সমীরণ বিশ্বাস|ইটভাটার বিস্তার বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষকের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষিজমি ধ্বংস, ফসলের উৎপাদন কমে যাওয়া, বায়ু ও জলদূষণসহ নানা কারণে কৃষকের জীবন ও জীবিকা বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে। সে সমস্ত সমস্যা এবং প্রতিকার নিম্নে তুলে ধরা হলো ;
ইটভাটার কারণে কৃষি ও কৃষকের সংকট:
কৃষিজমির ক্ষতি ও উর্বরতা কমে যাওয়া : ইট তৈরির জন্য ফসলি জমির উর্বর মাটি কেটে নেওয়া হয়, ফলে ভবিষ্যতে সেখানে চাষ করা কঠিন হয়ে পড়ে। জমির টপসয়েল নষ্ট হয়ে গেলে মাটির পানি ধারণক্ষমতা কমে যায়, যার ফলে শস্য উৎপাদন হ্রাস পায়। অনেক কৃষক জমি হারিয়ে কৃষিকাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
বায়ু দূষণ ও ফসলের ক্ষতি: ইটের ভাটা থেকে কার্বন মনোক্সাইড (CO), সালফার ডাই-অক্সাইড (SO₂), ও অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাস নির্গত হয়। এরা বায়ুদূষণ ঘটিয়ে ফসলের পাতা ও ফল নষ্ট করে এবং ফসলের বৃদ্ধি ব্যাহত করে।
তাপদাহের প্রভাব: ইটভাটার আশেপাশে তাপমাত্রা বেশি থাকে, যা শস্য উৎপাদনের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালীন ফসলের (যেমন ধান, গম, সবজি) উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ফসলের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব : ইটভাটার ধোঁয়ায় থাকা সালফার ডাই-অক্সাইড (SO₂), কার্বন মনোক্সাইড (CO) ও অন্যান্য দূষিত গ্যাস ফসলের পাতা ঝলসে দেয় এবং ফলন কমিয়ে দেয়। ধোঁয়া ও ছাই ফসলের ওপর জমে গিয়ে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে, ফলে ফসলের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ইটভাটার উচ্চ তাপমাত্রার কারণে আশেপাশের এলাকায় তাপদাহ বেড়ে যায়, যা শস্যের জন্য ক্ষতিকর।
কৃষকের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও জীবনযাত্রার অবনতি : ইটভাটার ধোঁয়া শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, ও ফুসফুসের রোগ সৃষ্টি করে, যা কৃষকদের স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। কৃষিজমি হারিয়ে অনেক কৃষক কাজের অভাবে শ্রমিক বা ভ্যানচালকের মতো পেশায় চলে যেতে বাধ্য হন। দূষিত পানি ব্যবহার করতে গিয়ে কৃষকেরা নানা রোগে আক্রান্ত হন।
জলবায়ু পরিবর্তন ও চাষাবাদের অনিশ্চয়তা: ইটভাটার গ্যাস ও কার্বন নির্গমনের ফলে আশেপাশের এলাকায় জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, খরা, ও অতিরিক্ত গরমের কারণে ফসল উৎপাদনের অনিশ্চয়তা বাড়ে। অনেক জায়গায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় সেচের জন্য প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
জল দূষণ ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস: ইটভাটার রাসায়নিক ও ছাই আশেপাশের জলাশয় ও মাটির পানিকে দূষিত করে। এতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমে যেতে পারে, যা সেচের জন্য ব্যবহারযোগ্য পানির পরিমাণ কমিয়ে দেয়।
সম্ভাব্য সমাধান ও করণীয়:
বিকল্প উপকরণের ব্যবহার : ইটের পরিবর্তে কংক্রিট ব্লক, ফ্লাই অ্যাশ ব্রিকস বা পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার করা যেতে পারে। নন-এগ্রিকালচারাল সয়েল ব্যবহার করা। কৃষিজমি থেকে মাটি নেওয়ার পরিবর্তে নদীর পলিমাটি বা অপরিচিত মাটি ব্যবহার করা দরকার। পরিবেশবান্ধব ইটভাটা প্রযুক্তি চালু করা। ট্র্যাডিশনাল ইটভাটার বদলে জিগজ্যাগ, হাইব্রিড হফম্যান কিলন (HHK), ও ভার্টিকাল শ্যাফট ব্রিক কিলন (VSBK) প্রযুক্তি ব্যবহার করা উচিত। এসব প্রযুক্তি কম জ্বালানি খরচ করে এবং বায়ুদূষণও কমায়। সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও নীতিমালা বাস্তবায়ন। কৃষিজমিতে নতুন ইটভাটা স্থাপন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা উচিত। ইটভাটাগুলোর পরিবেশগত ছাড়পত্র ও নিয়মিত পরিদর্শনের মাধ্যমে মান বজায় রাখা দরকার। ইটভাটার দূষণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর সরকারি নীতিমালা প্রয়োগ করা। কৃষি ও পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে ইটভাটার ক্ষতিকর প্রভাব কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। বিকল্প নির্মাণ উপকরণের ব্যবহারে সরকারী ভর্তুকি দেওয়া যেতে পারে।
কৃষকদের জন্য সহায়তা ও পুনর্বাসন:
জমি হারানো কৃষকদের জন্য বিকল্প আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার। কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ, প্রশিক্ষণ ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। দূষণপ্রবণ এলাকায় কৃষি গবেষণার মাধ্যমে টেকসই ফসল উৎপাদনের কৌশল বের করা দরকার। ইটভাটার অতি সম্প্রসারণ কৃষি ও কৃষকের জীবনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য পরিবেশবান্ধব ইট উৎপাদন, বিকল্প নির্মাণ উপকরণের প্রচলন, ও সরকারি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কৃষিজমি ও কৃষকের অধিকার রক্ষা করা জরুরি। অন্যথায়, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশ দুটোই হুমকির মুখে পড়বে।
লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।