ড. মো. হেমায়েতুল ইসলাম আরিফ: আজ আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস, যা আন্তর্জাতিক নদী রক্ষায় করণীয় দিবস নামেও পরিচিত, প্রতি বছর ১৪ই মার্চ পালিত হয়। ১৯৯৭ সালে ব্রাজিলের কুরিতিবা শহরে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সমাবেশে নদীর সুরক্ষার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির প্রস্তাব উত্থাপিত হয়, যা পরবর্তীতে ১৯৯৮ সাল থেকে সারা বিশ্বে পালিত হতে শুরু করে। দিবসটির মূল উদ্দেশ্য হলো, নদী সংরক্ষণ এবং মানুষের ওপর নদীর প্রতি যে দায়িত্ব রয়েছে, তা স্মরণ করিয়ে দেওয়া, পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা বাড়ানো।
বাংলাদেশেও এই দিবসটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয়। গ্রীন ভয়েসের মতো সংগঠন শুরু থেকেই "বাংলাদেশের নদী, বাংলাদেশের প্রাণ, দেশ বাঁচাতে নদী বাঁচান" স্লোগান নিয়ে নদী সংরক্ষণের কাজ করে যাচ্ছে। ২০২৪ সালের আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবসের প্রতিপাদ্য, 'সবার জন্য দূষণমুক্ত পানি', বর্তমান বিশ্বের নদীগুলোর দূষণ সমস্যাকে তুলে ধরে। এটি নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়।
নদী আমাদের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি শুধু খাবার পানি সরবরাহের উৎস নয়, বরং বিভিন্ন উপায়ে আমাদের উপকারে আসে। নিম্নে নদীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরা হলো:
১) খাবার পানি সরবরাহ: নদী থেকে প্রাপ্ত পানি আমাদের প্রতিদিনের জীবনে ব্যবহারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু পান করার জন্য নয়, ফসল উৎপাদন এবং অন্যান্য দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত হয়।
২) যোগাযোগ ও পরিবহন: নদী দীর্ঘদিন ধরে একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ ও পরিবহন মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নৌকাসহ অন্যান্য জলযানগুলো নদীর মাধ্যমে পণ্য ও মানুষ পরিবহন করতে সাহায্য করে। সল্প মূল্যে পণ্য পরিবহনের জন্য নদীপথ একটি কার্যকর মাধ্যম।
৩) চাষাবাদ ও কৃষি: নদীর পানি চাষাবাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেচের মাধ্যমে ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ করা হয়, যা কৃষির উৎপাদনশীলতাকে বাড়াতে সাহায্য করে।
৪) পরিবেশ রক্ষা: নদী পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে। এটি জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ, জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন করে। নদীর তীরবর্তী বনাঞ্চল ও জীববৈচিত্র্য পরিবেশ রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
৫) অর্থনৈতিক উন্নয়ন: নদী সংলগ্ন এলাকায় মৎস্যচাষ, জলপরিবহন, পর্যটন এবং কৃষি-ভিত্তিক শিল্পগুলির বিকাশ ঘটে। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে নদী দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখে।
৬) পর্যটন ও বিনোদন: নদী অনেক পর্যটককে আকর্ষণ করে। নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পর্যটকরা আসে এবং এর ফলে স্থানীয় অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটে। নদী কেন্দ্রিক নৌকা ভ্রমণ, মাছ ধরা এবং অন্যান্য বিনোদনমূলক কার্যক্রমও আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করে।
কুমিল্লা ও ফেনী অঞ্চলের নদীগুলো দীর্ঘদিনের পলি জমে সংকীর্ণ হয়ে গেছে, যা আকস্মিক বন্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পাশাপাশি, প্রতিবেশী দেশ ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার সমস্যাও এই সংকটকে বাড়িয়ে তুলেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আন্তঃনদী আইন ও চুক্তি সঠিকভাবে মেনে চললে উভয় দেশই লাভবান হবে এবং এই সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে। আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করলে নদীর পানির সুষ্ঠু বণ্টন ও সংরক্ষণ করা সম্ভব।
সুতরাং, নদী কেবল খাবার পানি নয়, বহুমুখী উপকারের মাধ্যম হিসেবে আমাদের জীবন এবং পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর সুরক্ষা ও সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব।