
প্রফেসর ড. এস এম রেজাউল করিম: গত দুই দশকে বাংলাদেশ দারিদ্র্য হ্রাসে অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছে। ২০০০ সালের পর থেকে ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, রপ্তানি খাতের বিস্তার, এবং সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মসূচীর ফলে কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্যের বাইরে এসেছে। কিন্তু ২০২২ সালের পর থেকে একাধিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপ, বিশেষত উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং কর্মসংস্থানের ধীরগতি আবারও দারিদ্র্যের হার বাড়িয়ে তুলেছে। নতুন পরিসংখ্যান ও পূর্বাভাসগুলো দেখাচ্ছে যে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে সাম্প্রতিক অগ্রগতি হুমকির মুখে পড়তে পারে।
দারিদ্র্যতা বৃদ্ধির প্রধান কারণ সমুহ
১. উচ্চ ও স্থায়ী মুদ্রাস্ফীতি: খাদ্য ও সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতি ২০২২ সালের পর থেকেই উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে, যা বিশেষ করে নিম্ন আয়ের পরিবারের ক্রয়ক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন মাসে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভোক্তা মূল্যসূচক (CPI) মুদ্রাস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮.৪৮% এবং ১২ মাসের গড় মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ১০.০৩%, যা এখনও ঐতিহাসিকভাবে উচ্চ। অর্থাৎ, মানুষের আয় অপরিবর্তিত থাকলেও বাজারদর দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় বাস্তব আয় কমে যাচ্ছে।
২. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান হ্রাস
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ Macro Poverty Outlook প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালে বাংলাদেশের প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে প্রায় ৪.০% হতে পারে, যা গত এক দশকের গড় প্রবৃদ্ধির তুলনায় অনেক কম। বিনিয়োগে মন্থরগতি ও নীতিগত অনিশ্চয়তা নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করছে, ফলে অনেক পরিবার আয়ের সংকটে পড়ছে।
৩. স্থানীয় ও মৌসুমভিত্তিক ধাক্কা
২০২২ থেকে ২০২৪ সালের জরিপে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন জেলায় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে। ২০২৪ সালে ৪৬.৩% পরিবার মাঝারি পর্যায়ের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে, যা ২০২২ সালে ছিল ৩৮.০৮%। অর্থাৎ দুই বছরে প্রায় ৮% পয়েন্ট বেড়েছে। উত্তরাঞ্চলের মতো কিছু এলাকায় ‘মোঙ্গা’ মৌসুমে কাজের অভাবে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ সময় ধান কাটার আগে কয়েক মাস কৃষিকাজ প্রায় থাকে না, ফলে কাজের অভাব দেখা দেয়। আর কাজ না থাকায় মানুষের আয় কমে যায়। আয় কমলে পরিবারগুলো খাবার কিনতে পারে না। এর ফলে ওই অঞ্চলে দারিদ্র্য ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা আরও বেড়ে যায়।
৪. শিশুদের বহুমাত্রিক বঞ্চনা
নতুন প্রকাশিত Multidimensional Poverty Index (MPI) ফলাফলে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ২৮.৯% শিশু বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার, যেখানে প্রাপ্তবয়স্কদের হার ২১.৪৪%। এর মধ্যে পুষ্টি, শিক্ষা, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সুবিধার অভাব এবং সামাজিক সুরক্ষার ঘাটতি শিশুদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে মারাত্মকভাবে সীমিত করছে।
৫. বাংলাদেশের দারিদ্র্যতায় ব্রেন ড্রেইনের প্রভাব
বাংলাদেশের অত্যন্ত মেধাবী ও দক্ষ পেশাজীবীরা, বিশেষ করে চিকিৎসক, প্রকৌশলী এবং প্রযুক্তিবিদরা ক্রমশ বিদেশমুখী হচ্ছে, যা ব্রেন ড্রেইন সমস্যাকে তীব্রতর করছে। এর ফলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও তথ্যপ্রযুক্তিসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতে যোগ্য জনবলের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। দক্ষ মানবসম্পদের এই অনুপস্থিতি দেশের উৎপাদনশীলতা ও উদ্ভাবনশক্তিকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে, কারণ উন্নয়ন ও শিল্পের বৈচিত্র্য বাড়ানোর মূল চালিকাশক্তি হিসেবে এই জনবল অপরিহার্য। অথচ সরকারের বিপুল বিনিয়োগ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরি হওয়া এসব মানবসম্পদ যখন বিদেশে সুযোগের খোঁজে চলে যায়, তখন রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যয়ের সুফল দেশে ফিরে আসে না। এর ফলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের ক্ষতি হয় এবং দারিদ্র্য হ্রাসের প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যাহত হয়।
বর্তমান দারিদ্র্যের হার ও সাম্প্রতিক চিত্র
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS)-এর HIES (Household Income and Expenditure Survey) 2022 জরিপে দেখা গেছে, জাতীয় দারিদ্র্যের হার ১৮.৭% (Upper Poverty Line) এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৫.৬% (Lower Poverty Line)। ২০২৪ সালে কিছু স্বাধীন জরিপে দেখা গেছে, ২০২২ সালের তুলনায় দেশের বহু এলাকায় দারিদ্র্য ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকার দারিদ্র্যের হার ২০২২ সালে ছিল ৮.৬%, যা ২০২৪ সালে বেড়ে ১৮.৯% এ পৌঁছেছে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০২৫ সালে জাতীয় দারিদ্র্যের হার ২২.৯% এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৭.৭% (FY24) থেকে বেড়ে ৯.৩% (FY25) হতে পারে যদি অর্থনৈতিক চাপ অব্যাহত থাকে।
আমাদের করণীয়
১. মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও ক্রয়ক্ষমতা রক্ষা
বাজারে নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে কার্যকর নীতি ও বাজার মনিটরিং জরুরি। মজুতদারি রোধ, প্রয়োজন হলে খাদ্যপণ্যের আমদানি সহজ করা, এবং টিসিবির সুলভমূল্যের পণ্য সরবরাহ কার্যক্রম বাড়ানো দরকার। বাংলাদেশে বর্তমান মুদ্রাস্ফীতি ৯ থেকে ১০% এর কাছাকাছি। তাই এই মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে ৫ থেকে ৬% পর্যায়ে আনা গেলে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা উন্নত হবে।
২. কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধি
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে (SME) সহজ ঋণ ও বাজার সুবিধা প্রদান, যাতে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হয়। তৈরি পোশাক খাতের বাইরে চামড়া, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, আইটি ও সেবা খাতের রপ্তানি বাড়াতে হবে। দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ ও নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান বিস্তৃত করতে হবে।
৩. মৌসুমভিত্তিক ও স্থানীয় সহায়তা
‘মোঙ্গা’ এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় মৌসুমী কর্মসংস্থানের জন্য সরকারি প্রকল্প, যেমন রাস্তা নির্মাণ, খাল খনন, বৃক্ষরোপণ ইত্যাদি চালু করতে হবে। নগদ সহায়তা, জনকল্যাণমূলক কাজ ও জরুরি খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করাও জরুরি।
৪. শিশুদের উপর বিনিয়োগ
১,০০০ দিনের মধ্যে মা ও শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। এই বিষয়টি মূলত গর্ভধারণ থেকে শুরু করে শিশুর জন্মের পর প্রথম দুই বছর পর্যন্ত সময়কালকে বোঝায়। এই সময়কে “গোল্ডেন উইন্ডো” বা সোনালী সুযোগের সময় বলা হয়, কারণ এ সময়ের পুষ্টি ও যত্ন শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি, মস্তিষ্কের বিকাশ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং ভবিষ্যৎ জীবনের সাফল্যের ভিত্তি তৈরি করে। প্রত্যন্ত এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষা, নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া জরুরি। তাছাড়া বহুমাত্রিক দারিদ্র্য হ্রাসে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
৫. মাইক্রোক্রেডিট ও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম শক্তিশালী করা
গ্রামীণ ব্যাংক, পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন (PDBF), ব্রাক (BRAC), আশা (ASA) ইত্যাদি এন জি ও প্রতিষ্ঠান দরিদ্রদের ঋণ, প্রশিক্ষণ ও বাজার সংযোগ প্রদান করে, যা দীর্ঘমেয়াদে আয় বৃদ্ধি করে। তাই এ সমস্ত কার্যক্রম আরো বৃদ্ধি করতে হবে। ঋণ প্রদানের সাথে সাথে ব্যবসা ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ যুক্ত করলে কার্যকারিতা বাড়বে।
৬. নীতি স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা
একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মূল শর্ত হলো বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা। আর এই বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ টেকসইভাবে বজায় রাখতে হলে নীতিগত স্থিতিশীলতা এবং রাজনৈতিক শান্তি অপরিহার্য। বিনিয়োগকারীরা সবসময় এমন দেশে বিনিয়োগ করতে চান, যেখানে নীতিমালা বারবার পরিবর্তন হয় না, আইন প্রয়োগে স্বচ্ছতা থাকে, এবং ব্যবসা শুরু ও পরিচালনা করা সহজ হয়। যে দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির, সেখানে বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি নিতে চান না। হরতাল, অবরোধ, সংঘর্ষ বা অনিয়মিত প্রশাসনিক পরিবর্তন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ব্যাহত করে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হলে আইনশৃঙ্খলা ভালো থাকে, অবকাঠামো উন্নয়ন বাধাহীনভাবে চলতে পারে এবং বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে পারেন।
বাংলাদেশ দারিদ্র্য হ্রাসে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করলেও সাম্প্রতিক উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক মন্থরগতি ও কর্মসংস্থানের সংকট নতুন করে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এইচ আই ই এস (HIES) 2022 এর অফিসিয়াল তথ্য (১৮.৭% দারিদ্র্য) এবং ২০২৪ সালের জরিপের উদ্বেগজনক প্রবণতা দেখিয়ে দিচ্ছে যে যদি দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে ২০২৫ সালে দারিদ্র্য হার আরও বাড়তে পারে। তাই, এখনই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান বিস্তৃতি, সামাজিক সুরক্ষা জোরদার, এবং শিশুদের উন্নয়নে বিনিয়োগের মতো সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
লেখক: উপাচার্য, আশা ইউনিভারসিটি, শ্যামলী, ঢাকা