ড. মোঃ মাহফুজ আলম ও মোছাঃ আরিফুন্নাহারঃ তরমুজ একটি অত্যন্ত রসালো ও পুষ্টিকর জনপ্রিয় ফল। বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া তরমুজ চাষের জন্য খুবই উপযোগী। চাষাবাদ পদ্ধতি সবজির মত হওয়ায় এবং সেচ কম লাগে বিধায় কৃষকেরা বোরো মৌসুমে ধানের পরিবর্তে বানিজ্যিকভাবে তরমুজের চাষ করছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ পর্যন্ত ২০ এর অধিক তরমুজের রোগ সনাক্ত হয়েছে। রোগগুলো বিভিন্ন ধরনের জীবাণু যেমন- ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও নেমাটোড দ্বারা হয়ে থাকে। এ রোগগুলোর মধ্যে ছত্রাকজনিত ঢলে পড়া রোগ তরমুজের সবচেয়ে বেশী ক্ষতিসাধন করে থাকে।
তরমুজের ঢলে পড়া রোগ (Fusarium Wilt) হলো একটি মাটিবাহিত ছত্রাকজনিত রোগ যা Fusarium oxysporum f. sp. niveum নামক ছত্রাকের আক্রমনে ঘটে। এটি মূলত তরমুজ গাছের শিকড় ও শাখায় আক্রমণ করে এবং গাছের ভেতরে পানি ও পুষ্টির প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। ফলস্বরূপ, গাছ দ্রুত ঢলে পড়ে, শুকিয়ে যায় এবং ফসলের উৎপাদনশীলতা ও মান কমে যায়। ঢলে পড়া রোগ তরমুজের শিকড় থেকে গাছের পুরো অংশে ছড়িয়ে পড়ে এবং দ্রুত ফসলের ক্ষতি করে, যা তরমুজ চাষে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
তরমুজ গাছের এই ঢলে পড়া রোগ বিশেষত উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ঢলে পড়া রোগ অনুকূল পরিবেশে যথাক্রমে, ১০০% পর্যন্ত ফসলের ক্ষতি সাধন করতে পারে। ২০১৮ সালে নোয়াখালী সুবর্ণচরে এই রোগের আক্রমণে প্রায় ৩০-৭০% তরমুজের মাঠ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। এছাড়াও বিগত ২০১৯-২০২৩ বছরে কেজিএফ এর অর্থায়নে বিএআরসি ও বারি পরিচালিত গবেষণায় সারা বাংলাদেশে প্রধান তরমুজ উৎপাদনের জেলাগুলোতে যেমন, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, ভোলা, খুলনা, কক্সবাজার, চুয়াডাঙ্গা, গোপালগঞ্জ, নাটোর, পঞ্চগড় ও সিলেটে এ রোগের ব্যাপকতা ২০-৬৩% পরিলক্ষিত হয়। সঠিক পরির্চযা ও সমন্বিত রোগ দমন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ রোগ দমন করে তরমুজের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
রোগের কারণ
তরমুজের ঢলে পড়া রোগের মূল কারণ Fusarium oxysporum f. sp. niveum নামক ছত্রাক, যা মাটিতে সহজেই বিদ্যমান থাকে এবং জমিতে একবার সংক্রমণ ঘটলে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। এই ছত্রাকটি মাটির গভীরে অবস্থান করে এবং উদ্ভিদের শিকড়ের মাধ্যমে গাছের ভেতরে প্রবেশ করে। গাছের শিরাগুলিতে অর্থাৎ জাইলেমকে নষ্ট করে পানি ও পুষ্টির প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে এবং গাছ ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে ঢলে পড়ে। সংক্রমণের কারণগুলো হলো:
১. সংক্রমিত মাটি: Fusarium ছত্রাকটি মাটিতে উপস্থিত থাকে এবং বছরের পর বছর বেঁচে থাকতে পারে। এটি মাটির মাধ্যমে গাছের শিকড়ে প্রবেশ করে এবং সেখান থেকে গাছের পানি ও পুষ্টি প্রবাহ বন্ধ করে দেয়, যার ফলে গাছ ঢলে পড়ে।
২. সংক্রমিত বীজ: সংক্রমিত বীজ বা চারা ব্যবহার করলেও এই ছত্রাক ছড়িয়ে পড়তে পারে।
৩. আক্রান্ত গাছের অবশিষ্টাংশ: সংক্রমিত গাছ থেকে অবশিষ্টাংশ যদি জমিতে থেকে যায়, তবে তা নতুন ফসলের জন্য রোগের উৎস হয়ে ওঠে।
৪. মানুষ ও কৃষি যন্ত্রপাতি: মাঠে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও চাষিরা আক্রান্ত মাটির সংস্পর্শে আসার ফলে অন্য মাঠেও ছত্রাকটি ছড়াতে পারে।
অনুকূল আবহাওয়া
তরমুজের ঢলে পড়া রোগের বিস্তারে কিছু নির্দিষ্ট আবহাওয়াগত কারণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ রোগের সংক্রমণ ও বিস্তারের জন্য উষ্ণ ও আর্দ্র পরিবেশ সবচেয়ে বেশি সহায়ক। নিচে এই রোগের বিস্তারের জন্য সহায়ক আবহাওয়াগত কারণগুলো হলো:
১. উষ্ণ আবহাওয়া: তাপমাত্রা ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এই ছত্রাকের জন্য আদর্শ। উষ্ণ আবহাওয়ায় Fusarium ছত্রাকের স্পোর সক্রিয় থাকে এবং দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়।
২. উচ্চ আর্দ্রতা: Fusarium ছত্রাকের বিস্তার ও বৃদ্ধি বাড়াতে মাটির আর্দ্রতা সহায়ক। বিশেষ করে বৃষ্টির পানি বা অতিরিক্ত সেচ দেওয়ার সময় মাটিতে আর্দ্রতা বেশি থাকলে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।
৩. পানির স্থিতি: মাঠে পানি জমে থাকলে এবং নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকলে Fusarium ছত্রাকের জন্য সংক্রমণের আদর্শ পরিবেশ তৈরি হয়।
৪. মাটির পিএইচ মান: Fusarium ছত্রাক সামান্য অম্লীয় বা নিরপেক্ষ পিএইচ মানে দ্রুত বিস্তার লাভ করে। মাটির পিএইচ মান ৬.০ থেকে ৬.৫ হলে ছত্রাকের সক্রিয়তা বেশি দেখা যায়।
ক্ষতির প্রকৃতি
তরমুজের ঢলে পড়া রোগের কারণে গাছের যে ক্ষতি হয় তা হলো:
১. শিকড়ের ক্ষতি: এই ছত্রাকটি প্রথমে গাছের শিকড়ে প্রবেশ করে এবং শিকড়ের পানি ও পুষ্টি পরিবহন ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়, যার ফলে গাছের উপরিভাগে পুষ্টির অভাব দেখা দেয় এবং গাছ ঢলে পড়ে (চিত্রঃ ১) ।
২. কাণ্ডের ভেতরে ছত্রাকের বিস্তার: Fusarium ছত্রাক কাণ্ডের ভেতরে প্রবেশ করে এবং ভাসকুলার বা শিরা কোষগুলির মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, ফলে গাছের পুরো অংশে পুষ্টি সঞ্চালন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় (চিত্রঃ২)।
৩. পাতা ও শাখার হলদে রং ধারণ: গাছের কাণ্ড এবং শিকড় থেকে পানি ও পুষ্টির সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পাতাগুলি হলদে হয়ে যায় এবং ম্লান হয়ে যায়। গাছের শাখা-প্রশাখা শুকিয়ে পড়ে এবং গাছটি মারা যায় (চিত্রঃ৩)।
৪. ফসল উৎপাদনে প্রভাব: ঢলে পড়া রোগের কারণে তরমুজ গাছ সম্পূর্ণ মরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এতে ফলন ব্যাপকভাবে হ্রাস পায় এবং তরমুজের গুণগত মান নষ্ট হয়।
দমন ব্যবস্থাপনা
তরমুজের ঢলে পড়া রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু কার্যকর ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা যেতে পারে। নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো ঢলে পড়া রোগের বিস্তার রোধ ও তরমুজ গাছকে সুরক্ষিত রাখতে সহায়তা করতে পারে:
১. শস্যাবর্তন (Crop Rotation)
ফসল চক্র বা ক্রপ রোটেশন পদ্ধতি অবলম্বন করা হলে Fusarium ছত্রাকের কার্যক্রম কমে যেতে পারে। একই জমিতে একাধিকবার তরমুজ চাষ না করে অন্য ফসলের সাথে চক্র করে চাষ করা উচিত। এটি Fusarium ছত্রাকের বিস্তার রোধ করে এবং জমিতে ছত্রাকের কার্যক্রম কমাতে সহায়ক হয়।
২. মাটি শোধন
মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে মাটির পিএইচ লেভেল সমন্বয় করা এবং ক্ষারীয়তা বৃদ্ধি করা যেতে পারে, কেননা Fusarium ছত্রাক সাধারণত অম্লীয় মাটিতে বেশি সক্রিয় থাকে। এ ছাড়াও মাটিতে জৈব সার বা পচনশীল পদার্থ যোগ করা যেতে পারে, যা মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করে এবং ছত্রাকের কার্যক্রম কমায়।
৩. সূর্যকিরণ দ্বারা মাটি জীবাণুমুক্তকরণ (Soil Solarization)
এটি একটি কার্যকর পদ্ধতি যেখানে সরাসরি সূর্যের তাপ ব্যবহার করে মাটি জীবাণুমুক্ত করা হয়। এ পদ্ধতিতে জমির উপরে প্লাস্টিকের কালো পলিথিন দিয়ে ঢেকে রেখে সূর্যকিরণ দ্বারা মাটি জীবাণুমুক্ত করা।
৪. পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ (Clean cultivation)
চাষাবাদ শুরুর আগে এবং পরে জমি পরিষ্কার রাখতে হবে এবং আগের ফসলের অবশিষ্টাংশ যেমন গাছের পাতা বা শিকড় জমিতে না রাখার চেষ্টা করতে হবে। জমিতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখলে Fusarium ছত্রাকের বিস্তার কম হয়।
৫. যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত করা
চাষের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি যেমন কোদাল, লাঙল ইত্যাদি জীবাণুমুক্ত করে রাখা উচিত, যাতে সংক্রমিত মাটি বা উদ্ভিদ থেকে Fusarium ছত্রাক ছড়াতে না পারে। জমিতে চাষের সময় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত করলে রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
৬. উঁচু বেড ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা
উঁচু বেড ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা তৈরির ২-৩ দিন পর বেড তৈরি করতে হবে। বীজ বা চারা রোপনের পূর্বে জমি প্রয়োজন মত চাষ ও মই দিয়ে বেড তৈরি করতে হবে। জমি তৈরির পর ২মিঃ প্রস্থ -দৈর্ঘ্য এবং ২০-২৫ সে:মি: উচ্চতা বিশিষ্ট বেড তৈরি করতে হবে। উঁচু বেড তৈরি করলে অসময়ে বৃষ্টিপাত ও অধিক বৃষ্টির দরুন গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকে না। ফলে ঢলে পড়া রোগের আক্রমণ কম হবে। বৃষ্টি ও সেচের পানি দ্রæত নিষ্কাশনের জন্য দুই বেডের মাঝখানে ৭৫-১০০ সে:মি: প্রসস্থ সেচ ও নিষ্কাশন নালা রাখতে হবে ।
৭. জৈবিক নিয়ন্ত্রণ (Biological Control)
মাটিতে Trichoderma spp., Bacillus subtilis এবং Pseudomonas florescense নামক উপকারী জীবাণু প্রয়োগ করে Fusarium ছত্রাকের কার্যকলাপ কমাতে সহায়ক হতে পারে। এই উপকারী জীবাণু Fusarium ছত্রাকের বৃদ্ধি প্রতিরোধ করে এবং মাটিতে Fusarium ছত্রাকের বিস্তার সীমিত রাখে। মাটির স্বাস্থ্য উন্নয়নে এবং Fusarium wilt রোগ নিয়ন্ত্রণে জৈব সার যেমন ট্রাইকস্ট, বায়োর্ডামা ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে মাটির পুষ্টি উপাদান বৃদ্ধি পায় এবং ছত্রাকের কার্যক্রম কমানো যায়।
৮. ছত্রাকনাশক (Fungicide)
তরমুজের ঢলে পড়া রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্বেন্ডাজিম, ম্যানকোজে্ব, এজক্সিস্ট্রোবিন বা কপার অক্সিক্লোরাইড জাতীয় ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে ছত্রাকনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরিমাণ ও ব্যবহারের নিয়ম মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৯. সমন্বিত ব্যবস্থাপনা (Integrated Management)
সমন্বিত ব্যবস্থাপনার জন্য প্রথমে বীজ শোধন করে শোধিত মাটির পলিব্যাগে বীজ বপন করে মশারির ভিতরে চারা উৎপাদন করতে হবে। জমির মাটিতে বায়ো ফিউমিগেশন করে নিতে হবে এবং বেড উঁচু ও উপযুক্ত নিষ্কাশন ব্যবস্থা রাখতে হবে। মাদাতে জৈব ছত্রাক নাশক প্রয়োগ করতে হবে, মালচ পেপার দিয়ে বেড ঢেকে দিতে হবে এবং শুধুমাত্র মাদা বরাবর ৪- ৬ সে.মি. ব্যাসের ছিদ্র করে নিতে হবে। মাঠে চারা রোপনের ১৫-২০ দিন পর জৈব বালাইনাশক প্রয়োগ করতে হবে, পরিমিত সেচ দিতে হবে এবং রোগের লক্ষণ দেখা দিলেই তাৎক্ষনিক ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
উপসংহার
তরমুজের ঢলে পড়া রোগ নিয়ন্ত্রণে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। ঢলে পড়া রোগের কারণে তরমুজ চাষিরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হন এবং ফসলের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়। সঠিক পরিচর্যা, ফসল চক্র পদ্ধতি, প্রতিরোধী জাত ব্যবহার, সঠিক সেচ ব্যবস্থাপনা, এবং উপযুক্ত ছত্রাকনাশক প্রয়োগের মাধ্যমে এই রোগের প্রভাব কমানো সম্ভব।
লেখকঃ
ড. মোঃ মাহফুজ আলম,
প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (শস্য),
বিএআরসি, ঢাকা।
ও
মোছাঃ আরিফুন্নাহার,
ঊর্দ্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা,
উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, বারি, গাজীপুর।