আমের অ্যানথ্রাকনোজ: কারণ, লক্ষণ, দমনে করণীয়

ড. মোঃ মাহফুজ আলম: বাংলাদেশসহ সকল আম উৎপাদনকারী দেশে আমের অন্যতম ক্ষতিকর রোগ হলো অ্যানথ্রাকনোজ। এই রোগ Colletotrichum gloeosporioides নামক এক ধরনের ছত্রাকের কারণে ঘটে। এটি মূলত আমগাছের কচি পাতা, কান্ড, মুকুল, কুঁড়ি এবং বাড়ন্ত ফলে আক্রমণ করে। রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে পাতায়, কান্ডে ও ফলে ছোট ছোট কালো বা বাদামি দাগ দেখা যায়। সময়ের সাথে সাথে এই দাগগুলো একত্রিত হয়ে বড় আকার ধারণ করে।

গুরুতর আক্রান্ত পাতার কোষ দ্রুত মারা যায়, ফলে পাতা ঝরে পড়ে। কচি পাতার আক্রান্ত স্থানে টিস্যু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে পাতা বিবর্ণ হয়ে যেতে পারে। মুকুল বা ফুল আক্রান্ত হলে কালো দাগের সৃষ্টি হয়, যা পরবর্তীতে শুকিয়ে পড়ে। মুকুলের ওপর আক্রমণ হলে ফল ধারণ ব্যাহত হয়, ফলে ফলন কমে যায়। ছোট আমে এই ছত্রাকের আক্রমণে কালো দাগ দেখা দিলে সেগুলো ঝরে পড়তে পারে। পরিপক্ব আমে আক্রমণ হলে ফলের চামড়ায় কালো দাগ পড়ে, যা বাজারমূল্য কমিয়ে দেয়।

 ১. আমের অ্যানথ্রাকনোজ রোগের কারণ:

  • ছত্রাকের নাম: Colletotrichum gloeosporioides
  • বিস্তার: বায়ু, বৃষ্টি, কুয়াশা এবং সংক্রামিত উদ্ভিদের অংশের মাধ্যমে ছড়ায়।
  • অনুকূল পরিবেশ: ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং ৯০%+ আর্দ্রতা এই রোগের দ্রুত বিস্তারে সহায়ক।
  • অবহেলা: অপরিচ্ছন্ন বাগান, সঠিকভাবে ছাঁটাই না করা গাছ এবং পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশনের অভাব।

২. আমের অ্যানথ্রাকনোজ রোগের লক্ষণ:

  • পাতায়: ছোট বাদামি বা কালো দাগ যা পরবর্তীতে বড় হয়ে পাতা শুকিয়ে ফেলতে পারে।
  • ফুলে: ছোট কালো দাগ যা পরে বড় আকার ধারণ করে এবং ফুল ঝরে পড়তে সহায়ক।
  • ফলে: ডিপ্রেশনযুক্ত কালো দাগ যা ফলের গুণগত মান হ্রাস করে।
  • ডালপালায়: কালো দাগ যা পরে শুকিয়ে ডালপালা মরে যেতে পারে।

৩. আমের অ্যানথ্রাকনোজ রোগের ক্ষতির প্রক্রিয়া:

  • ফলন হ্রাস: ফলের আকার ছোট হয়ে যায় এবং গুণগত মান কমে যায়।
  • মৃত্যুহার বৃদ্ধি: ডালপালা ও পাতার মারাত্মক ক্ষতি, যা গাছের মোট উৎপাদনশীলতা হ্রাস করে।
  • ফল সংগ্রহের পরে ক্ষতি: ফল সংরক্ষণের সময় ছত্রাকের সংক্রমণ অব্যাহত থাকে, যা ফলকে দ্রুত পচিয়ে ফেলে।
  • রপ্তানি সংকট: রোগাক্রান্ত ফলের গুণগত মান কমে যাওয়ার কারণে রপ্তানির চাহিদা কমে যায়।

৪. আমের অ্যানথ্রাকনোজ রোগ দমনে করণীয়:

  • প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা:
    • নিয়মিত গাছের পরিচর্যা ও ছাঁটাই করুন।
    • গাছের আশপাশ পরিষ্কার রাখুন এবং জমিতে পানি জমে থাকা এড়িয়ে চলুন।
    • সংক্রমণমুক্ত চারা রোপণ করুন।
  • রোগ নিবারণ:
    • ফুল ফোটা থেকে ফল সংগ্রহ পর্যন্ত ছত্রাকনাশক (যেমন: কার্বেন্ডাজিম, ম্যানকোজেব, কপার অক্সিক্লোরাইড) প্রয়োগ করুন।
    • ১৫ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করুন।
    • বায়ু চলাচল নিশ্চিত করতে গাছের শাখাগুলো ছাঁটাই করুন।
  • মুকুলে রোগের প্রতিরোধ:
    মুকুলে ছত্রাকজনিত রোগ প্রতিহত করতে ম্যানকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক, যেমন ডায়থেন এম-৪৫, পেনকোজেব বা ইন্ডোফিল এম-৪৫ (প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে) মিশিয়ে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। আমের পুষ্পমঞ্জরী ১০ সেন্টিমিটার লম্বা হলেই প্রথম স্প্রে সম্পন্ন করতে হবে। এরপর, আম মটর দানার মতো আকার ধারণ করলে দ্বিতীয়বার স্প্রে করতে হবে। এটি কচি আমে রোগের আক্রমণ রোধ করবে এবং আম ঝরে পড়া উল্লেখযোগ্যভাবে কমাবে। প্রয়োজনে এই ছত্রাকনাশক কীটনাশকের সাথে মিশিয়ে একত্রে স্প্রে করা যেতে পারে।
  • বড় আমে রোগের প্রতিরোধ:
    বড় আমে ছত্রাকজনিত রোগ প্রতিরোধের জন্য আম ব্যাগিং একটি কার্যকর পদ্ধতি। তবে, যদি ব্যাগিং সম্ভব না হয়, তাহলে রোগের লক্ষণ দেখা দিলেই ম্যানকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন ডায়থেন এম-৪৫, পেনকোজেব, ইন্ডোফিল এম-৪৫) প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। এটি ফলের গুণগত মান রক্ষা করতে সহায়ক হবে।
  • ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ:
    • পরিপক্ব ফল সময়মত সংগ্রহ করুন।
    • ফল সংগ্রহের পরে ৫২-৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১০-১৫ মিনিট গরম পানিতে ডুবিয়ে সংরক্ষণ করুন।আমের আন্থ্রাকনোজ একটি মারাত্মক রোগ যা সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ এই রোগের বিস্তার রোধ করতে সহায়ক।

লেখক:প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (BARC)