বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও দক্ষিণ এশিয়ার টেকসই ভবিষ্যৎ

কৃষিবিদ আবুল বাশার মিরাজ: বিশ্ব পরিবেশ দিবস কেবল একটি প্রতীকী দিন নয়—এটি প্রকৃতির প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতা ও দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেওয়ার সময়। জাতিসংঘ ঘোষিত এ দিবস প্রতিবছর ৫ জুন পালিত হয় বিশ্বজুড়ে। দিনটির মূল উদ্দেশ্য, মানুষের মধ্যে পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব ও চেতনা জাগানো এবং প্রয়োজনীয় কর্মকৌশল গ্রহণে উৎসাহ দেওয়া। এবারের প্রতিপাদ্য “প্লাস্টিক দূষণের অবসান ঘটানো” বিশ্ববাসীর জন্য এক সতর্কবার্তা। বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার মতো ঘনবসতিপূর্ণ ও পরিবেশগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের জন্য বিষয়টি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহ—বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ এবং আফগানিস্তান—মিলেই গঠিত সার্ক অঞ্চল। প্রায় ২০০ কোটি মানুষের আবাসস্থল এ অঞ্চল, যা বৈশ্বিক জনসংখ্যার এক বিশাল অংশ ধারণ করে। এখানকার দেশগুলো বর্তমানে এক অভিন্ন বাস্তবতার মুখোমুখি দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন উজাড়, পানি সংকট ও কৃষিজমির হ্রাস। অপরিকল্পিত নগরায়ন, নির্বিচারে শিল্প স্থাপন, অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের ফলে পরিবেশ প্রতিনিয়ত ঝুঁকিতে পড়ছে।

বাংলাদেশের মতো দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত আরও স্পষ্ট। ঘন ঘন বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও নদীভাঙন যেন প্রাত্যহিক বাস্তবতা। বিশেষত উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ প্রকৃতির রোষে প্রায়ই অসহায়। মালদ্বীপ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে অস্তিত্ব সংকটে; অন্যদিকে ভারত ও পাকিস্তানে বায়ু দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেপাল ও ভুটানের পাহাড়ি অঞ্চল ভূমিধস ও বন উজাড়ের কারণে পরিবেশগত ভারসাম্য হারাচ্ছে। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত আফগানিস্তান পরিবেশ রক্ষা ও টেকসই উন্নয়নের পথে এক জটিল সংগ্রামে লিপ্ত।

এই পরিবেশ সংকট মোকাবেলায় আঞ্চলিক সহযোগিতা সময়ের দাবি। প্রতিটি দেশকে নিজেদের সীমানার বাইরে এসে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থা সার্কের কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সার্ক কৃষি কেন্দ্রের কার্যক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকায় অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানটি দক্ষিণ এশিয়ার কৃষিকে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব করার লক্ষ্যে কৃষি গবেষণা, তথ্য ও প্রযুক্তি বিনিময় এবং নীতি সহায়তায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।

জলবায়ু সহনশীল ফসল উদ্ভাবন, অর্গানিক চাষাবাদ, সেচ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, মাটির স্বাস্থ্য উন্নয়ন এবং স্থানীয় জ্ঞানভিত্তিক প্রযুক্তির প্রসারে কেন্দ্রটি একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কৃষকদের প্রশিক্ষণ, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নীতিনির্ধারণী সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে তারা দক্ষিণ এশিয়ার খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার ভবিষ্যৎ রূপরেখা নির্মাণে কাজ করছে।

বিশ্ব পরিবেশ দিবস আমাদের ভাবতে শেখায় পরিবেশ নিয়ে আমাদের আচরণ কতটা দায়িত্বশীল? শুধু রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান নয়, পরিবেশ রক্ষায় নাগরিক পর্যায়ের উদ্যোগও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি, পরিবার, শিক্ষার্থী, তরুণ ও পেশাজীবী সবার সম্মিলিত চেষ্টাই পারে আমাদের চারপাশকে বাসযোগ্য রাখতে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যদি আঞ্চলিক স্বার্থে একযোগে পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে আসে, তবে এই অঞ্চল হতে পারে টেকসই উন্নয়নের একটি আদর্শ রোল মডেল।

আমরা ভুলে যাই, পরিবেশ আমাদের প্রতিপক্ষ নয়, আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি। এই ভিত্তি যদি আমরা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত করি, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না। তাই প্রকৃতির প্রতি যত্নবান হওয়া মানে নিজেদেরই রক্ষা করা। এই বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আমাদের উচিত ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে দায়িত্বশীলতা গ্রহণ করা, সচেতনতা ছড়ানো এবং পরিকল্পিতভাবে পরিবেশ রক্ষায় অবদান রাখা।

লেখক: সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার, সার্ক কৃষি কেন্দ্র, বাংলাদেশ।