নবান্ন উৎসব নিয়ে কিছু কথা; জাতীয় কৃষি দিবসের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি কেন নয়!

ড. এম. আব্দুল মোমিন:দিন আসে দিন যায়, মাস গিয়ে বছর পুরায় কিন্তু ঐতিহ্য সেতো চির অম্লান-অপুরাণ। অর্থাৎ ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি কখনো পুরনো হয় না। বাঙালি গেরস্থ পরিবারে কৃষ্টির অন্যতম অনুসঙ্গ হলো নবান্ন উৎসব। কিন্তু কালের বিবর্তনে আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের প্রাণের উৎসব কে। নবান্ন ঋতুকেন্দ্রিক উৎসব। ‘নবান্ন’ শব্দের অর্থ ‘নতুন অন্ন’। হেমন্তে নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় এ উৎসব পালন করা হয়। অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিন এই উৎসব পালিত হয়। অগ্র অর্থ ‘প্রথম’ আর ‘হায়ণ’ অর্থ ‘মাস’। এ থেকে সহজেই ধারণা করা হয়, একসময় অগ্রহায়ণই ছিল বাংলা বছর গণনার প্রথম মাস। যা হোক, হাজার বছরের পুরোনো এই উৎসব সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক, সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী এবং সবচেয়ে প্রাচীনতম মাটির সঙ্গে চিরবন্ধনযুক্ত। পহেলা অগ্রহায়ণ মানেই ছিল গেরস্থ বাড়িতে উৎসবের আমেজ। নতুন ধানের গন্ধে ম ম উঠান বাড়ি।

একটা ছোট্ট ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। ২০০৭ সালে ১/১১ ঘটনায় রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনে ক্ষমতায় আসে ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের নেতৃত্বে সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকার। বিশ্বব্যাপি নানা অস্থিরতার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে হঠাৎ চালের সরবরাহ কমে যায় এবং চালের মূল্য বেড়ে যায়। প্রধান রপ্তানিকারক দেশগুলোর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা, বড় আমদানিকারক দেশগুলোর আতঙ্কজনক চাল কেনা, দুর্বল মার্কিন ডলার এবং তেলের রেকর্ডমূল্য ছিল সে সময়ে চালের দাম বৃদ্ধির তাৎক্ষণিক কারণ। বাংলাদেশে চাল যেহেতু “রাজেনৈতিক” পণ্য তাই অস্থিরতা এড়িয়ে দেশকে সুস্থির করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিবেশি দেশ থেকে চাল আমদানির উদ্যোগ নেয়।  কিন্তু এ সময় অর্থ দিয়েও চাল কিনতে পারেনি বাংলাদেশ। প্রতিবেশী দেশ ভারত চাল রপ্তানির আশ্বাস দিয়েও প্রতিশ্রূতি রক্ষা করেনি।

সে ঘটনায় তৎকালীন সরকারের বোধোদয় হয়, তাঁরা বুঝতে পারে জাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কৃষিতে গুরুত্ব দেয়ার বিকল্প নেই। এই প্রেক্ষাপটে তারা উপলদ্ধি করেন মাছে-ভাতে বাঙালীর খাদ্য নিরাপত্তা (ভাতের নিরাপত্তা) নিশ্চিত করতে কৃষিতে গুরুত্বারোপ ও উৎপাদন বৃদ্ধির বিকল্প নেই। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পহেলা অগ্রহায়ণ জাতীয় কৃষি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ওই বছর সারাদেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারিভাবে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়। তারপর ২০০৯ সাল থেকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পহেলা অগ্রহায়ণ পালিত হলেও পরবর্তীতে অজানা কারণে দিনটি জাতীয় দিবসের তালিকা থেকে কাটা পড়ে। এমনকি গত বছরের ২১ অক্টোবর জারিকৃত মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক দিবস সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে ৮০টি দিবস পালনের নির্দেশনা থাকলেও স্থান পায়নি জাতীয় কৃষি দিবস।

পৃথিবীর বহু দেশে অনেক আগে থেকেই জাতীয়ভাবে কৃষক দিবস বা কৃষি দিবস পালিত হয়ে আসছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১২ অক্টোবর জাতীয় কৃষক দিবস হিসেবে পালিত হয়। যা পূর্বে প্রবীণ কৃষক দিবস নামে পরিচিত ছিল। সেটি অবশ্য ফসল কাটার শুরুতে নয় মওসুমের সমাপ্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আইওয়াতে ২০০৫ সাল থেকে প্রতিবছর ১০ থেকে ১২ জুলাই তিনদিনব্যাপী কৃষি দিবস পালিত হয়ে আসছে। উত্তর ক্যারোলিনায় ৩১ জুলাই থেকে ২ আগষ্ট তিনদিনব্যাপী ১১ পর্বে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কিমব্যালে ২৭ সেপ্টেম্বর ১৩ পর্বে উদযাপিত হয় কৃষি দিবস। আফগানিস্তানে প্রতি বছর ২২ মার্চ আফগান নববর্ষের (নওরোজ) অংশ হিসেবে কৃষক দিবস পালিত হয়। স্থানীয়ভাবে একে বলা হয় যাসনি দেহকান বা কৃষকের উৎসব। প্রতিবেশি দেশ ভারতে জাতীয় কৃষক দিবস ২৩ ডিসেম্বর। ভারতের ৫ম প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী চরণ সিং যিনি ভারতীয় কৃষকদের সাহায্য করার জন্য অসংখ্য নীতি প্রবর্তন করেছিলেন তার জন্মদিনে পালন করা হয় দিবসটি। এটি ভারতের কৃষি পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক, সেমিনার এবং কর্মশালার মাধ্যমে পালিত হয়ে। পাকিস্তানে কৃষকদের কল্যাণ ও সমৃদ্ধির জন্য ১৯ ডিসেম্বর জাতীয় কৃষক দিবস হিসেবে পালন করা হয় (সূত্র: বাংলাপিডিয়া)। অথচ যে কৃষি আমাদের কৃষ্টির মূল, যে কৃষক আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার অগ্রসৈনিক তাদের ঘিরে একটি দিন পালনে আমাদের কি কার্পন্য! যাদের অক্লাক্ত আন্তরিক পরিশ্রমে আমাদের মুখে অন্ন জোটে তাদের সম্মানে একটি দিন কে জাতীয় কৃষি দিবস হিসেবে পালনের দাবী জানাই।

ফিরে আসি নবান্নের আলোচনায়। জাতীয়ভাবে উদযাপন না করা হলেও দেশের আপমর কৃষক সমাজ অগ্রহায়ণ মাসের প্রথমদিন নবান্ন উৎসব হিসেবে পালন করে। পাহাড়ি জনপদেও নামে জুমের নতুন ধানে নবান্নের আমেজ। উপজাতিরা তাদের প্রধান ফসল ঘরে তোলা উপলক্ষ্যে নবান্ন উৎসব পালন করে। সাঁওতালরা পৌষ-মাঘ মাসে শীতকালীন প্রধান ফসল ঘরে তুলে উদযাপন করে সোহরায় উৎসব। জুম চাষি ম্রো উপজাতি চামোইনাত উৎসবে মুরগি বলি দিয়ে নতুন ধানের ভাতে সবাইকে ভূড়িভোজন করায়। ফসল তোলার পর গারো উপজাতি ফল ও ফসলের প্রাচুর্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে পালন করে পানাহার ও নৃত্যগীতবহুল ওয়ানগালা উৎসব। বাংলার মুসলিম কৃষক সমাজ অগ্রহায়ণের প্রথম শুক্রবার থেকে নবান্ন উৎসব শুরু করেন। সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের কৃষকরা তাদের পঞ্জিকা অনুসারে ১ অগ্রহায়ণ থেকে নবান্ন উৎসব পালন করে থাকে। সুতরাং রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিক বা না দিক তাদের ওদের কিছু যায় আসে না।

বাঙালি কৃষক-কৃষাণীরা নবান্নের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে নবান্নে মেয়েকে বাপের বাড়িতে ‘নাইয়র’ আনা হয়। বাড়ির জামাইকেও নিমন্ত্রণ করা হয় স-পরিবারে। নবান্ন আর পিঠেপুলির উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা হয় সবাই। তাই অগ্রহায়ণ এলেই সর্বত্র ধ্বনিত হয়, ‘আজ নতুন ধানে হবে রে নবান্ন সবার ঘরে ঘরে।’ কুয়াশায় আচ্ছন্ন চারদিক আর কৃষকের গোলায় উঠছে পাকা ধান। চিরায়ত বাংলার চিরচেনা রূপ এটি। কৃষকের মাঠে তখন সোনারঙা ধানের ছড়াছড়ি। ধান ভাঙার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে, ঢেঁকির তালে মুখর হয় বাড়ির আঙিনা। নতুন চালের ভাত আর নানা ব্যঞ্জনে সৃষ্টি হয় আনন্দঘন পরিবেশে। তৈরি হয় নতুন চালের পিঠা, ক্ষীর-পায়েস। মুসলিম সমাজে মসজিদে শিন্নি দেওয়ার রেওয়াজও আছে, সনাতন সমাজে ঘরে ঘরে চলে পার্বণের আয়োজন। নবান্ন উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আয়োজন হলো নবান্নের প্রাণ গ্রামীণ মেলা। হরেক রকমের দোকান নিয়ে বসে গ্রামীণ মেলায়। এই মেলায় পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের পিঠা-ফুলি, মিষ্টি-সন্দেশ, মন্ডা-মিঠাই, খেলনা-পুতুল, মাটির তৈজষপত্র। আর বাড়তি আনন্দ দিতে বসে বাউল গানের আসর। নবান্ন উৎসবকে ঘিরে নাচে-গানে মুখরিত থাকে মেলাপ্রাঙ্গণ।

নবান্ন উৎসব বাঙালির একাত্মবোধকে জাগ্রত করে তোলো। জেলা-উপজেলায় কৃষি মেলার আয়োজন হয়। কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত শ্রেষ্ঠ কৃষকদের জেলা ও উপজেলা কৃষি বিভাগ বিভিন্নভাবে পুরস্কৃত করে কৃষি কাজে আরও আগ্রহ বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। দেশের বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বর্ণাঢ্য র‌্যালি, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন করে জাতীয় কৃষি দিবস। সাম্প্রতিককালে নগরও নবান্ন উদযাপনে পিছিয়ে নেই। ‘এসো মিলি সবে নবান্নের উৎসবে’ এই শ্লোগান সামনে রেখে প্রতিবছর নগরে নবান্ন উৎসব পালিত হয়েছে। রাজধানীর শাহবাগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে প্রতিবছর নবান্ন উৎসব উদযাপিত হয়। উৎসবে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি, বাউল গান, আদিবাসীদের পরিবেশনা ও নবান্নকথন সহ ঐতিহ্যবাহী নানা রকম পিঠা প্রদর্শনী করা হয়ে থাকে। বলতে গেলে অগ্রহায়ণের প্রথম সকালে নবান্ন উৎসবে মেতে ওঠে রাজধানীবাসী। নানা শিল্পীদের কণ্ঠে আনন্দে মাতিয়ে তুলে রমনা বটমূল কিংবা চারুকলা প্রাঙ্গন।

উপসংহার টানবো আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের কৃষকের স্বার্থরক্ষার কিছু আকুতি জানিয়ে। কৃষক যাতে তার উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পায়, নিজের জমিতে যেন তার কায়েমি স্বত্ব বজায় থাকে এবং কৃষি-জমি থেকে তাকে যেন উচ্ছেদ করা না হয়- এ দাবিগুলো ছিল জাতীয় কবি নজরুলের। তিনি মেহনতি মানুষের স্বার্থরক্ষায় সমস্যা জর্জরিত কৃষকের পক্ষে যে দাবিগুলো পেশ করেছিলেন, তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। আজকের দিনেও শুধু কৃষক নয়, গোটা জাতির কাছে দাবিগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নবান্ন বাঙালি জনজীবনে অনাবিল আনন্দ, সুখ ও সমৃদ্ধি বয়ে আনুক। সকল ক্ষেত্রে এদেশের খেটে খাওয়া কৃষকের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত হোক এই কামনায় শেষ করছি।

লেখক: উর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি), গাজীপুর-১৭০১। ই-মেইল: This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.