ব্যাটারী চালিত অটোরিক্সা ও ইজিবাইক, স্বাস্থ্য ও পরিবেশের হুমকি !

সমীরণ বিশ্বাস: সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইক । এসব যানবাহন চার্জ করতে বৈধ-অবৈধ উপায়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য গ্যারেজ। প্রতিদিন বিদ্যুতের একটি বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে এসব যানবাহনের পেছনে। অথচ বিদ্যুতের অপচয় বাড়লেও তা বন্ধে নেই কোন তৎপরতা।

বগুড়া শহরসহ, সিটি করপোরেশনের হিসাবে খুলনায়, রাজশাহী মহানগরীতে এবং একই অবস্থা বরিশাল, সিলেট, রংপুর, টাঙ্গাইল, লক্ষ্মীপুর, সাতক্ষীরা, পাবনাসহ সারাদেশেই। অনুমতিহীন এসব যানবাহন বন্ধ করা গেলে বিদ্যুত অপচয়ের একটি বড় অংশই বাঁচানো সম্ভব বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা। ব্যাটারি চালিত এসব যানবাহনের ওপর বুয়েটের গবেষণা দেখা যায় ,দেশে প্রায় ১০ লাখের বেশি ব্যাটারিচালিত যানবাহনে দিনে বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে অন্তত এক হাজার মেগাওয়াট।

বেসরকারী বিভিন্ন সংগঠনের তথ্য হলো ইজিবাইকের সংখ্যা ১১ লাখের বেশি। ব্যাটারিচালিত রিক্সাসহ নতুন নতুন মডেলের আরও কিছু ব্যাটারিচালিত পরিবহন রয়েছে। শুধু ইজিবাইকই আমদানি করা হয়েছে ১০ লাখের বেশি। সব মিলিয়ে ঢাকায় তিন চাকার যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। সারা দেশে বর্তমানে ব্যাটারিচালিত ৪০ লাখ ইজিবাইক ও অটোরিকশা রয়েছে বলে গত ফেব্রুয়ারিতে সংসদে জানিয়েছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী। ঢাকায় এই সংখ্যা ১২ লাখের বেশি। এর মধ্যে ১০ লাখ রিকশা বাকি ২ লাখ ইজিবাইক। ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত তিন চাকার গাড়িকে নিবন্ধন দেয় না সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।

ব্যাটারি চালিত রিক্সা দূষণের বড় সমস্যা হলো, এখন যেসব ব্যাটারিচালিত যান চলছে সেগুলো লেড অ্যাসিড ব্যাটারির, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বলা হচ্ছে, এগুলো ২০২৫ সাল নাগাদ শেষ হয়ে যাবে এবং এমন সব যানই তখন লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির প্রযুক্তিতে চলে যাবে এবং তখন এসব পরিবহন পরিবেশবান্ধব হয়ে উঠবে। আর ও বিপদজনক খবর হলো মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া ব্যাটারিগুলি যেখানে -সেখানে ফেলে দেওয়া হয়। বিষাক্ত কিছু ধাতু দিয়ে প্রস্তুত করা হয় ব্যাটারি এর মধ্যে আছে নিকেল, ক্যাডমিয়াম,পারদ, সীসা এগুলো পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যর জন্য খুবই ক্ষতিকারক।

এক গবেষণায় জানা গেছে,মেয়াদহীন বা Expired Battery গুলোও পরিবেশের উষ্ণতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ব্যাটারিগুলো মাটির বাস্তুসংস্থানের উপর ও প্রভাব ফেলে, বিভিন্ন ভাবে বায়ু দূষণ করে Photochemical smog’র মাধ্যমে।আলোক ধোঁয়াশা বা Photochemical smog হয় সূর্যালোক আর ফেলে দেওয়া এসব মেয়াদহীন ব্যাটারির সাথে বিক্রিয়ায়, যা মানব স্বাস্থ্য ছাড়াও গাছপালা ,পশুপাখির জন্য ক্ষতিকারক। এই ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকগুলো মানুষের অগোচরে জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের অকল্পনীয় সর্বনাশ করে যাচ্ছে। খরচ কম, তাই জনগণ ব্যবহার করছে কিন্তু এর ফলাফল কেউ ভাবছে না।

ব্যাটারিতে ব্যবহৃত সিসা ধ্বংস হয় না বরং প্রকৃতিতে থেকে যায় । এসব রিকশার অচল ব্যাটারি ভেঙে সিসা বের করার জন্য শিশু ও দরিদ্র মানুষদের নিয়োজিত করে কিছু কোম্পানি যার মালিকদের ধরা যায় না। শ্রমিকরা ব্যাটারি ভেঙে ভেতরের সিসা পরিষ্কার করতে পানি ব্যবহার করেন। সেই পানি নদী-নালা, খাল-বিল ও কৃষি জমিতে ছড়িয়ে পড়ে পানি ও মাটি দূষণ করে। এই দূষিত পানির জলাশয়ে বেড়ে ওঠা মাছের শরীরে সিসা প্রবেশ করে। আবার সিসাযুক্ত পানি কৃষি কাজে ব্যবহার করলে খাদ্য চক্রের মাধ্যমে সিসার কণা মানবদেহে ও পশু-পাখির শরীরে প্রবেশ করে। ব্যাটারিচালিত প্রতিটি বাহন বছরে “কমপক্ষে ৩০০ কেজি সিসা পরিবেশে যোগ করছে” “সেই হিসাবে ১০ বছরে ৪০ লাখ যানবাহনের মাধ্যমে ১২ বিলিয়ন কেজি সিসা যোগ হচ্ছে।

ব্যাটারী চালিত রিক্সা ও অটোরিক্সা, জনগণ ও ভবিষ্যৎ সরকারের জন্য এক বিপদ সংকেত ! স্বাস্থ্য ও পরিবেশের অকল্পনীয় ক্ষতি কারন ব্যাটারিচালিত রিকশা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মত। ব্যাটারিচালিত অবৈধ অটোরিকশার বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর আগে, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকারের উচিৎ যত দ্রুত সম্ভব আইন করে এবং আইনের বাস্তব প্রয়োগ করে ব্যাটারী চালিত রিক্সা ও অটোরিক্সা বন্ধ করে সৌর বিদ্যুৎ চালিত রিক্সা ও অটোরিক্সা প্রযুক্তি ব্যবহারে চালকদেরকে সহায়তা করা, নইলে দেশের মানুষ ও সরকারের কপালে কঠিন দুঃখ আছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা ।

লেখক:কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ