
কৃষিবিদ ডা. শাহাদাত হোসেন পারভেজ: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নারীর অবদান অপরিসীম। তবুও বাস্তবতা হলো যখন কোনো তরুণী মা পর্যাপ্ত শিশু পরিচর্যার সুযোগ না পেয়ে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন, কিংবা কোনো ছাত্রী সন্তান বা পরিবারের দায়ভার সামলাতে গিয়ে পড়াশোনা বন্ধ করে দেন, তখন শুধু একটি পরিবারই নয় সমগ্র দেশ হারায় সম্ভাবনা, উৎপাদনশীলতা ও অগ্রগতি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) ২০২৪ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, পুরুষদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের হার ৮০ শতাংশ, অথচ নারীদের মাত্র ৪৩ শতাংশ। এই বৈষম্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমরা জাতির অর্ধেকেরও বেশি মেধা ও দক্ষতাকে এখনো পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারিনি।
শিশু পরিচর্যা: অর্থনীতির নতুন ভরকেন্দ্র
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান বিশ্বাস করেন এই বৈষম্য দূর করতে হলে কেবল নীতিগত নয়, কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার। তাঁর উদ্যোগে বিএনপি একটি যুগোপযোগী পরিকল্পনা নিয়েছে, যেখানে শিশু পরিচর্যা (childcare) বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কৌশলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে।
এই পরিকল্পনায় রয়েছে—
- দেশের সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন;
- সরকারি অফিসগুলোতে ধাপে ধাপে ডে-কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠার জাতীয় পরিকল্পনা;
- বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও শিল্পকারখানায় বাধ্যতামূলক ডে-কেয়ার সুবিধা নিশ্চিত করা;
- যেসব নিয়োগকর্তা শিশু পরিচর্যার ব্যবস্থা রাখবে, তাদের কর ছাড় ও CSR ক্রেডিট প্রদান; এবং
- নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মান অনুযায়ী কেয়ারগিভারদের প্রশিক্ষণ ও সার্টিফিকেশন চালু করা।
একজন পেশাজীবীর দৃষ্টিতে বাস্তব চিত্র:
একজন পেশাজীবী হিসেবে আমি লক্ষ্য করেছি বর্তমানে দেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৬০ শতাংশ। এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত নারী কৃষিবিদদের একটি বড় অংশ পরবর্তী সময়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারেন না শুধুমাত্র শিশু পরিচর্যা ও সহায়ক পরিবেশের অভাবে। ফলে তাদের শিক্ষাগত বিনিয়োগ ও সম্ভাবনা অনেকাংশেই অপচয় হয়।
জনাব তারেক রহমানের প্রস্তাবিত এই শিশু পরিচর্যা উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে এটি নারী শিক্ষিত জনশক্তির কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াবে এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে এক অসাধারণ অবদান রাখবে।
কেন এটি জরুরি: ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (IFC) ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO)-এর গবেষণায় দেখা গেছে—যেসব কারখানায় শিশু পরিচর্যার সুবিধা রয়েছে, সেখানে কর্মী ধরে রাখার হার বেশি, অনুপস্থিতি কম, এবং প্রতিষ্ঠানগুলো এক বছরের মধ্যেই এই বিনিয়োগের সুফল পায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি কেবল সামাজিক কল্যাণ নয়; এটি অর্থনৈতিক বুদ্ধিমত্তা। এই একটি সংস্কারই নারীর কর্মসংস্থান বাড়াতে পারে, পারিবারিক আয় বৃদ্ধি করতে পারে, এবং জিডিপিতে প্রায় ১ শতাংশ পর্যন্ত যোগ করতে সক্ষম। বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পে, যেখানে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শ্রমিক নারী, সেখানে শিশু পরিচর্যার সুযোগ কর্মক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়াবে।
 “শিশু পরিচর্যা কোনো দয়া নয়, এটি বিনিয়োগ”
তারেক রহমানের ভাষায়, “শিশু পরিচর্যা কোনো দয়া-দাক্ষিণ্য নয়—এটি সামাজিক-অর্থনৈতিক অবকাঠামোর একটি অপরিহার্য অংশ। যেমন সড়ক বাজারকে সংযুক্ত করে, তেমনি ডে-কেয়ার সেন্টার নারীদের কর্মজীবনের সঙ্গে সংযুক্ত করে।”এই ভাবনা নারীর ক্ষমতায়নকে নতুন দৃষ্টিকোণ দেয়—যেখানে সমান মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও শিশুর যত্নকে অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
২০৩৪ সালের লক্ষ্য: অন্তর্ভুক্তিমূলক ট্রিলিয়ন-ডলারের অর্থনীতি:
বিএনপির লক্ষ্য ২০৩৪ সালের মধ্যে এমন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ট্রিলিয়ন-ডলারের অর্থনীতি গড়ে তোলা, যেখানে নারীরা হবে প্রবৃদ্ধির মূল অংশীদার। কর্মজীবী মায়েরা যেন পরিবার ও কর্মজীবনের মধ্যে কোনো একটিকে বেছে নিতে বাধ্য না হন—এটাই এই দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রবিন্দু।
সবশেষে বলা যায়, আমাদের সমাজের অগ্রগতি তখনই টেকসই হবে, যখন প্রতিটি মা, প্রতিটি তরুণী ও প্রতিটি ছাত্রী নিজের সাফল্যের স্বাধীনতা পাবে। শিশু পরিচর্যা, সমান সুযোগ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কেবল ন্যায়সংগত নয় এটি ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম বুদ্ধিবৃত্তিক বিনিয়োগ। এই উদ্যোগের মাধ্যমে তারেক রহমান শুধু নারীর নয়, পুরো জাতির উৎপাদনশীল সম্ভাবনাকে মুক্ত করার পথ দেখাচ্ছেন।
-লেখক: সাংগঠনিক সম্পাদক, ভেটেরিনারি ডক্টরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- ভ্যাব ও সাধারণ সম্পাদক, এ্যাব ঢাকা জেলা চ্যাপ্টার
























