এগ্রিলাইফ২৪ ডটকম: মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, কৃষি ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা আজকের দিনে অপরিহার্য। টেকসই কৃষি ও মৎস্য ব্যবস্থাপনায় নারীরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে, এবং আমাদের সেই সুযোগগুলো করে দিতে হবে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা নতুন বাংলাদেশের সন্ধান পেয়েছি। শিক্ষক, গবেষক, শিক্ষার্থী ও নীতিনির্ধারক সবাই মিলে নতুনভাবে দেশের কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতকে এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখতে হবে। আমাদের কৃষি গ্র্যাজুয়েটরা কীভাবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে নিত্য নতুন ভ্যারাইটি উদ্ভাবন করে দেশকে এগিয়ে নিতে পারে সে লক্ষে আমাদের কাজ করতে হবে।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিকৃবি) মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের উদ্যোগে তিন দিন ব্যাপী ৩য় ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স ফর সাসটেইনেবল ফিশারিজ (আইসিএসএফ) শীর্ষক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধান অতিথি বলেন, বাংলাদেশের প্রায় ৮০% হাওরই সিলেট অঞ্চলে অবস্থিত। এই হাওর শুধু মাছের জন্য নয়, গরু-ছাগলসহ অন্যান্য প্রাণিসম্পদের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই হাওরকে ঘিরে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা আমাদের জাতীয় অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। একইসাথে আমাদের স্থানীয় মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ করা দরকার। কারণ স্থানীয় মাছের বৈচিত্র্যই আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আমাদের জোর দিতে হবে নিরাপদ মৎস্যচাষের উপর। পানিতে যেন অ্যান্টিবায়োটিক বা কীটনাশকের মাত্রা বেড়ে না যায়, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। হাওড়ের কৃষিকে কীটনাশক, বালাইনাশক মুক্ত করতে হবে। সম্পূর্ন বালাইনাশক মুক্ত করা না গেলেও অন্তত নিয়ন্ত্রনের ব্যবস্থা করতে হবে কারণ স্বাস্থ্যকর ও টেকসই মাছ উৎপাদন নিশ্চিত করা ছাড়া আমাদের সামনে কোনো বিকল্প নেই। আমরা জানি, ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে অতিরিক্ত আহরণ, নদীর নাব্যতা হ্রাস ও দূষণের কারণে ইলিশ উৎপাদন হুমকির মুখে। আমাদের ইলিশকে বিশেষ প্রাধান্য দিতে হবে। মৎস্য খাতকে এগিয়ে নিতে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
আজ ৫ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদীয় ডিন এবং আইসিএসএফ এর চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. নির্মল চন্দ্র রায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বক্তব্য রাখেন সিকৃবির ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মোঃ আলিমুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার প্রফেসর ড. এ.টি.এম. মাহবুব-ই-ইলাহী, বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মোঃ আবদুর রউফ, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. অনুরাধা ভদ্র, সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, পূবালী ব্যাংক পিএলসি এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আলী, আইসিএসএফ-এর সদস্য-সচিব প্রফেসর ড. মো. সাখাওয়াত হোসেন প্রমুখ।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন ফিশারিজ অ্যান্ড একোয়াকালচার বিভাগের প্রফেসর ড. মোঃ আব্দুল ওয়াহাব।
প্রধান পৃষ্ঠপোষকের বক্তব্যে সিকৃবি ভিসি প্রফেসর ড. মোঃ আলিমুল ইসলাম বলেন, বর্তমান বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় টেকসই উন্নয়নের জন্য মৎস্য ও একোয়াকালচারের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ, যেখানে মাছ কেবল আমাদের পুষ্টির অন্যতম উৎসই নয়, বরং অর্থনীতিরও বড় চালিকা শক্তি। তাই “ইনোভেটিভ সলিউশন্স ফর রেজিলিয়েন্ট ফিশারিজ অ্যান্ড একোয়াকালচার” এই সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য আমাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
তিনি বলেন, দেশি-বিদেশি গবেষক, নীতিনির্ধারক, উদ্যোক্তা ও শিক্ষাবিদদের অভিজ্ঞতা ও গবেষণালব্ধ জ্ঞান বিনিময়ের মাধ্যমে এই সম্মেলন আমাদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। বিশেষ করে টেকসই মৎস্য সম্পদ ব্যবস্থাপনা, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, জলবায়ু সহনশীল প্রজাতি উন্নয়ন এবং উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। আমরা চাই আমাদের সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শুধু বাংলাদেশেই নয়, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও মৎস্য এবং কৃষিশিক্ষা ও গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখুক।
প্রধান অতিথি বলেন, হাওর হলো জীববৈচিত্র্যের ভাণ্ডার। হাওরের এই ডাইভারসিটি সংরক্ষণ করা একান্ত জরুরী। পরিবেশের ক্ষতি না করে হাওড়ের উন্নয়ন করতে হবে। দেশের মানুষের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হলে প্রয়োগিক নীতিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুগোপযোগী সংস্কারের মাধ্যমে এগিয়ে নিতে হবে। আমরা সবাই জানি হাওর আসলে একটি মাছের খনি। অথচ ক্রমাগত মাছের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। এর পেছনের কারণ খুঁজে বের করা এবং সমাধান করা এখন সময়ের দাবি। সেই প্রেক্ষিতে হাওর গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে, যেখানে আমাদের গবেষকরা সমস্যার সমাধান খুঁজবেন। আমাদের শিক্ষক ও গবেষকরা ইতিমধ্যেই টেকনোলজি উদ্ভাবন করছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন যা দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমরা চাই বাংলাদেশও এ খাতে বৈশ্বিক নেতৃত্ব দিক।
তিনি আরও বলেন, চায়না বা কারেন্ট জাল ব্যবহার করে যারা মাছ ধরে তারা প্রকৃত মৎস্যজীবী নন। কারণ এভাবে মাছ ধরা শুধু অবৈধই নয়, বরং মাছের প্রজনন ও উৎপাদন ধ্বংস করে দেয়।সবশেষে তিনি বলেন, মাছে ভাতে বাঙালি শুধু আমাদের পরিচয় নয়, এটি আমাদের ঐতিহ্য ও ভবিষ্যতের শক্তি। আসুন, সবাই মিলে কাজ করি যাতে আমরা হতে পারি মাছ রক্ষাকারী বাঙালি।
উল্লেখ্য, সম্মেলনে ইটালী, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, চীন, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাচঁ শতাধিক গবেষক ও বিজ্ঞানী অংশগ্রহণ করছেন। সম্মেলনে ১১টি সেশনে প্রায় আড়াই শতাধিক বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হবে।