রোটারিয়ান ড. হেমায়েতুল ইসলাম আরিফ:আগামীকাল ৮ ই মে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। প্রতি বছর ৮ ই মে থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য থ্যালাসেমিয়া দিবস পালন করা হয়। একটি বংশগত রক্তের ব্যাধি যা অস্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন উৎপাদন দ্বারা নি্র্নয় করা হয়। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের হয় হিমোগ্লোবিন তৈরি করার ক্ষমতা নেই অথবা কমে যায়, যা রক্তাল্পতা/রক্তশুন্যতা এবং অন্যান্য জটিলতার কারণ হতে পারে।
বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস-২০২৪-এর প্রতিপাদ্য বিষয় "জীবনের অগ্রগতি এবং ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে সকলের জন্য ন্যায়সঙ্গত এবং সহজলভ্য থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে "। থ্যালাসেমিয়া একটি অটোজোমাল মিউট্যান্ট প্রচ্ছন্ন জিনঘটিত বংশগত রক্তের রোগ। এই রোগে রক্তে অক্সিজেন পরিবহণকারী হিমোগ্লোবিন কণার উৎপাদনে ত্রুটি হয়। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত মানুষের রক্তে সাধারণত অক্সিজেন স্বল্পতা বা “অ্যানিমিয়া”তে ভুগে থাকেন। অ্যানিমিয়ার ফলে অবসাদগ্রস্ততা থেকে শুরু করে অঙ্গহানি ঘটতে পারে।
থ্যালাসেমিয়া প্রধানত দুই ধরনের হতে পারে: ১) আলফা থ্যালাসেমিয়া (ক.আলফা থ্যালাসেমিয়া মেজর , খ.আলফা থ্যালাসেমিয়া মাইনর) ২) বিটা থ্যালাসেমিয়া। (ক.ß থ্যালাসেমিয়া মেজর , খ. ß থ্যালাসেমিয়া মাইনর) সাধারণভাবে আলফা থ্যালাসেমিয়া, ß থ্যালাসেমিয়া থেকে কম তীব্র। আলফা থ্যালাসেমিয়া বিশিষ্ট ব্যক্তির ক্ষেত্রে রোগের উপসর্গ মৃদু বা মাঝারি প্রকৃতির হয়ে থাকে।
অন্যদিকে বিটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা বা প্রকোপ অনেক বেশি; এক-দুই বছরের শিশুর ক্ষেত্রে ঠিকমত চিকিৎসা না করলে এটি শিশুর মৃত্যুর কারণ হতে পারে। ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জিনের কারণে থ্যালাসেমিয়া হয়। বাবা অথবা মা, কিংবা বাবা-মা উভয়েরই থ্যালাসেমিয়া জিন থাকলে বংশানুক্রমে এটি সন্তানের মধ্যে ছড়ায়। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বাবা এবং মা উভয়ের থ্যালাসেমিয়া জিন থাকলে ভূমিষ্ট শিশুর শতকরা ২৫ ভাগ থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হয়।
এটি একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। যদি স্বামী-স্ত্রী দুজনই থ্যালাসেমিয়া বাহক বা একজন থ্যালাসেমিয়া বাহক এবং একজন হিমোগ্লোবিন ই এর বাহক হয় তবে প্রতি গর্ভাবস্থায় –
• এ রোগে আক্রান্ত শিশু জন্ম নেয়ার সম্ভাবনা থাকে শতকরা ২৫ ভাগ।
• বাহক শিশু জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা থাকে শতকরা ৫০ভাগ।
• আর সুস্থ শিশু জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা থাকে শতকরা ২৫ ভাগ।
স্বামী স্ত্রী দুজনের যেকোনো একজন যদি সম্পূর্ণ সুস্থ থাকেন, তাহলে নবজাতকের থ্যালাসেমিক হবার কোন সম্ভাবনা থাকে না। তবে নবজাতক থ্যালাসেমিয়ার বাহক হতে পারে যা কোন রোগ নয়। কাজেই থ্যালাসেমিয়া বংশগত রক্তের ব্যাধি- নিরাময় জোগ্য চিকিৎসা নেই। সচেতনতাই পরিত্রানের উত্তম উপায়।
থ্যালাসেমিয়া রোগির ব্যবস্থাপনার জন্য বিজ্ঞান সস্মত ১০টি বিষয় সকলের জেনে রাখা উচিত-
১. নিয়মিত রক্ত সঞ্চালন: রক্ত সঞ্চালন থ্যালাসেমিয়া রোগীদের ঘাটতিকৃত লোহিত রক্তকণিকা প্রতিস্থাপন করতে সাহায্য করে, যার ফলে টিস্যু এবং অঙ্গগুলিতে অক্সিজেন সরবরাহের উন্নতি হয়।
২. চিলেশন থেরাপি: ঘন ঘন রক্ত সঞ্চালনের কারণে শরীর মধ্যে জমাকৃত অতিরিক্ত আয়রন অপসারণের জন্য ওষুধ ব্যবহার করা হয়। উচ্চ মাত্রার আয়রন অঙ্গের ক্ষতি করতে পারে, তাই চিলেশন থেরাপি অপরিহার্য।
৩. আয়রন সমৃদ্ধ খাদ্য: আয়রন ওভারলোড থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য উদ্বেগজনক হলেও, পর্যাপ্ত হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বজায় রাখতে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ উপকারী হতে পারে। যাইহোক, থ্যালাসেমিয়া রোগীদের ব্যক্তিগত খাদ্যতালিকায় একজন চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা গুরুত্বপূর্ণ, তার পরামর্শ মত আয়রন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা উচিত।
৪. ফলিক অ্যাসিড সম্পূরক: ফলিক এসিড লোহিত রক্ত কণিকা উৎপাদনে সাহায্য করে। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের প্রায়ই লোহিত রক্তকণিকার দ্রুত টার্নওভারের কারণে ফলিক অ্যাসিডের চাহিদা বেড়ে যায়। পরিপূরক লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদনে সহায়তা করতে পারে। কজেই চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ করা উচিত।
৫. আয়রন সাপ্লিমেন্ট এড়িয়ে চলুন:আয়রন-স্বল্পতাজনিত রক্তশুন্যতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের থেকে ভিন্ন, থ্যালাসেমিয়া রোগীদের আয়রন সাপ্লিমেন্ট এড়ানো উচিত যদি না একজন চিকিৎসকের দ্বারা নির্ধারিত হয়। অতিরিক্ত আয়রন- আয়রন ওভারলোড জটিলতাকে আরও খারাপ করতে পারে।
৬. নিয়মিত পর্যবেক্ষণ: হিমোগ্লোবিনের মাত্রা, আয়রনের মাত্রা এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য স্বাস্থ্যসেবা চিকিৎসকের সাথে নিয়মিত চেক-আপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি সময়মত হস্তক্ষেপ এবং প্রয়োজন অনুসারে চিকিত্সা পরিকল্পনাগুলির সমন্বয় করতে সহায়তা করে।
৭. হাইড্রেশন: হাইড্রেটেড থাকা প্রত্যেকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তবে বিশেষ করে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য অতিব জরুরী। এটি রক্তের পরিমাণ বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং ডিহাইড্রেশন সম্পর্কিত জটিলতা প্রতিরোধ করে, যেমন রক্তের সান্দ্রতা বৃদ্ধি।
৮. সংক্রমণ এড়ানো: থ্যালাসেমিয়া রোগীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হওয়ার কারণে সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে। ভাল স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলন করা, সুপারিশ অনুযায়ী টিকা নেওয়া এবং অসুস্থ ব্যক্তিদের এড়ানো সংক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে।
৯. জেনেটিক কাউন্সেলিং: থ্যালাসেমিয়া একটি জেনেটিক ডিসঅর্ডার, তাই জেনেটিক কাউন্সেলিং ব্যক্তিদের তাদের সন্তানদের কাছে এই অবস্থার সংক্রমণের ঝুঁকি বুঝতে এবং পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে সচেতন তাদের ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে পারে।
১০. মানসিক সমর্থন: থ্যালাসেমিয়ার মতো দীর্ঘস্থায়ী অবস্থার সাথে জীবনযাপন করা মানসিকভাবে চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। পরিবার, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-পড়শী সকলের থ্যালাসেমিয়ার রোগির পাশে থাকা ও সমর্থন করা মানবিক দায়িত্ব।