙ্ক প্রতিরোধযোগ্য একটি রোগ, কিন্তু এটি মোকাবিলায় প্রয়োজন করোনার মতো বিশ্বব্যাপী উদ্যোগ। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, সঠিক সম্পদের ব্যবহার, এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জলাতঙ্কের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সময় এসেছে বিশ্বকে একত্রিত হওয়ার এবং জলাতঙ্ক নির্মূলের পথে আরও জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার, যেন ভবিষ্যতে আর কোনো মানুষ এই রোগের কারণে প্রাণ হারাতে না হয়।
লেখকঃ ডেপুটি চিফ ভেটেরিনারিয়ান, ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, এবং সভাপতি (২০২৩-২৪), রোটারি ক্লাব অফ রাজশাহী সেন্ট্রাল; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ লাইভস্টক সোসাইটি (বিএলএস), যুগ্ম নির্বাহী সম্পাদক (বাংলাদেশ লাইভস্টক জার্নাল; ISSN 2409-7691), সম্পাদক সুজন, (রাজশাহী মেট্রোপলিটন), সভাপতি, বিবিসিএফ, রাজশাহী ও সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দলোন (বাপা), রাজশাহী।