তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন-গণতন্ত্রের নতুন সূচনা

কৃষিবিদ ডা. শাহাদাত হোসেন পারভেজ: বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারেক রহমানের মত খুব কম নেতার জীবন ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা- রাষ্ট্র এবং গণতন্ত্রের সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। এই সম্পর্ক শুধু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি তার শৈশব, পারিবারিক শিক্ষা, সংগ্রাম, কারাবাস, নির্বাসন এবং দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিযানের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে।

আগামী ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, দীর্ঘ ১৮ বছর নির্বাসনের পর তারেক রহমান দেশে ফিরছেন। এটি কেবল একজন নেতার দেশে ফেরার গল্প নয়; এটি একটি গণতান্ত্রিক সংস্কারের নতুন সূচনা এবং তৃণমূলক রাজনৈতিক শক্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠা। ইতিহাসের প্রতিটি মুহূর্তে বিএনপির নেতা ও জনগণের কাছে তার নেতৃত্ব গণতন্ত্র ও নীতিনিষ্ঠতার প্রতীক হিসেবে প্রতিফলিত হয়েছে।

শৈশব ও পরিবার: গণতন্ত্রের বীজ রোপণ
তারেক রহমানের জন্ম ১৯৬৫ সালের ২০ নভেম্বর। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান এবং তিনবার নির্বাচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান। শৈশব কেটেছে মা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে, স্বাধীনতার উত্তাল সময়ে। যদিও তিনি কারাগারে ছিলেন না, কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের অন্তরীণ অবস্থায় কাটানো সময় তাঁকে রাষ্ট্র, স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের মূল্য বুঝতে শেখায়।

শিশুকালে এই অভিজ্ঞতা তাকে রাজনীতিকে কেবল ক্ষমতার লড়াই হিসেবে দেখার পরিবর্তে একটি মানবিক ও নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণের শিক্ষা দিয়েছে। পরিবার তাঁকে সামাজিক দায়বোধ, নৈতিকতা এবং গণমানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা শিখিয়েছে। এই মানবিক বোধই পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনকে শক্তিশালী করে।

তারেক রহমানের ব্যক্তিগত জীবনও এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ। ১৯৯৪ সালে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ডা. জোবায়দা রহমানের সঙ্গে। ডা. জোবায়দা একজন খ্যাতনামা কার্ডিওলজিস্ট, এবং তাদের একমাত্র কন্যা ব্যারিস্টার জাইমা রহমান পেশাগতভাবে আইনজীবী। পরিবারে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং ব্যক্তিগত জীবন সংযতভাবে পরিচালনার দক্ষতা তাঁকে একজন মানবিক ও দূরদর্শী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

শিক্ষা ও চিন্তাধারা: রাজনৈতিক বোধের ভিত্তি
তারেক রহমানের শিক্ষাজীবন ছিল রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা বিকাশের ক্ষেত্র। মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ থেকে এবং উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, প্রথমে আইন বিভাগে এবং পরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, হাবস, লক, রুশো, ভলতেয়ার এবং কার্ল মার্কসের রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হন। এটি তাঁকে কেবল তাত্ত্বিকভাবে রাজনৈতিক চিন্তাশীল করেছে না, বরং গণতন্ত্র, নৈতিকতা এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধের সঙ্গে বাস্তব রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সংযুক্ত করার সুযোগ দিয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়য় জীবনে তিনি দলীয় রাজনীতি, গণসংযোগ এবং সংগঠন শক্তিশালী করার প্রাথমিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মসূচির সংমিশ্রণ তাঁকে দূরদর্শী রাজনীতিক হিসেবে গড়ে তোলে, যার ভিত্তিতে পরে বিএনপি পুনর্গঠনের কৌশল তৈরি হয়।

রাজনৈতিক যাত্রা: তৃণমূল থেকে জাতীয় নেতৃত্ব:
১৯৮৮ সালে তিনি বগুড়ার গাবতলী উপজেলা ইউনিটে সাধারণ সদস্য হিসেবে বিএনপিতে যোগ দেন। তখন থেকেই তিনি তৃণমূলের শক্তি সংগঠিত করা এবং গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ শুরু করেন।

১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে তিনি দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় প্রচারণা চালিয়ে নির্বাচনে বিজয় অর্জনে সহায়তা করেন। তার প্রচেষ্টায় দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। বগুড়ায় গোপন ব্যালটে নেতৃত্ব নির্বাচন করিয়ে তিনি দলীয় গণতন্ত্রের উদাহরণ স্থাপন করেন।

২০০১ সালের নির্বাচনের আগে তিনি ঢাকায় একটি অফিস প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে স্থানীয় সমস্যা সমাধান, সুশাসন ও জনগণের মতামত সংগ্রহের মাধ্যমে দলের নীতি নির্ধারণ করা হত। এই কাজের জন্য তিনি কেন্দ্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ না করে তৃণমূল সংযোগ এবং সংগঠন শক্তিশালী করাকে অগ্রাধিকার দেন।

কারাবাস ও নির্বাসন: ধৈর্যশীল নেতৃত্বের পরীক্ষা
২০০৭ সালের ৭ মার্চ, কোনো পরোয়ানা বা অভিযোগ ছাড়াই তাকে জরুরি বিধিমালার আওতায় গ্রেফতার করা হয়। ৫৫৪ দিনের কারাবাস, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, চিকিৎসাধীন অবস্থায় মুক্তি-এই অভিজ্ঞতা তার নেতৃত্বকে ভেঙে দেয়নি; বরং তাকে ধৈর্যশীল, কৌশলগত এবং দূরদর্শী নেতা হিসেবে আরও শক্তিশালী করেছে।

নির্বাসনের এই দীর্ঘ সময়ে বিএনপির সংগঠন ও আন্দোলন ধরে রাখার ক্ষমতা তারেক রহমানের কৌশলগত নেতৃত্ব ও নীতি-নিষ্ঠতার প্রমাণ। এই সময়ে দলীয় কর্মসূচি, আন্দোলন এবং জনসংযোগকে তিনি অক্ষুণ্ণ রেখেছেন।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন: রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় তাৎপর্য
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ঘটনা কেবল নেতা হিসেবে ফিরে আসা নয়। এটি রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের নতুন চ্যালেঞ্জের সঙ্গে মোকাবিলার সূচনা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্য এবং গণতান্ত্রিক সংস্কারের নতুন মাত্রা যোগ করবে।
নিরাপত্তা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং জনমতের সংমিশ্রণ এই প্রত্যাবর্তনকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। এটি দেশের রাজনৈতিক সংস্কার ও গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃস্থাপনের জন্য একটি কৌশলগত মোড়।

বিএনপির ৩১ দফা ও নির্বাচনী ইশতেহার:
তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফা রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাব এবং নির্বাচনী ইশতেহার কেবল প্রতিশ্রুতি নয়। এটি ভবিষ্যতের রাষ্ট্র কাঠামোর রূপরেখা, যেখানে কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় স্তরের সুশাসন নিশ্চিত করা হয়েছে।

মূল হাইলাইটস: ফ্যামিলি কার্ড, পরিবারকে খাদ্য, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সুরক্ষার আওতায় আনা, ভর্তুকি ও সুবিধা সরাসরি পরিবারকে বিতরণ, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য ও ভর্তুকি নিশ্চিত, পশুসম্পদ, মৎস্য ও খামারিদের জন্য বীমা।

শিক্ষা: কর্মসংস্থানমুখী ও মানসম্মত শিক্ষা, শিক্ষিত বেকারদের ভাতা, নারীর শিক্ষায় সমতা আনার বিষয়টি বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহারে রয়েছে।

স্বাস্থ্য: দলটির মূল ইশতেহারে ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আধুনিক হাসপাতাল এবং ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে বিনামূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে ।

দুর্নীতি দমন ও সুশাসন: স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন, বিচার বিভাগের স্বাধিকার ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতা বিএনপির অন্যতম অঙ্গীকার।

রাষ্ট্র সংস্কার: দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল, ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার, বিরোধী দলের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করে রাষ্ট্রকে সংস্কার করবে বিএনপি।

তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন -বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাৎপর্য ও প্রভাবঃ
তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি মৌলিক মোড়। দীর্ঘ সময়ের রাজনৈতিক নিপীড়ন, নির্বাসন এবং দলের ওপর পরিকল্পিত হামলা সত্ত্বেও তিনি বিএনপিকে পথ হারাতে দেননি। এটি শুধু নেতা হিসেবে তার শক্তি নয়, বরং দল, গণতন্ত্র এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রমাণ।

রাজনীতি এখন শুধু ক্ষমতার লড়াই নয়; এটি মানুষের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক। তারেক রহমানের রাজনৈতিক দর্শন এবং তৃণমূল সংযোগ এই বার্তাই দেয়: শক্তিশালী নেতৃত্ব মানে গণমানুষের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা, নীতি এবং মানবিক দায়িত্ব পালন করা।

উপসংহার: সংগ্রাম, ধৈর্য ও নতুন রাষ্ট্রভাবনার প্রতীক
২৫ ডিসেম্বর ২০২৫ তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন ব্যক্তিগত বা বিএনপির জয় নয়; এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির নতুন সূচনা। সংগ্রাম, ধৈর্য, তৃণমূল সংযোগ, নীতি এবং মানবিক নেতৃত্ব-এই সব মিলিয়ে তিনি কেবল বিএনপির নেতা নন, বরং একটি নতুন রাষ্ট্রভাবনার বহনকারী।