রাষ্ট্রের সন্ধিক্ষণে তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন

প্রফেসর ড. সামিউল তুষার: একটি গণঅভ্যুত্থান কেবল ক্ষমতার পালাবদল নয় এটি রাষ্ট্রকে নতুন করে গড়ার প্রতিশ্রুতি। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের আগেই যদি কর্তৃত্বের শূন্যতা তৈরি হয়, তবে উত্থান রূপ নেয় অরাজকতায়। আজ বাংলাদেশ সেই বিপজ্জনক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে যেখানে সহিংসতা, গুজব ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষয় একসঙ্গে রাষ্ট্রের ভিত নড়বড়ে করে দিচ্ছে।

দীর্ঘ একদলীয় ও ফ্যাসিবাদী শাসনের উত্তরাধিকার হিসেবে বাংলাদেশ আজ এক ভঙ্গুর রাষ্ট্রকাঠামোর মুখোমুখি। ২০২৪ সালের ছাত্র–জনতার নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর প্রফেসর ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার অভূতপূর্ব চাপের মধ্যে কাজ করছে। এই অন্তর্বর্তী মুহূর্তে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো যখন পুনর্গঠনের দাবি জানাচ্ছে, তখনই সহিংসতা ও বিভ্রান্তির ঢেউ সামাজিক শৃঙ্খলাকে চূর্ণ করছে।

শহীদ শরীফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড ছিল সেই অস্থিরতার এক নিষ্ঠুর প্রতীক। তার পরপরই রাজধানীসহ বিভিন্ন অঞ্চলে যে বিক্ষোভ ও তাণ্ডব ছড়িয়ে পড়ে, তা দ্রুতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়। সংবাদমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের কার্যালয়সহ অগ্নিসংযোগ ও হামলার শিকার হয়। এসব ঘটনা শুধু মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত নয়; এটি রাষ্ট্রের নৈতিক কর্তৃত্বের ওপর সরাসরি চ্যালেঞ্জ।

এই সহিংসতাগুলো বিচ্ছিন্ন নয়। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বাড়িতে মব আক্রমণ, ঘরবাড়িতে আগুন, পরিবারের সদস্যদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এসব একত্রে একটি স্পষ্ট চিত্র আঁকে: রাজনৈতিক নোঙরহীন এক রাষ্ট্র। অগ্নিসংযোগে একজন বিএনপি নেতার সাত বছর বয়সী কন্যার মৃত্যু সেই নৃশংসতার চরম উদাহরণ, যা নিরাপত্তাহীনতার গভীরতা উন্মোচন করে।

ময়মনসিংহে এক সনাতন ধর্মাবলম্বী যুবককে মব হত্যার পর তার দেহ গাছে বেঁধে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা সামাজিক সম্প্রীতির ভিত্তিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এ ধরনের বর্বরতা কেবল মানবিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করে না; এটি ধর্মীয় সহাবস্থান ও জাতীয় ঐক্যের ধারণাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।

শারীরিক সহিংসতার পাশাপাশি বাংলাদেশ আজ এক অদৃশ্য যুদ্ধের মুখে। ফেসবুক, এক্স ও ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ভুয়া ছবি, ভিডিও ও গুজব ছড়ানো হচ্ছে। অনেক এআই-জেনারেটেড কনটেন্ট বাস্তবে ঘটেনি, অথচ সেগুলো জনমনে আতঙ্ক ও বিভাজন তৈরি করছে। এই ডিজিটাল বিভ্রান্তি রাষ্ট্রের মনস্তাত্ত্বিক নিরাপত্তাকেও দুর্বল করে দিচ্ছে যেখানে সত্য ও মিথ্যার সীমারেখা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।

এই সবকিছু রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, মব সংস্কৃতি, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, সংবাদমাধ্যমে হামলা ও ডিজিটাল গুজব একত্রে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণক্ষমতাকে ক্ষয়িষ্ণু করে তুলছে। আইন-শৃঙ্খলার ওপর মানুষের আস্থা কমছে, আন্তর্জাতিক পরিসরেও বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা প্রশ্নের মুখে পড়ছে।

গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময় ইতিহাসে বরাবরই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। পুরনো শাসকগোষ্ঠী নতুন মুখোশে ফিরে আসতে চায়, প্রশাসনিক শক্তি সংস্কারকে বাধাগ্রস্ত করে, আর বৈদেশিক শক্তি নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে সুযোগ খোঁজে। এই প্রেক্ষাপটে জাতীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য ও পরীক্ষিত নেতৃত্বের অনুপস্থিতি বিপ্লবকে ব্যর্থ করে দিতে পারে।
এই শূন্যতায় তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন কোনো দলীয় আবেগ নয়; এটি একটি কৌশলগত প্রয়োজন। তিনি কেবল একটি রাজনৈতিক দলের নেতা নন তিনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শনের উত্তরাধিকারী, বহুদলীয় গণতন্ত্র ও জাতীয় সার্বভৌমত্বের ধারক। দীর্ঘ প্রবাসজীবন সত্ত্বেও তিনি দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার কেন্দ্রেই ছিলেন।

তারেক রহমানের দেশে ফেরা মানে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ঝুঁকি জেনেও রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়ানো। ইতিহাসে দেখা যায়, যেসব নেতা সংকটকালে জীবন বাজি রেখে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তারাই জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছেন। ঝুঁকিহীন নেতৃত্ব কখনো রাষ্ট্রের ভাগ্য বদলায় না। বাংলাদেশ আজ সরকার পরিবর্তনের চেয়েও বড় এক পরীক্ষার মুখে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের পরীক্ষা। এই মুহূর্তে নেতৃত্বের শূন্যতা মানেই সার্বভৌমত্বের ঝুঁকি। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী চক্রান্ত থেকে দেশকে রক্ষা করতে, প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষয় রোধ করতে এবং একটি স্বাধীন, আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্র গড়তে হলে জাতিকে একটি দৃঢ় রাজনৈতিক নোঙর দিতে হবে।

তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিকল্প নেই কারণ এটি কোনো ব্যক্তি বা দলের প্রশ্ন নয়। এটি রাষ্ট্রের পুনর্গঠন, জাতীয় ঐক্য এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্ন।

লেখক: সেমিনার বিষয়ক সহ-সম্পাদক, ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাব) কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি।
আজীবন সদস্য, জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন।
সাধারণ সম্পাদক, ইউট্যাব সিকৃবি ইউনিট।
যুগ্ম-সম্পাদক, এ্যাব সিকৃবি চ্যাপ্টার।