এগ্রিলাইফ২৪ ডটকম: বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফেনী ও নোয়াখালী জেলা। দুই জেলার ৯০ শতাংশেরও বেশি মানুষ বন্যায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ধ্বংস হয়েছে ৪৮ শতাংশ বাড়ি ঘর। এছড়াও দুই জেলার স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও সুপেয় পানির সুবিধা শতভাগ অচল হয়েছে। মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর চলমান বন্যা নিয়ে অক্সফ্যাম ইন বাংলাদেশের প্রকাশিত জরুরি চাহিদা নিরূপণ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদন বলছে, বন্যার পানি ধীরে ধীরে নামতে শুরু করায়, বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর ক্ষতচিহ্ন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দুর্গতদের মধ্যে জীবিকা হারানো এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দুই জেলার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর ৭২ শতাংশ প্রতিদিন দুইবেলা খেতে পারছে, যা পর্যাপ্ত নয়। স্যানিটেশন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় খোলা জায়গায় মলত্যাগ বাড়ছে, যা ডায়রিয়া ও কলেরার মতো পানিবাহিত রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এসব রোগে অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন।
ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার বন্যাদুর্গত হোসনে আরা (৩৮) নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, 'বন্যার সময় পরিবার নিয়ে আমরা ছাদে থাকতাম। আমাদের কাছে বিশুদ্ধ খাবার পানি বা খাবার; কিছুই ছিল না। টয়লেটও ডুবে গিয়েছিল, এক্ষেত্রে মেয়েদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিশ্চিত সম্ভব হতো না। আমরা কেবল রাতের বেলা শাড়ি দিয়ে ঘিরে টয়লেটের কাজ সারতাম। অনেকেই অসুস্থ হয়ে যেতো, কিন্তু এছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। এই বন্যা আমাদের সবকিছু শেষ করে দিয়েছে।'
ভয়াবহ বন্যায় ফেনীর আব্দুল করিম (৫২) জীবিকা ও ঘরবাড়ি সব হারিয়েছেন, 'এবারের মতো ভয়াবহ বন্যার পানি আগে দেখিনি।'
হোসনে আরার মতো করিমও ও বন্যায় পরিবার নিয়ে ঘরের ছাদে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তার ছোট একটি সবজির দোকান ছিল, যা তার পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস, সেটি নষ্ট হয়ে গেছে বন্যায়। এখন সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করতে হবে তাকে।
অক্সফ্যাম ইন বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর আশিষ দামলে বাংলাদেশের বন্যা সম্পর্কে বলেন, 'সাম্প্রতিক সময়ে এমন পরিস্থিতি বাংলাদেশে আগে দেখা যায়নি। বন্যায় লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরবাড়ি ও কৃষিজমি ডুবে গেছে। জীবিকা হারিয়েছে লাখ লাখ মানুষ। গবাদিপশুর ক্ষয়ক্ষতি, দুর্গত জনগোষ্ঠীদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছে।'
গত ২০ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া এই বন্যায় ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ ১১ জেলার বিশাল অংশ পানির নিচে তলিয়ে গেছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৫ লাখেরও বেশি মানুষ এবং প্রায় ৫৮ লাখ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অবকাঠামো, বাড়িঘর, কৃষি ও মৎস্যখাত। এসব ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে দুর্গত জনগোষ্ঠীদের জরুরি ও ধারাবাহিক মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। বিশেষ করে দুর্গত জনগোষ্ঠীদের জন্য জরুরিভাবে বিশুদ্ধ খাবার পানি, নগদ অর্থ সহায়তা, খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীর প্রয়োজন। মধ্যমেয়াদে ঘরবাড়ি মেরামত, পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার এবং খাদ্য উৎপাদনে কৃষি উপকরণ সরবরাহ এবং দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও টেকসই সমাধানে ওয়াশ সুবিধা (পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা) নিশ্চিত করা, কমিউনিটি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ এবং আয়মূলক কার্যক্রম প্রচার করা জরুরি।
বন্যার শুরু থেকেই অক্সফ্যাম বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে জরুরি সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বন্যাকালে দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানি, শুকনো খাবার, ওরস্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিরতণ এবং মোবাইল চার্জিং স্টেশন সহায়তা প্রদান করেছে। এই মুহূর্তে অক্সফ্যাম ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে ভেঙ্গে পড়া ঘরবাড়ি পুনঃনির্মাণ, নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী প্রদান এবং খাদ্য সরবরাহ করার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। তবে বন্যার ক্ষয়ক্ষতির অবস্থার তুলনায় তাৎক্ষনিক ও দীর্ঘমেয়াদী প্রয়োজন মেটাতে আরও বেশি সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে।
আশিষ দামলে এ বিষয়ে বলেন, 'আমাদের মতো সংস্থাগুলো যদি এসব বন্যাকবলিত মানুষের পাশে না দাঁড়ায়, তাহলে সংস্থাগুলোর অস্তিত্বই অর্থহীন। আমাদের যতটুকু আছে তা নিয়েই বন্যার্তদের সহায়তা করতে হবে। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি বন্যাকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছি। বিশেষ করে বন্যা পরবর্তী সময়ে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা ও নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবস্থা পুনঃনির্মাণ এসব ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর পুনরুদ্ধারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।'