দক্ষিণ এশিয়া ও বাংলাদেশের জন্য ডিভিএম ও এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি সমন্বিত ডিগ্রি: একটি সম্ভাবনাময় পথ

রোটারিয়ান ড. মো. হেমায়েতুল ইসলাম আরিফ:প্রাণিসম্পদ খাত দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে বাংলাদেশের অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা ও গ্রামীণ জীবিকায় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, প্রাণিজ আমিষের চাহিদা বৃদ্ধি, প্রাণিজ রোগের নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় প্রয়োজন দক্ষ ও বহুমুখী পেশাদারদের। এই প্রেক্ষাপটে, ডক্টর অফ ভেটেরিনারি মেডিসিন (ডিভিএম) এবং এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি (এএইচ) এর সমন্বয়ে গড়ে উঠা ডিগ্রি প্রোগ্রামগুলো বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি অত্যন্ত উপযোগী ও সম্ভাবনাময় মডেল হতে পারে, যার যৌক্তিকতা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট: সমন্বিত ডিগ্রির সফলতা

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে ভেটেরিনারি শিক্ষায় সমন্বিত বা কম্বাইন্ড ডিগ্রির ধারণা নতুন নয় এবং এর সাফল্য সুপ্রতিষ্ঠিত:

  1. যুক্তরাষ্ট্র (USA):অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএস/ডিভিএম এর মতো সমন্বিত প্রোগ্রাম (যেমন ফেয়ারলেই ডিকিনসন ইউনিভার্সিটি ও রস ইউনিভার্সিটির উদাহরণ) রয়েছে। এগুলো শিক্ষার্থীদেরকে প্রাণিবিজ্ঞানের মৌলিক জ্ঞানের পাশাপাশি ভেটেরিনারি মেডিসিনের ক্লিনিক্যাল দক্ষতায় পারদর্শী করে তোলে।
  2. যুক্তরাজ্য (UK):রয়্যাল ভেটেরিনারি কলেজ (আরভিসি)-এর বিভেটমেড (BVetMed) প্রোগ্রামটি ভেটেরিনারি মেডিসিনে একটি অত্যন্ত সম্মানিত ডিগ্রি, যা গভীর তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ প্রদান করে।
  3. অস্ট্রেলিয়া (Australia):চার্লস স্টার্ট ইউনিভার্সিটি ব্যাচেলর অফ ভেটেরিনারি বায়োলজি/ব্যাচেলর অফ ভেটেরিনারি সায়েন্স নামে একটি উল্লেখযোগ্য সমন্বিত ডিগ্রি অফার করে। এই প্রোগ্রামের মূল শক্তি হলো এটি ভেটেরিনারি জীববিজ্ঞান এবং ভেটেরিনারি বিজ্ঞানের জ্ঞানকে একীভূত করে, যা শুধু অস্ট্রেলিয়ায় নয়, বিশ্বব্যাপী পেশাদারিত্বের জন্য প্রস্তুত করে।
  4. পোল্যান্ড, সাইপ্রাস:এইসব দেশেও ডিভিএম ও সমন্বিত প্রোগ্রামের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানের ভেটেরিনারি শিক্ষা দেওয়া হয়।

সমন্বিত ডিগ্রির সুবিধাসমূহ: বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ

বিশ্বজুড়ে সমন্বিত ডিভিএম/এএইচ ডিগ্রিগুলোর স্বীকৃত প্রধান সুবিধাগুলো দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক:

  1. ব্যাপক সমন্বিত জ্ঞানভিত্তি (Broader & Integrated Knowledge Base):এ ধরনের ডিগ্রি শুধু প্রাণীর রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা (ডিভিএম এর মূল ফোকাস) নয়, বরং প্রাণী উৎপাদন, পুষ্টি, প্রজনন, জেনেটিক্স, কল্যাণ এবং খামার ব্যবস্থাপনার (এএইচ এর মূল ফোকাস) উপরও সমান গুরুত্ব দেয়। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে বেশিরভাগ প্রাণীসম্পদ ছোট ও মাঝারি খামার এবং গৃহপালিত পশুর উপর নির্ভরশীল, সেখানে উৎপাদন বৃদ্ধি ও রোগ নিয়ন্ত্রণ সমানভাবে জরুরি। সমন্বিত জ্ঞান একজন পেশাদারকে খামারি পর্যায়ে সমগ্র প্রাণিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম করে।
  2. বহুমুখী কর্মসংস্থানের সুযোগ (Enhanced & Versatile Career Opportunities):সমন্বিত ডিগ্রিধারী গ্র্যাজুয়েটরা শুধু ক্লিনিক্যাল ভেটেরিনারিয়ান হিসেবেই নয়, বরং আরও বিস্তৃত ক্ষেত্রে কাজ করতে পারেন:
    • প্রাণী উৎপাদন খামার ব্যবস্থাপনা:ডেইরি, পোল্ট্রি, অন্যান্য  প্রাণী ফার্মের টেকনিক্যাল ম্যানেজার, নিউট্রিশনিস্ট, ব্রিডিং বিশেষজ্ঞ।
    • খাদ্য নিরাপত্তা গুণগত মান নিশ্চিতকরণ:মাংস, দুধ, ডিম প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে কোয়ালিটি কন্ট্রোল অফিসার।
    • ফার্মাসিউটিক্যালস ফিড ইন্ডাস্ট্রি:প্রাণীচিকিৎসা ওষুধ, ভ্যাকসিন, প্রাণীখাদ্য উৎপাদন ও বিপণন।
    • গবেষণা উন্নয়ন:কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিএলআরআই, সেফড), আন্তর্জাতিক সংস্থা (ফাও, আইএলআরআই)।
    • সরকারি পরিষেবা:প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগে প্রাণী স্বাস্থ্য ও উৎপাদন নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়ন।
    • এনজিও উন্নয়ন প্রকল্প:প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনমূলক কর্মসূচি।
  3. উন্নত ব্যবহারিক দক্ষতা (Improved Practical Skillset):সমন্বিত কারিকুলামে প্রাণীর স্বাস্থ্য ও রোগ নির্ণয়ের পাশাপাশি খামার ব্যবস্থাপনা, উৎপাদন কৌশল এবং অর্থনৈতিক দিকগুলোর উপর হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের সুযোগ থাকে। এতে করে গ্র্যাজুয়েটরা বাস্তব সমস্যা সমাধানে আরও কার্যকর ও সৃজনশীল হয়ে ওঠেন।
  4. বিশেষজ্ঞতার জন্য মজবুত ভিত্তি (Stronger Foundation for Specialization):প্রাণী স্বাস্থ্য ও উৎপাদনের উভয় ক্ষেত্রের মৌলিক জ্ঞান বিশেষায়িত ক্ষেত্রে (যেমন: পোল্ট্রি হেলথ ম্যানেজমেন্ট, ডেইরি সায়েন্স, পশু পুষ্টি, এপিডেমিওলজি) উচ্চতর পড়াশোনা বা গবেষণার জন্য একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি করে।
  5. পরিবর্তনশীল চাহিদার সাথে খাপ খাওয়ানোর সক্ষমতা (Adaptability to Evolving Needs):জলবায়ু পরিবর্তন, নতুন রোগের উত্থান (জুনোটিক), ভোক্তার চাহিদা পরিবর্তন – এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সমালোচনামূলক চিন্তা, সমস্যা সমাধান এবং স্ব-নির্দেশিত শিক্ষার দক্ষতা অর্জন করা অপরিহার্য। সমন্বিত ডিগ্রি প্রোগ্রামগুলো এই দক্ষতাগুলো বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা সমন্বিত ডিগ্রির প্রাসঙ্গিকতা:

বাংলাদেশে প্রাথমিকভাবে ডক্টর অফ ভেটেরিনারি মেডিসিন (ডিভিএম) ডিগ্রিই ভেটেরিনারি চিকিৎসক হওয়ার প্রধান ও স্বীকৃত পথ (বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়-বাউ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-হস্তি, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়-চিভাসু প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে এটি পড়ানো হয়)। এটি ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিস, সার্জারি এবং রোগ নির্ণয় ও প্রতিরোধে বিশেষজ্ঞ করে তোলে। অন্যদিকে, এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি (এএইচ) প্রোগ্রাম (যেমন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়-সাভিতে B.Sc. in Veterinary Science & Animal Husbandry) প্রাণী উৎপাদন, পুষ্টি ও ব্যবস্থাপনায় গভীর জ্ঞান প্রদান করে, তবে ক্লিনিক্যাল ট্রেনিং সীমিত।

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার জন্য সমন্বিত মডেল কেন জরুরি?

  1. খামারি পর্যায়ের বাস্তবতা:বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ খাতের বেশিরভাগই ছোট ও প্রান্তিক খামারি দ্বারা পরিচালিত। তাদের কাছে আলাদা করে ভেটেরিনারিয়ান এবং প্রাণী উৎপাদন বিশেষজ্ঞ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। একজন সমন্বিত জ্ঞানসম্পন্ন পেশাদার ("ভেটেরিনারি এন্ড এনিম্যাল সায়েন্টিস্ট") একাই প্রাণীর অসুখের চিকিৎসা, সঠিক খাদ্য ব্যবস্থাপনা, উন্নত প্রজনন কৌশল এবং খামারের লাভজনকতা বাড়ানোর পরামর্শ দিতে পারেন – যা খামারিদের জ্ন্য  একক ও কার্যকর সমাধান।
  2. খাদ্য নিরাপত্তা উৎপাদন বৃদ্ধি:ক্রমবর্ধমান প্রাণিজ আমিষের চাহিদা মেটাতে উৎপাদন বাড়ানো জরুরি। উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ (যা উৎপাদনশীলতা হ্রাসের বড় কারণ) নিশ্চিত করতে সমন্বিত জ্ঞান অপরিহার্য। টিকাদান, বায়োসিকিউরিটি ও ভালো খামার ব্যবস্থাপনা একসাথে মিলেই উৎপাদন বাড়াতে পারে।
  3. জুনোটিক রোগ জনস্বাস্থ্য:প্রাণীজ রোগ (যেমন বার্ড ফ্লু, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা, অ্যানথ্রাক্স) অনেক সময় মানুষের মধ্যে ছড়ায়। প্রাণী স্বাস্থ্য ও উৎপাদন ব্যবস্থার সমন্বিত জ্ঞান এই রোগগুলোর প্রাদুর্ভাব শনাক্তকরণ, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে ভেটেরিনারি সার্ভিসেসকে আরও কার্যকর করতে সাহায্য করবে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
  4. কর্মসংস্থানের বিস্তৃতি:বেসরকারি খাতে, বিশেষ করে বাণিজ্যিক পোল্ট্রি, ডেইরি ও ফিড ইন্ডাস্ট্রিতে, সমন্বিত জ্ঞানসম্পন্ন পেশাদারদের চাহিদা ব্যাপক। সরকারি খাতেও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মতো প্রতিষ্ঠানে এই ডিগ্রিধারীরা প্রাণী স্বাস্থ্য ও উৎপাদন উভয় ক্ষেত্রেই অবদান রাখতে পারবেন।
  5. গবেষণার নতুন দিগন্ত:সমন্বিত পদ্ধতিতে গবেষণা (যেমন: রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রাণীর জাত উন্নয়ন, জলবায়ুসহিষ্ণু প্রাণী খাদ্য, টেকসই খামার মডেল) বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অধিক ফলপ্রসূ হবে।

সমন্বিত ডিগ্রির দিকে এগিয়ে যাওয়া:

বাংলাদেশে ইতিমধ্যে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের  B.Sc. in Veterinary Science and Animal Husbandry (B.Sc. Vet. Sci. & A.H.) প্রোগ্রামটি সমন্বিত ডিগ্রির একটি প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। এই মডেলটিকে আরও শক্তিশালী করে, আন্তর্জাতিক মানের (যেমন চার্লস স্টার্ট বা আরভিসির মডেলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ) কারিকুলাম উন্নয়ন, পর্যাপ্ত ব্যবহারিক সুযোগ সৃষ্টি এবং শিক্ষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এটি একটি আদর্শ সমন্বিত প্রোগ্রামে রূপান্তরিত করা যেতে পারে। অন্যান্য কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এই ধরণের প্রোগ্রাম চালু বা বিদ্যমান প্রোগ্রামগুলোকে সমন্বিত করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

উপসংহার:

বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রাণিসম্পদ খাতের বহুমুখী চাহিদা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, প্রাণীজ রোগ নিয়ন্ত্রণ, খামারি আয় বৃদ্ধি এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা পূরণে শুধুমাত্র ক্লিনিক্যাল ডিভিএম বা শুধু এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি ডিগ্রি যথেষ্ট নয়। ডিভিএম এবং এনিম্যাল হাজবেন্ড্রির সমন্বয়ে গড়ে উঠা ডিগ্রি প্রোগ্রামই হতে পারে টেকসই সমাধানের চাবিকাঠি। বৈশ্বিক সাফল্য এই মডেলের কার্যকারিতার প্রমাণ। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান প্রোগ্রামকে রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করে, প্রয়োজনীয় সংস্কার ও আন্তর্জাতিক মানের সাথে সঙ্গতি রেখে জাতীয় পর্যায়ে শক্তিশালী সমন্বিত ডিগ্রি প্রোগ্রাম চালু করা এখন সময়ের দাবি। এটি একদিকে যেমন দক্ষ ও বহুমুখী পেশাদার তৈরি করবে, অন্যদিকে তেমনি দেশের প্রাণিসম্পদ খাতের টেকসই উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের জন্যও এই মডেল অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং অনুসরণীয় হতে পারে।

লেখক:ডিভি এম; এম এস ও পি এইচ ডি
সাধারন সম্পাদক, বাংলাদেশ লাইভস্টক সোসাইটি (বিএল এস)
যোগাযোগঃ This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ; 01913243767