কৃষিবিদ মোহাম্মদ জাকির হাসনাৎ, পিএইচডি ফেলো, শেকৃবি: বাংলাদেশে ধান উৎপাদনের তিনটি মৌসুমের মধ্যে আমন মৌসুম সবচেয়ে বড়। বর্তমানে আমন মৌসুমের কাজ শুরু হয়ে গেছে। তাই সময়মতো মানসম্পন্ন বীজ সংগ্রহ ও আদর্শ বীজতলা প্রস্তুত করার মাধ্যমে অধিক ফলন নিশ্চিত করা সম্ভব। গবেষণায় দেখা গেছে, কেবল ভালো বীজ ব্যবহারের মাধ্যমেই শতকরা ১৫-২০ ভাগ ফলন বৃদ্ধি করা যায়।
মানসম্মত বীজ নির্বাচন: ফলনের প্রথম ধাপ
উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করতে হলে আগে নিশ্চিত হতে হবে বীজের গুণগত মান সম্পর্কে। ভালো বীজ চকচকে, সমান আকারের, পরিপক্ক ও পরিপুষ্ট হতে হবে। এতে অন্য জাতের মিশ্রণ, আগাছার বীজ, পোকামাকড় বা রোগের উপসর্গ থাকা চলবে না। অঙ্কুরোদগম হার হতে হবে অন্তত ৮০ শতাংশ এবং বিশুদ্ধতা হার ৯৫ থেকে ৯৯ শতাংশ। বাজারে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) ভর্তুকিপ্রাপ্ত বীজ ছাড়াও বিভিন্ন বিশ্বস্ত কোম্পানির সার্টিফায়েড প্যাকেটজাত বীজ পাওয়া যায়। এসব প্যাকেটের গায়ে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির ট্যাগ আছে কীনা দেখে নেওয়া উচিত।
জাত নির্বাচন: এলাকার সাথে মিল থাকতেই হবে
অঞ্চলভেদে জমির ধরণ, পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা, জলাবদ্ধতার প্রবণতা, ফসল চক্র ও বাজার চাহিদা বিবেচনায় জাত নির্বাচন করতে হবে।
- স্বল্প মেয়াদি জাত: ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৭৫, বিনা ধান-২২, বিইউ-১
(জীবনকাল: ১০০-১২০ দিন, ফলন: বিঘা প্রতি ১৫-১৮ মণ) - মধ্যম মেয়াদি জাত: ব্রি ধান৪৯, ব্রি ধান৮৭, ব্রি ধান১০৩
(জীবনকাল: ১২৭-১৪৫ দিন, ফলন: ১৮-২১ মণ) - সুগন্ধি জাত: ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৯০
(ফলন: ১২-১৮ মণ, জীবনকাল: ১২৭-১৩৫ দিন) - জিংকসমৃদ্ধ জাত: ব্রি ধান৬২, বিনা ধান-২০
(স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিকর, জীবনকাল: ১১০-১১৫ দিন) - বন্যা সহিষ্ণু জাত: ব্রি ধান৫১, ব্রি ধান৫২
(১০-১৫ দিন পানিতে ডুবে থাকলেও ফলন ধরে রাখে) - লবণাক্ত সহনশীল জাত: ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৪১
- খরাপ্রবণ বরেন্দ্র এলাকায়: ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৫৭
- জোয়ার-ভাটা এলাকায়: ব্রি ধান৪৪
- হাইব্রিড জাত: ব্রি হাইব্রিড ধান৪ ও ব্রি হাইব্রিড ধান৬ (ফলন: বিঘা প্রতি ২০-২১ মণ)
বীজ শোধন ও জাগ: অঙ্কুরোদগম নিশ্চিত করতে
নিজের সংগৃহীত বীজ হলে ইউরিয়া দিয়ে ভাসমান চিটা ধান আলাদা করতে হবে। ১০ লিটার পানিতে ৩৫০ গ্রাম ইউরিয়া মিশিয়ে ১০ কেজি বীজ দিয়ে নাড়ালে ভেসে ওঠা চিটা ধান অপসারণ করা যায়। এরপর প্রোভেক্স বা ব্যাভিস্টিন দিয়ে ছত্রাকমুক্ত করতে হবে—এক কেজি বীজের জন্য তিন গ্রাম ছত্রাকনাশক মিশিয়ে ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর ৪৮ ঘণ্টা ভেজা অবস্থায় রেখে দিলে অঙ্কুর বের হবে।
আদর্শ বীজতলা: চারা উৎপাদনের মূলভিত্তি
ভেজা বীজতলাই আমনের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। উঁচু, সেচ-সুবিধাসম্পন্ন, উর্বর দোআঁশ মাটির জমি বেছে নিতে হবে। প্রতি শতকে ২০ কেজি পচা গোবর বা ৩-৪ কেজি ভার্মিকম্পোস্ট মিশিয়ে ৭-১০ দিন চাষ করে জমি কাদা করতে হবে। এরপর ৪ ফুট চওড়া ও দৈর্ঘ্য অনুযায়ী বেড তৈরি করে তার মাঝে ১ ফুট চওড়া নালা রাখতে হবে।
প্রতি ১ বর্গমিটার বীজতলায় ৬০-৭০ গ্রাম বীজ বপন করতে হয়। তবে বীজের অঙ্কুরোদগম হার অনুযায়ী এই পরিমাণ বাড়াতে বা কমাতে হয়। বীজ বপনের পর ৪-৫ দিন পাখির হাত থেকে রক্ষা করতে পাহারা দিতে হবে এবং নালা ভর্তি করে পানি রাখতে হবে। এভাবে তৈরি এক শতাংশ জমিতে যে পরিমাণ চারা বা বিছন হবে তা দিয়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ জমিতে রোয়া বা চারা লাগানো যায়।
পরিচর্যা ও চারার বয়স
বীজতলার চারা হলদে হলে প্রতি দুই বর্গহাতে ৭ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০ গ্রাম জিপসাম দিতে হবে। থ্রিপস বা উকুন পোকা দেখা দিলে সাদা সুতি ভেজা কাপড় চারার উপর টেনে আটকে যাওয়া পোকা পিষে মেরে ফেলতে হবে।
চারার বয়স আদর্শভাবে ৩০ দিন হলে মূল জমিতে রোপণ করতে হয়। স্বল্প মেয়াদি জাতের ক্ষেত্রে ২০-২৫ দিনেই রোপণ করা উচিত। পাঁচপাতা হলেই চারা রোপণ করা দরকার। বিলম্ব হলে বিঘা প্রতি ৭-৮ কেজি পর্যন্ত ফলন কমে যেতে পারে।
বলান বা রাইস ট্রান্সপ্লান্টার: বিকল্প ও আধুনিক পদ্ধতি
বন্যা বা জলাবদ্ধতার কারণে দেরি হলে বলান বা দোগোছি বা দ্বিরোপণ পদ্ধতিতে চারা রোপণ করতে পারেন। যন্ত্রের সাহায্যে (রাইস ট্রান্সপ্লান্টার) চারা রোপণ করলে সময় ও খরচ—দুটোই কমে যায়।
শেষ কথা
আমন ধান চাষের সফলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয়—উপযুক্ত জাত নির্বাচন, গুণগত বীজ এবং আদর্শ বীজতলা। এগুলো নিশ্চিত করতে পারলে উৎপাদন বাড়বে, খরচ কমবে এবং কৃষক পাবে নিশ্চিত লাভ।