ডা. মো মুস্তাফিজুর রহমান পাপ্পু: পৃথিবীর যে কয়েকটি প্রাচীন শহর রয়েছে তন্মধ্যে তুরষ্কের ইস্তানবুল শহর অন্যতম। এই শহরটি সম্পর্কে জানাশোনা আমার অনেক বছরের। প্রায় এক যুগ আগে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একবার তুরষ্কে যাওয়ার সুযোগ পেয়েও নানা জটিলতায় যেতে পারি নাই। সেই দিন থেকে মনের মধ্যে ইস্তানবুল, আংকারা শহর ঘুরে দেখার ইচ্ছে ছিল। মহান আল্লাহ অবশেষে সেই স্বপ্ন পুরন করার তৌফিক দিয়েছেন এবার। পবিত্র ঈদুল ফিতরে মায়ামী থেকে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম এবং টার্কিশ এয়ারলাইন্সে টিকিট কেটে ৩ মে ঢাকা থেকে ফেরার পথে প্রায় ১৩ ঘন্টা যাত্রা বিরতি নিয়েছিলাম ইস্তানবুল এয়ারপোর্টে। এই সুযোগে এই শহরটিকে একটূ ঘুরে দেখলাম। এই দিনব্যাপি ঘোরাঘুরির অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে তুলে ধরবো।
ইতিহাসঃ খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতাব্দীতে শহরটি মেগারা থেকে আগত গ্রীক বসতি স্থাপনকারীরা বাইজান্টিয়াম নামে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে, রোমান সম্রাট কনস্টানটাইন দ্য গ্রেট এটিকে তার সাম্রাজ্যের রাজধানী করেন, প্রথমে এটিকে নতুন রোম এবং তারপর নিজের নাম অনুসারে কনস্টান্টিনোপল (কনস্টান্টিনোপলিস) নামকরণ করেন। এরপর ধারাবাহিকভাবে শহরটি বিস্তৃতি লাভ করে ও প্রভাব বৃদ্ধি পায়, সেইসাথে সিল্ক রোডের এবং ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর হয়ে ওঠে।
শহরটি প্রায় ১৬০০ বছরের বেশি সময় একাধারে রোমান/বাইজান্টাইন (৩৩০-১২০৪), ল্যাটিন (১২০৪-১২৬১), শেষ বাইজেন্টাইন (১২৬১-১৪৫৩), এবং অটোমান (১৪৫৩-১৯২২) সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিনোপল পতনের মাধ্যমে উসমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত রোমান/বাইজেন্টাইন সময়ে খ্রিস্টধর্মের অগ্রগতিতে এই শহরটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯২৩ সালে তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর দেশটির রাজধানী আঙ্কারায় স্থানান্তরিত করা হয়। যদিও আঙ্কারা শহরটি তুরস্কের প্রশাসনিক রাজধানী হলেও ইস্তাম্বুল আজও দেশটির ইতিহাস, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির মূল কেন্দ্র। ১৯৩০ সালে, শহরটির নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ইস্তাম্বুল রাখা হয়, যা এগারো শতক থেকে গ্রীক ভাষাভাষীরা কথোপকথনে শহরটিকে বোঝাতে ব্যবহার করত। সুত্রঃ উকিপিডিয়া
ই ভিসাঃ যাদের ইতিমধ্যে সেনজেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ডের ভিসা আছে তারাই এই ওয়েবসাইটে https://www.evisa.gov.tr/en/) গিয়ে ৬০ ডলার পরিশোধ করে খুব সহজেই ই ভিসা নিতে পারবেন। অথবা শুধুমাত্র ক্যাশ দিয়ে ইস্তানবুল এয়ারপোর্ট থেকেও নিতে পারবেন। আমি বাংলাদেশে থাকাকালীন ই- ভিসা করে নিয়েছিলাম, যার মেয়াদ ৬ মাস পর্যন্ত ছিল।
টার্কিশ এয়ারলাইন্সের যে সকল যাত্রীর যাত্রাবিরতি ৬-২৪ ঘন্টার মধ্যে তাদের জন্য কমপ্লিমেন্টরি ট্যুর ইস্তানবুল নামে একটি প্যাকেজ আছে। আমি এই প্যাকেজ নিয়েছিলাম। বিকাল ৪ টা থেকে রাত ৯ ৩০ মিনিট পর্যন্ত ঘুরে বেড়িয়েছি ইস্তানবুল শহর।
একজন দক্ষ গাইড আমাদের সবাইকে নিয়ে একটি বাসে করে রওয়ানা দেই। ৪০-৫০ জনের একটা গ্রুপ হয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে তানজিম নামে এক বাংলাদেশী ভাইকে পেয়েছিলাম। উনি জার্মানি থাকেন। যাই হোক আমাদের বহনকারি বাস ৪০ মিনিট পর ইস্তানবুল শহরে পৌছায়। পতিমধ্যে আমাদের গাইড মি ওকান বিভিন্ন ইতিহাস সম্পর্কে বর্ননা দেন। ইস্তানবুলের ঘর বাড়ি গুলা মোটামুটি একই ডিজাইনের। এটা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
বাস থেকে নেমে আমরা প্রথমে ইস্তানবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে যাই। আঠারশ’ শতাব্দীতে অটোম্যান সাম্যাজ্যের সময়ে নির্মিত মসজিদ নুরুওসমানিয়ে মসজিদ। মসজিদের নির্মান শৈলী মুগ্ধ করবে সবাইকে। মার্বেল পাথরের কি নিখুত গাথুনি। মসজিদে যখন প্রবেশ করি তখন আছরের ওয়াক্ত, তাই এই সুযোগে ঐতিহাসিক এই মসজিদে দুই রাকআত কছরের নামাজ আদায় করলাম। নামাজ পড়ে দেখি আমার গ্রুপের সবাই চলে গেছে, কারন নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে আমি ২ মিনিট পরে এসেছিলাম। আমার কাছে কোন মোবাইল নেটওয়ার্ক ছিল না। আল্লাহর রহমতে দুই টার্কিশ যুবক আমাদের সাহায্য করেছিল।
আমি গ্রান্ড বাজারের গিয়ে গ্রুপের পুনরায় যুক্ত হই। গ্রান্ড বাজার মুলত আমাদের দেশের গুলিস্তান মার্কেটের মত। কি নাই এখানে, গার্মেন্টস, জুয়েলারি, জুতা সহ নিত্য প্রয়োজনীয় সকল পন্যের ই দোকান রয়েছে। সবচেয়ে বেশী চোখে পড়লো মিষ্টির দোকান। বাহারি রকমের মিষ্টান্ন। এখানকার ব্যবসায়ীরা অনেক ধুর্ত মনে হল। তাই সাবধান। প্রায় ৬০০ বছরের পুরাতন এই মার্কেট। এই বাজারের দোকানী বাদে বাকি সবাই টুরিস্ট ই মনে হল।
বাজার ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে চলে গেলাম ডিনারে। বিখ্যাত টার্কিশ কাবাব দিয়ে ডিনার শুরু করলাম। সাথে ছিল পাউরুটি, ভাত, সালাদ, স্পেশাল পানীয়, চাটনি। ডিনার শেষ করে আবার ইস্তানবুলের রাস্তায় বের হলাম। এত মানুষ, আমার মনে হয়েছে আমি ঢাকার গুলিস্তানেই আছি। আমাদের এবারের গন্তব্য ৬ শত বছরের পুরনো স্থাপনা থিও ডিওসিয়াস এর ওবেলিস্ক। এখানে কিছু ছবি তুলতে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হল। এই স্থাপনার পাশেই অবস্থিত বিখ্যাত ব্ল মসজিদ। এটাকে অনেকে সুলতান আহমেদ মসজিদ নামে চিনে। অটোম্যান সামাজ্যের সময়ে ১৬০৯-১৭ সালের মদ্যে আহমেদ-১ এটি নির্মাণ করেন। আমরা যখন এই মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করি তখন মাগরিবের ওয়াক্ত শুরু হল। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হল। মসজিদের ভেতরের কারুকার্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর। প্রায় ১০ হাজার মুসল্লি একসাথে এই মসজিদে নামাজ আদায় করতে পারেন। রাতের মসজিদের লাইট গুলো যখন জ্বালানো হল, এক অন্যরকম দেখতে লাগছিল।
সুলতান আহমেদ মসজিদের পাশেই অবস্থিত আরেক বিখ্যাত আয়া সোফিয়া। প্রায় ১৬৬৪ বছর আগের স্থাপনা এটি। খ্রিষ্ট্রীয় ধর্মাবল্মবীরা এটাকে চার্চ হিসেবে ব্যবহার করত। সুলতান ফাতিহ সুলতান মুহাম্মদ কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পর স্থাপনাটি মসজিদে রূপান্তর করেন। ৩১ মার্চ ২০১৮, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রেজেপ তাইয়িপ এরদোয়ান কুরআন তিলাওয়াত করে ফতেহ সুলতান মুহাম্মদসহ আয়া সোফিয়ার জন্য কাজ করা সকলের রহুের মাগফেরাতে মোনাজাত করেন।[২৪] এবং ১০ জুলাই ২০২০ সালের রোজ শুক্রবার তুরস্কের শীর্ষআদালত এটাকে পুনরায় মসজিদে রূপান্তরের রায় ঘোষণা করেন। আদালতের রায়ের পর মসজিদে আজান দেওয়া হয়েছে যা প্রায় ৮৬ বছর পর।
দেখতে দেখতে কখন যে সময় শেষ হয়ে রাত হয়ে গেল টের ই পেলাম না। ইস্তানবুল থেকে এয়ারপোর্টে ফেরার পথে বসফরাস সেতু দেখলাম যা এশিয়া আর ইউরোপ মহাদেশ কে যুক্ত করেছে। পরিশেষে যারা টার্কিশ এয়ারলাইন্সে ভ্রমন করেন, ইচ্ছা করলে এই ট্যুর ইস্তানবুল প্যাকেজ আপনারাও উপভোগ করতে পারেন। যাই হোক সংক্ষিপ্ত এই সফরে অনেক অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরলাম। ইনশাল্লাহ আবার দেখা হবে ইস্তানবুল ।
লেখকঃ সাধারন সম্পাদক
আটলান্টিস বিশ্ববিদ্যালয় স্টুডেন্টস লাইফ অর্গানাজেশন, মায়ামি, ফ্লোরিডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।