এম মনির উদ্দিন, পিএইচডি : সম্প্রতি উজানের দেশ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ী ঢল ও ভারী বৃষ্টির কারনে দেশের পুর্বাঞ্চলের ১১টি জেলায় ভয়াবহ বন্যা আঘাত হানে। অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে এবং আগাম কোন সতর্কতা বার্তা বা পুর্ভাবাস না থাকার কারনে তীব্র বন্যার পানির স্রোত মুহুর্তের মধ্যে ভাসিয়ে নিয়ে যায় মানুষের বাসস্থানসহ ঘরের খাদ্য, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী।
জমির ফসল, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগীর খামার, পুকুর-জলাশয়ের মাছ। বন্যায় মারা যায় কমপক্ষে ৬০ জন মানুষ, ০.৩ মিলিয়নের বেশী মানুষ এখনো আশ্রয়কেদ্রে অমানবিক পরিস্থিতির মধ্যে দিনাতিপাত করছে। প্রায় ৫.২ মিলিয়ন মানুষ এই ভয়াবহ বন্যার কবলে আক্রান্ত এবং ক্ষতিগ্রস্থ। বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ ১১টি জেলা হচ্ছে ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, লক্ষীপুর, খাগড়াছড়ি, বা²নবাড়ীয়া, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার এবং সিলেট।
দেশের এমন একটি ক্রান্তিকালে সারাদেশের মানুষ ঝাপিয়ে পড়েছে বানভাসী মানুষের পাশে দাড়াতে এবং দেশের কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সম্ভবত এটাই প্রথম যেখানে সারাদেশের মানুষ একই বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে কাধেঁ কাঁধ মিলিয়ে বন্যাক্রান্ত মানুষের সহযোগীতায় এগিয়ে এসেছে। জীবনের ঝুকি নিয়ে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা স্পিড বোট নিয়ে গাছে, ঘরের চালে, বিভিন্ন স্থাপনার ছাদে আশ্রয় নেয়া মানুষকে উদ্ধার করেছে। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিগতভাবে, কমিউনিটি বিভিন্ন পর্যায় থেকে বানভাসী মানুষের ত্রান সহায়তায় এগিয়ে এসেছে। বাজ্ঞালী জাতি ঐক্যবদ্ধ হলে যে কোন দুর্যোগকে সফলভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব তা এই বন্যাকে ঘিরে আরেকবার প্রমানিত হয়েছে।
সার্বিকভাবে, বন্যায় ১১টি জেলায় কি পরিমান আর্থিক ক্ষতি হয়েছে যা এখনো হয়তো নির্ধারন করা সম্ভব হয়নি। তবে, এই ক্ষতির পরিমান কাটিয়ে উঠতে যে বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সহায়তা ছাড়া দেশের একার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব নয় তা অত্যন্ত পরিস্কার। কারন, এই বন্যা শুধু ১১টি জেলারই ক্ষতি করেনি বরং সারাদেশের অর্থনীতিতে একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে স্বাভাবিকভাবেই। কাজেই, জাতীয়ভাবে গুরুত্ব দিতে হবে বন্যার এই বিশাল ক্ষতিকে কাটিয়ে উঠার জন্য। দীর্ঘমেয়াদী কৃষির উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং তার সঠিক ও যথাযথ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে অবশ্যই আমরা দেশের এই ব্যাপক পরিমান ক্ষতিকে পুষিয়ে নিতে পারবো। এখন থেকেই যে সকল কৃষির উন্নয়নমুলক কর্মকান্ড নিয়ে জরুরী ভিত্তিতে এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন তার মধ্যে গুরুত্বপুর্নঃ
১। আমনের চাষের উপর প্রয়োজনীয় কর্মসুচী নেয়াঃ
বন্যা আক্রান্ত ১১টি জেলায় স্বাভাবিকভাবে আমন মৌসুমে কয়েক লাখ মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হয় যা এবারের এই বন্যায় জমিতে লাগানো আমন ফসলের ক্ষতির পরিমান অনেক। কারন, এই ১১টি জেলায় ইতিমধ্যে আমন লাগানো প্রায় শেষ পর্যায়ে ছিলো। আমন ফসলের এই ক্ষতিকে কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেয়ার জন্য বন্যার পানি নেমে যাওযার সাথে সাথে বিশেষ করে নাবী জাতের আমনের চাষ যতটুকু বাড়ানো যায় তার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া দরকার। যদিও, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে জানা যায় যে, দেশে এই মুহুর্তে খুব বেশী পরিমানে নাবী জাতের আমনের বীজ নাই। তবে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ইতিমধ্যে প্রায় ৭০০-৭৫০ মেট্রিক টন নাবী জাতের আমনের বীজ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে এবং ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভিতর খালি জায়গায় বীজতলাও করা হয়েছে। তাদের সংগ্রহীত জাতগুলোর মধ্যে রয়েছে বিআর-২৩, ব্রি ধান-৭৫ এবং বিনা-১৭। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নাবী জাতের আমনের বীজতলা করেছে যা দিয়ে প্রায় ১০০ হেক্টর জমিতে চাষ করা যাবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তত্বাবধানে উৎপাদিত আমনের চারা দিয়ে প্রায় ২১ হাজার হেক্টর জমিতে লাগানো যাবে। তাছাড়া, আরো কিছু পেশাজীবি প্রতিষ্ঠান তাদের তত্বাবধানে কিছু নাবী জাতের আমনের চারা উৎপাদন করছে যা দিয়ে আরো কিছু পরিমান জমি আমন চাষের আওতায় আসবে।
বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর তলিয়ে যাওয়া আমনের জমিতে আগে লাগানো চারা বা চারার গোড়াও যদি বেচে থাকে সে সমস্ত জমি পরিস্কার করে দ্রুত ইউরিয়া সার ছিটিয়ে দিলে তা থেকেও ভাল ফলন পাওয়া সম্ভব। যেহেতু, বন্যায় আক্রান্ত সকল কৃষক তাদের সর্বস্ব হারিয়েছে, তাই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে আমন চাষের প্রয়োজনীয় সারসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণ বিনামুল্যে সরবরাহ করার ব্যবস্থা নেয়া আবশ্যক।
২। শীতকালীন শাকসব্জির চাষ বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম হাতে নেয়াঃ
বন্যায় আক্রান্ত ১১টি জেলায় উৎপাদিত প্রচুর পরিমান শাকসব্জি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ঢাকার বাজারে আসে এবং ঢাকার একটি উল্লেখযোগ্য অংশের চাহিদা মেটায়। শাকসব্জির চাষ এই সকল জেলার কৃষকদের নগদ অর্থ আয়ের একটি গুরুত্বপুর্ন উৎস। শীত মৌসুমে যে সকল সব্জির চারা তৈরী করার প্রয়োজন হয় নিশ্চয়ই এই মুহুর্তে বেশ কয়েকটি জেলায় সেই বীজতলা করার মত জায়গা এবং বন্যাক্রান্ত কৃষকের সামর্থ্য কোনটাই নেই। এই সকল জেলাগুলোতে সেপ্টেম্বর মাস থেকেই শীতকালীন শাকসব্জির চাষ শুরু হয় বাজারে আগাম তোলার জন্য।
এই অবস্থায়, এই জেলাগুলোর বিগত মৌসুমগুলোর শস্য উৎপাদন তালিকা দেখে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তত্বাবধানে দ্রæততম সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সব্জির চারা উৎপাদনের কাজ সম্পন্ন করা প্রয়োজন। সেইসাথে, অন্যান্য শাকসব্জির মান সম্পন্ন বীজ প্রস্তুত রাখা জরুরী যাতে কৃষকেরা জমির পানি নেমে যাওয়ার পর পর জো অবস্থা আসার সাথে সাথে জমি চাষ করে প্রয়োজনীয় শাকসব্জি লাগাতে পারে। যথেষ্ট পরিমানে সব্জির চারা কৃষকের চাহিদা মোতাবেক সরবরাহ করার জন্য বিএডিসি’র হর্টিকালচার সেন্টার, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নার্সারী, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের গবেষণা মাঠ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা মাঠ ব্যবহার করা যেতে পারে।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ জেলাগুলোতে শীতকালীন শাকসব্জির চাষ বরাবরের মতো অব্যাহত রাখার জন্য কতিপয় করণীয়ঃ
২.১। বন্যাক্রান্ত জেলার জন্য যে সকল শাকসব্জির বীজ ক্রয় করা হবে, অবশ্যই তা যাতে গুনগতমান সম্পন্ন বীজ হয় সেটা যথাযথভাবে নিশ্চিত করা। কারন, আমরা সম্ভবত এখনো অসাধু ব্যবসায়ীদের চক্র থেকে বের হতে বা মুক্ত হতে পারিনি। তাই, সর্বপ্রথম নিশ্চিত হতে হবে, যাতে ক্রয়কৃত বীজ ভাল মানের হয়।
২.২। পর্যাপ্ত এবং চাহিদা অনুযায়ী উন্নত জাতের সব্জির বীজতলা স্থাপনপুর্বক কৃষকের তালিকা তৈরী করা এবং চাহিদা অনুযায়ী কৃষককে সময়মত সব্জির চারা সরবরাহ করা।
২.৩। যেহেতু, জেলাগুলোতে বন্যা কৃষকের ঘরবাড়ীসহ সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সেহেতু প্রয়োজন মোতাবেক জমি তৈরীর জন্য ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলারসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তত্বাবধানে মাঠ পর্যায়ে সরবরাহ করতে হবে।
২.৪ আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, শুধু অসহায় কৃষকের প্রয়োজনে নয় সার্বিকভাবে দেশের মানুষের খাদ্যের যোগানকে অব্যাহত রাখার জন্যই বন্যার এই ক্ষতিকে কাটিয়ে উঠার জন্য আমাদের সচেষ্ট হতে হবে। এই বন্যায়, কৃষক একবারেই নিঃস্ব হয়ে গেছে। তাই, তাদের কৃষিকাজের তথা দেশের কৃষিপণ্য উৎপাদনের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রকার মান সম্পন্ন রাসয়নিক সার, জৈবসার, পেস্টিসাইড ইত্যাদি বিনামুল্যে প্রনোদনার মাধ্যমে প্রদান করতে হবে।
যতটুকু জানা সম্ভব হয়েছে, তাতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর শীতকালীন শাকসব্জির চাষকে গুরুত্ব দিয়ে ০.৩ মিলিয়ন কৃষকের বা কৃষক পরিবারকে সহায়তা করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহন করছে এবং প্রতিটি কৃষক মোট ৮ প্রকারের শাকসব্জির বীজসহ প্রয়োজনীয় রাসয়নিক সার পাবে। তাছাড়াও, কৃষি বিভাগ ক্ষতিগ্রস্থ ১১টি জেলায় কৃষকের বসতাভটায় শাকসব্জি চাষের জন্য প্রয়োজনীয় বীজ ও সার সহায়তা প্রদান করার পরিকল্পনা করেছে। সেইসাথে, যদি বিভিন্ন দেশীয় এবং আর্ন্তজাতিক সংস্থাগুলো তাদের সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেয় তাহলে অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্থ জেলাগুলোতে শীতকালীন ফসল উৎপাদনের ধারাকে অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে।
৩। আগামী বোরো মৌসুমের জন্য প্রস্তুতি ও করণীয়ঃ
৩.১। যেহেতু আকস্মিক বন্যার ¯্রােতে কৃষকের সকল সম্পদের সাথে সাথে ঘরে রাখা বোরো ধানের বীজ ভেসে গেছে অথবা নষ্ট হয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে বন্যাক্রান্ত ১১টি জেলাতেই কৃষকের হাতে আর তেমন বীজ সংরক্ষিত নাই। পাশাপাশি বিগত জুন-জুলাই সময়ে তেমন বৃষ্টি না হওয়ায় এবার দেশে আউশ ও আমনের ফলনে কিছুটা হলেও ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছে যা সার্বিকভাবে ধানের উৎপাদনে প্রভাব ফেলতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই বন্যায় আক্রান্ত ১১টি জেলার আউশ এবং আমন ধানের ক্ষতিকে পুষিয়ে নেয়া সেইসাথে সারাদেশের বাস্তবতায় আগামী বোরো মৌসুমে ধান চাষের এলাকা অবশ্যই বাড়াতে হবে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য। আর এ জন্য প্রয়োজন চাহিদা মোতাবেক মানসম্পন্ন বীজের। এখনই হিসাব কষে নিতে হবে, দেশে আগামী বোরো মৌসুমের জন্য বিএডিসি এবং প্রাইভেট সেক্টর মিলিয়ে মোট বীজের পরিমান এবং প্রয়োজনে আমদানী করে আনতে হবে উচ্চফলনশীল হাইব্রিড জাতের ধানের বীজ।
৩.২ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ ১১টি জেলায় যাতে আগামী মৌসুমে বোরো ধানের চাষ বাড়ানো যায়, সেইলক্ষ্যে মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কৃষক তালিকা করা প্রয়োজন। বোরো চাষীদের তালিকা তৈরী করা থাকলে প্রয়োজনীয় বীজের চাহিদা নিরুপন করা সহজ হবে এবং সময়মত কৃষকের হাতে বীজতলা তৈরী করার জন্য বোরো ধানের বীজ সরবরাহ করা সহজ হবে।
৩.৩ বোরো ধান চাষের জন্য প্রয়োজনীয় এবং মানসম্পন্ন রাসয়নিক সার, জৈবসার ও পেস্টিসাইড কৃষককে প্রনোদনার আওতায় বিনামুল্যে প্রদান করার ব্যবস্থা করতে হবে।
৩.৪ বোরো ধান চাষের জন্য জমি তৈরী ও চারা রোপনের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় মেশিনারীজ সহজলভ্য করার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে সমলয় চাষ পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে, যাতে মেশিনারীজ ব্যবহার করা সহজ হয়।
৪। গবাদিপশু ও পোল্ট্রি সেক্টরের জন্য করণীয়ঃ
বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম এবং আর্ন্তজাতিক মিডিয়ায় দেশের মানুষসহ আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায় দেখেছেন, কিভাবে আকস্মিক বন্যার তীব্র স্রোত মুহুর্তের মধ্যে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে খামারের গবাদিপশু। হাজার হাজার গবাদিপশু ভেসে গেছে বা মারা গেছে এই বন্যায় যা একবারে নিঃস্ব করে গেছে শত শত বানিজ্যিক গবাদিপশুর খামারীদের। কয়েক মিলিয়ন পোল্ট্রি বার্ড খামারেই মারা গিয়েছে। শুধুমাত্র গবাদিপশু ও পোল্ট্রি সেক্টরে ক্ষতি হয়েছে কয়েক মিলিয়ন ডলারের। এই ক্ষতিকে পুষিয়ে নিতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে, ক্ষতিগ্রস্থ এই এলাকায় নুতন করে গবাদিপশু ও পোল্ট্রি সেক্টরে কাজ শুরু করতে হবে।
এই ১১টি জেলায় গবাদিপশু ও পোল্ট্রি শিল্পের উন্নয়নে যা করা প্রয়োজনঃ
৪.১। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে বিশেষ টিম গঠন করে ১১টি জেলায় যে সকল গবাদিপশু বেঁচে আছে, তাদের বিশেষ স্বাস্থ্য পরিচর্যা, চিকিৎসা এবং প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন প্রদান করার ব্যবস্থা করা। সেইসাথে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বিশাল অর্থের প্রকল্পের (এলডিডিপি) টাকা যতদুর জানা যায়, তাতে নাকি নয় ছয় করে খরচ করতে হচ্ছে। তাই, এই প্রকল্পের অর্থ দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ ১১টি জেলার গবাদিপশু এবং পোল্ট্রি সেক্টরের উন্নয়নে যে সকল কাজ করার দায়িত্ব দেয়া যায় তা হলোঃ
৪.২। এলডিডিপি প্রকল্প থেকে ১১টি জেলার বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে রাস্তাঘাট, পতিত জায়গা এবং খামারীদের নির্দিষ্ট জমিতে দ্রæত বর্ধনশীল ঘাস লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে যাতে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে তা গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
৪.৩ এলডিডিপি প্রকল্প থেকে বন্যায় শতভাগ ক্ষতিগ্রস্থ গবাদিপশুর খামারীদের পুনরায় খামার দাড় করানোর জন্য বিশেষ গ্র্যান্ট বা অনুদানের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন করার ব্যবস্থা করা।
৪.৪ ১১টি জেলায় বন্যায় সম্পুর্নভাবে ক্ষতিগ্রস্থ পোল্ট্রি খামারীদের খামারের উৎপাদনশীলতা পুনরায় শুরু করার জন্য এলডিডিপি প্রকল্পের মাধ্যমে বিশেষ গ্র্যান্ট বা অনুদানের মাধ্যমে খামার পুনঃস্থাপন করার ব্যবস্থা করা আবশ্যক।
৪.৫ কৃষকের বাড়ীতে বা খামারীদের খামারে বোরো ফসল না কাটা পর্যন্ত সময়ের জন্য এলডিডিপি প্রকল্পের মাধ্যমে ১১টি জেলার গবাদিপশু ও পোল্ট্রি খামারের প্রয়োজনীয় খাবার সরবরাহ করা।
৫. ক্ষতিগ্রস্থ মৎস্য সেক্টরের উন্নয়নে করণীয়ঃ
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ ১১টি জেলার অধিকাংশ পুকুরের বা অন্যান্য জলাশয়ে চাষ করা সমস্ত মাছ বের হয়ে গেছে যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন প্রয়োজন। তবে, মৎস্য সেক্টরের যে পরিমান ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠার জন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে মৎস্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে যে সকল কার্যক্রম শুরু করা প্রয়োজনঃ
৫.১। যে সকল পুকুর মালিকের মাছ সম্পুর্নভাবে ভেসে গেছে, তাদের পুকুরে দ্রæত বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য বড় সাইজের পোনা স্টক করা এবং মাছের খাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ফিড সহায়তা মৎস্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে।
৫.২। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ ১১টি জেলার সকল উম্মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক প্রচুর পরিমানে মাছের পোনা অবমুক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে এই সমস্ত এলাকায় অল্প কিছুদিনের মধ্যে মাছের উৎপাদন ও সহজলভ্যতা বাড়ে।
৫.৩। ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার পুকুর মালিকদের তাৎক্ষনিক আর্থিক দুরাবস্থা কাটিয়ে উঠার জন্য অত্যন্ত সহজশর্তে ঋনের ব্যবস্থা করতে হবে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল এবং অন্যতম জনবহুল একটি দেশ যেখানে প্রতিবছর কমে যাচ্ছে চাষের জমি, বাড়ছে মানুষ, সেহেতু এই বিপুল পরিমান মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দেশের অন্যতম প্রধান একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। যদি বন্যা বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারনে দেশের বোরো বা আমন যে কোন একটি মৌসুমের ফসল আংশিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তাহলে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে স্বাভাবিকভাবেই। জলবায়ুর পরিবর্তন জনিত কারনে এশিয়ার ধান উৎপাদনকারী অধিকাংশ দেশের বাস্তব চিত্র প্রায় একই রকম। প্রতিটি দেশ এখন তার নিজ দেশের খাদ্য নিরাপত্তার উপর জোর দিচ্ছে। কারন, ইতিমধ্যে প্রতিটি দেশে ধানের ফলন জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারনে বিগত বছরগুলোর তুলনায় কমে গেছে। তাই, টাকা থাকলেও খাদ্য আমদানী করা আগামীদিনের জন্য হবে বড় চ্যালেঞ্জ।
কাজেই, নিজ দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা নির্ধারন করে এগিয়ে যাওয়া হবে অত্যন্ত সময়োপযোগী কাজ। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে, নুতন অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের বিগত দিনের কৃষি সর্ম্পকিত অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। তাই, কৃষি মন্ত্রণালয় এবং এর অধিভুক্ত সকল প্রতিষ্ঠানের দক্ষ জনবলকে স্থিতিশীল অবস্থায় রেখে পরিকল্পিত উপায়ে কাজে লাগিয়ে দেশের কৃষি উৎপাদনকে অব্যাহত রাখার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হবে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা বিধানের একমাত্র হাতিয়ার।
লেখকঃ এগ্রোনমিস্ট অ্যান্ড কনসালট্যান্ট
গেইন বাংলাদেশ