
প্রফেসর ড. মোঃ আলিমুল ইসলাম: বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত, নারী স্বাধীনতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক অনন্য নাম। বাঙালি মুসলিম সমাজে নারী অধিকারের দাবি তুলে ধরার প্রথম কন্ঠস্বর ছিলেন বেগম রোকেয়া। তিনি বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে যে দৃষ্টিভঙ্গি, সাহস ও প্রগতিশীল চিন্তার পরিচয় দিয়েছেন, তা আজও আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। সমাজের গোঁড়ামি, অশিক্ষা ও নারীর প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁর নিরলস সংগ্রাম আমাদের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের পায়রাবন্দে জন্ম নেওয়া বেগম রোকেয়া সমাজের বহু সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে নিজের আলোয় আলোকিত হয়েছেন। গোপনে বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস ও বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর মতো নানা ধারার সাহিত্যচর্চাসহ সকল ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন পথিকৃত। তাঁর রচনায় নারীশিক্ষা, ক্ষমতায়ন ও মানবিক সমাজ গঠনের যে আহ্বান প্রতিফলিত হয়েছে, তা আজও সমান গুরুত্বপূর্ণ। মানবসভ্যতার ইতিহাসে যাঁরা সত্যিকার অর্থে প্রগতির পথ নির্মাণ করেছেন, তাঁদের প্রত্যেককেই সমকালীন সামাজিক ও ধর্মীয় গোঁড়ামির অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে আসতে হয়েছে দুঃসাহসিক মনোভাব নিয়ে।
বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়াও ছিলেন এমনই এক আলোকবর্তিকা, যিনি বুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও সর্বজনীন কল্যাণের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বহু বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করেছেন। সমাজসংস্কারক, শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক হিসেবে বেগম রোকেয়া ছিলেন অসামান্য কর্মনিষ্ঠ, আদর্শনিষ্ঠ ও তিতিক্ষাশী এক মহিয়সী ব্যক্তিত্ব। তাঁর দূরদৃষ্টি, মানবিকতা, সহনশীলতা, দৃঢ়তা এবং পরার্থপরতা আমাদের সমাজকে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। নারীশিক্ষা, ক্ষমতায়ন ও সমাজে সাম্যের ধারণা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর নিরন্তর প্রচেষ্টা আজও অনুকরণীয়। তাঁর জীবনের সাহসিকতা ও অন্তর্দৃষ্টির স্বচ্ছতা আমাদের জন্য এক অমূল্য সম্পদ।
বেগম রোকেয়ার কর্ম ও দর্শন আজকের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও গবেষকদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস-যা আমাদের শিক্ষা, চিন্তা ও গবেষণাকর্মকে মানবকল্যাণের মহত্তম লক্ষ্য অর্জনে পথ দেখায়। তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা সুলতানার স্বপ্ন। এটিকে বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যের একটি মাইলফলক ধরা হয়ে থাকে। তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, মতিচুর। তার প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তিনি নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আর লিঙ্গসমতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন।
রোকেয়া দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে শিক্ষা কেবল মাত্র পড়তে-লিখতে পারার নাম নয়, প্রকৃত শিক্ষা একজন নারীকে তার অধিকার অর্জন ও স্বনির্ভর হয়ে ওঠার সক্ষমতা প্রদান করে। এই বিশ্বাস থেকেই তিনি নারীদের শিক্ষিত করতে সমাজে সচেতনতামূলক ভূমিকা পালন করেন এবং স্বামীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন “সাখাওয়াত হোসেন মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল”।
নারীমুক্তি, যুক্তিবাদ ও মানবিকতার জন্য তাঁর আজীবনের সংগ্রাম আমাদের সমাজ ও শিক্ষাঙ্গনে সমতা, ন্যায় ও প্রগতি প্রতিষ্ঠার পথে অবিচল থাকতে উদ্বুদ্ধ করে। ১৯২৬ সালে তিনি কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলার নারী শিক্ষাবিষয়ক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। নারীশিক্ষার প্রসারে বেগম রোকেয়া আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, নারীর ক্ষমতায়ন, ভোটাধিকারের জন্য লড়াইটা তিনিই প্রথম শুরু করেছিলেন।
সমাজ ও নারীর কল্যাণ সাধনে রোকেয়ার অবদান চিরস্বরণীয় হয়ে থাকবে। সমাজ ও সভ্যতার অগ্রসরতার পেছনে নারী ও পুরুষ উভয়ের ভূমিকা রয়েছে কিন্তু নারীকে পিছনে রেখে সমাজের সার্বিক অগ্রগতি যে সম্ভব নয়, তা বেগম রোকেয়া ঐ সময়ে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই রোকেয়ার সংগ্রাম ছিল পুরুষ ও নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলার জরিপে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে তাঁর স্বীকৃতি প্রমাণ করে যে তাঁর অবদান কালের সীমা অতিক্রম করে আজও সমানভাবে সমাদৃত।
বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সমাজ সংস্কারমূলক বিপ্লবী দর্শন আজও প্রাসঙ্গিক। ছাত্র-জনতার বিপ্লবে অর্জিত 2024 এর নতুন বাংলাদেশে তাঁর বৈষম্যবিরোধী চেতনার প্রতিফলন ঘটবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। বাংলাদেশের কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থায় সকল শিক্ষার্থীর মাঝে মানবিকতা ও নৈতিকতা সম্পন্ন মূল্যবোধ জাগ্রত হোক, বৈষম্যহীন হোক সমাজের প্রতিটি অঙ্গঁন এমনটিই আজ জাতির প্রত্যাশা।
























