দেলোয়ার জাহিদ: বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর রাজনীতির সমালোচনামূলক দিক বিশ্লেষণ করা জাতির ইতিহাস, পরিচয় এবং সামাজিক কাঠামো বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সংগ্রাম বাংলাদেশের গতিপথে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে চিহ্নিত করে, যা আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সার্বভৌমত্বের জন্য বাঙালি জনগণের সংকল্প ও রক্ত ঢেলে দেয়ার প্রতীক।
মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী এবং সেই সময়কার ঘটনাবলীতে বিস্তৃত হওয়া বহুমুখী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক গতিশীলতা প্রকাশ করে যা জাতির গতিপথকে রূপ দিয়েছে। এই গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি বোঝা কেবল লক্ষ লক্ষ ত্যাগীদের সম্মান করে না বরং স্বাধীনতার অন্বেষণে বাংলাদেশী জনগণের স্থিতিস্থাপকতা, ঐক্য এবং চেতনাকেও আলোকিত করে। অধিকন্তু, স্বাধীনতা আন্দোলনের পরীক্ষা গণতান্ত্রিক নীতি, মানবাধিকার, এবং আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখার গুরুত্বকে বোঝায়, যা জাতির জন্য স্থায়ী মূল্যবোধকে পুনর্নিশ্চিত করে। সামগ্রিকভাবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার যাত্রা অধ্যয়ন করা আমাদের জাতিসত্তার পথ সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়াকে আরও গভীর করে এবং এর কঠোর অর্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার প্রতিশ্রুতিকে শক্তিশালী করে।
বাংলাদেশে গণহত্যার শিকারদের জন্য আন্তর্জাতিক স্মরণ দিবস প্রবর্তন ও কার্যকর আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের আহ্বান মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্যাগীদের স্মরণের তাৎপর্যকে তুলে ধরে। ২৫ মার্চ, ১৯৭১, বাঙালির মুক্তি আন্দোলনকে দমন করতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত নৃশংস গণহত্যার একটি মর্মান্তিক অনুস্মারক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। নিরলস বর্বরতার মুখে নিহত ত্রিশ লাখ বাঙালির প্রতি রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের শ্রদ্ধা নিবেদন সেই সময়কালে সংঘটিত নৃশংসতার মাধ্যাকর্ষণকে নির্দেশ করে।
'অপারেশন সার্চলাইট'-এর সময় পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত নির্বিচার গণহত্যার রাষ্ট্রপতির স্মৃতিচারণ অপরাধের জঘন্যতাকে নির্দেশ করে। গণহত্যা দিবসের বিশ্বব্যাপী পালন করা ও ভয়াবহতার একটি গৌরবময় অনুস্মারক হিসাবে কাজ করে এবং এই ধরনের নৃশংসতাকে পুনরাবৃত্তি করা থেকে রক্ষা করার জন্য সম্মিলিত দায়িত্বের উপর তা জোর দেয়। রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের 'সোনার বাংলার' স্বপ্নের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, শান্তি ও সমৃদ্ধির মূলে থাকা একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য জাতির আকাঙ্ক্ষাকে আবদ্ধ করে।
এ বীভৎস গণহত্যা শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বমানবতার ইতিহাসেও একটি কালো অধ্যায়। এমন গণহত্যা আর যেন কোথাও না ঘটে, গণহত্যা দিবস পালনের মাধ্যমে সে দাবিই বিশ্বব্যাপী প্রতিফলিত হবে। রাষ্ট্রপতি যথার্থই এ বিষয়গুলো উপলব্দি করেছেন তাঁর সে উপলব্দির সাথে জড়িয়ে আছে উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন, দেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত করার স্বপ্ন।
২৫শে মার্চ ১৯৭১ কে শুধু মাত্র একটি গণহত্যা বললে কতটা সুবিচার করা হবে তাদের প্রতি যাদের তালিকা করে একে একে নিষ্ঠুর, নির্মমভাবে গুলি করে বেয়োনেট খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে সে তালিকায় ছিলেন এমন শহীদ হওয়া একজন বুদ্ধিজীবী শিক্ষক মোহাম্মদ সাদেক যার বিধবা পত্নী সামসুন্নাহার বেগমের দুর্দশার হিমালয় পর্বত ডিঙিয়ে জীবন সায়াহ্নে তিনি সমতলে এসেছেন ।
১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকারের আমলে এ শহীদ পরিবারকে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়া বাড়ি থেকে উচ্ছেদ তাদের জীবন নির্বাহের অসুবিধাকে আরও বাড়িয়ে তোলে ছিল । সামসুন্নাহার বেগমের দীর্ঘ কঠিন জীবনযাত্রার বর্ণনা, জমি বা স্থায়ী বাড়ি ছাড়াই, শহীদদের পরিবারের টিকে থাকা শুধু তার নয় অন্য পরিবারগুলোর জন্যেও ও এমনিতর চলমান চ্যালেঞ্জ।
শুধু যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলি এতে রয়েছেন এ এন এম মুনীর চৌধুরী, ড. জিসি দেব, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, আবদুল মুকতাদির, এস এম রাশীদুল হাসান, ড. এন এম ফয়জুল মাহী, ফজলুর রহমান খান, এ এন এম মুনীরুজ্জামান, ড. সিরাজুল হক খান, ড. শাহাদাত আলী, ড. এম এ খায়ের, এ আর খান খাদিম, মো. সাদিক, শরাফত আলী, গিয়াসউদ্দীন আহমদ ও আনন্দ পয়ান ভট্টাচার্য এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় : অধ্যাপক কাইয়ুম, হাবীবুর রহমান, সুখরঞ্জন সমাদ্দার ও ড. আবুল কালাম আজাদ। ছিলেন সাবেক গণপরিষদ সদস্য : মসিউর রহমান, আমজাদ হোসেন, আমিনুদ্দীন, নজমুল হক সরকার, আবদুল হক, ডা. জিকরুল হক, সৈয়দ আনোয়ার আলী ও এ কে সরদার। ছিলেন সাংবাদিকতার দিক পাল : সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, খোন্দকার আবু তালেব, নিজামুদ্দীন আহমদ, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবের, শেখ আবদুল মান্নান (লাডু), নজমুল হক, এম আখতার, আবুল বাসার, চিশতী হেলালুর রহমান, শিবসদন চক্রবর্তী ও সেলিনা আখতার। চিকিৎসাবিদ ও সাহিত্যিকদের তালিকাও কম দীর্ঘ নয়।
শহীদ বুদ্ধিজীবী মোহাম্মদ সাদেকের বিধবা সামসুন্নাহার বেগমের আখ্যান, যারা জাতির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের পরিবারের মুখোমুখি হওয়া দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের প্রতিকৃতি। তাদের গভীর ত্যাগস্বীকার সত্ত্বেও, অনেক পরিবার আর্থ-সামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে চলেছে, ব্যাপক সমর্থন এবং স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিচ্ছে।
স্বাধীনতা থেকে জাতিসত্তা পর্যন্ত বাংলাদেশের যাত্রার স্মরণে, আমরা শহীদদের ত্যাগের প্রতি সম্মান জানাই, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখার প্রতি আমাদের অঙ্গীকার পুনর্নিশ্চিত করি এবং শান্তি, ন্যায়বিচার এবং সমৃদ্ধি বিরাজ করে এমন ভবিষ্যতের দিকে প্রয়াস করি।
লেখক: বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কানাডা ইউনিট কমান্ড নির্বাহী ও সভাপতি বাংলাদেশ নর্থ আমেরিকান জার্নালিস্টস নেটওয়ার্ক