রোটারিয়ান ড. মো. হেমায়েতুল ইসলাম আরিফ
ভূমিকা:
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র বরেন্দ্র একটি অনন্য ভৌগোলিক অঞ্চল। কৃষি নির্ভর জীবনযাপন, ঐতিহাসিক ঐতিহ্য এবং প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এ অঞ্চলটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পানি সংকট এতটাই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, মরুকরণের আশঙ্কা এখন বাস্তব রূপ নিয়েছে। গত ২৫ আগস্ট জাতীয় পানিসম্পদ পরিষদের নির্বাহী কমিটির ১৮তম সভায় রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার ২১৫টি ইউনিয়নকে ‘উচ্চ পানি সংকট এলাকা’ এবং ১৫০৩টি মৌজাকে ‘অতি উচ্চ পানি সংকট এলাকা’ ঘোষণা করা হয়েছে।
এই প্রবন্ধে বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি সংকটের কারণসমূহ, ফারাক্কা চুক্তির ভূমিকা, সরকারি পদক্ষেপের প্রাসঙ্গিকতা এবং টেকসই পানি ব্যবস্থাপনার রূপরেখা বিশ্লেষণ করা হবে।
১. বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি সংকট: কারণ ও ফলাফল
প্রাকৃতিক কারণ
বরেন্দ্র অঞ্চল বাংলাদেশের সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাতপ্রবণ অঞ্চল। পাশাপাশি মাটির গঠন এমন যে ভূপৃষ্ঠস্থ পানি দ্রুত মাটির নিচে নেমে যায়। ফলে প্রাকৃতিকভাবে পানি ধরে রাখার ক্ষমতা অত্যন্ত কম।
ফারাক্কা বাঁধের প্রভাব
১৯৭৫ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ফারাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার পর থেকেই পদ্মা নদীর প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। এর প্রভাব পড়ে মহানন্দা, আত্রাই, পুনর্ভবা প্রভৃতি নদীতেও। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির পুনর্ভরণ (Recharge) বন্ধ হয়ে যায়।
ভূগর্ভস্থ পানির নির্বিচার উত্তোলন
অবৈজ্ঞানিকভাবে ডিপ টিউবওয়েলের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে প্রতিবছর গড়পড়তা ৩–৫ ফুট করে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। কৃষি সেচ, গৃহস্থালি ও শিল্পকার্যে প্রায় পুরোপুরি ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া এ সংকটকে আরও তীব্র করেছে।
মরুকরণের লক্ষণ
• নদী-নালা শুকিয়ে যাওয়া
• জলাধার ভরাট হয়ে যাওয়া
• বনভূমি ও সবুজ আচ্ছাদন হ্রাস
• মাটির আর্দ্রতা হ্রাস
এসবই বরেন্দ্র অঞ্চলের আসন্ন মরুকরণের জোরালো ইঙ্গিত বহন করছে।
২. ফারাক্কা চুক্তি: একটি অসম্পূর্ণ সমাধান
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত ৩০ বছরের ফারাক্কা চুক্তি নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক অগ্রগতি। শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার পানি বণ্টনের একটি আনুষ্ঠানিক সূত্র প্রবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিকভাবে তার পানির অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করে।
ইতিবাচক দিক
• পানি বণ্টনে আনুষ্ঠানিকতা ও পূর্বানুমেয়তা (Predictability) সৃষ্টি হয়েছে।
• আন্তর্জাতিক আইনে বাংলাদেশের অধিকারকে বৈধতা প্রদান করেছে।
সীমাবদ্ধতা
• নদীর মোট প্রবাহের একটি স্পষ্ট ও ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা হয়নি।
• কেবল ফারাক্কা পয়েন্টে পানি বণ্টনের কথা বলা হয়েছে, উজানে পানি প্রত্যাহারের বিষয়টি উপেক্ষিত।
• ভারতের উজানে নতুন বাঁধ ও ব্যারেজ নির্মাণের প্রভাব নিয়ে চুক্তিতে কোনো শর্ত নেই।
• ভবিষ্যৎ পানি ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের মূল্যায়ন অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
ফলে বলা যায়, চুক্তিটি সমস্যার আংশিক সমাধান দিয়েছে, কিন্তু ন্যায্যতা ও দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
৩. সরকারি ঘোষণা ও ২০১৩-এর পানি আইন
রাজশাহী অঞ্চলের পানি সংকটের সরকারি স্বীকৃতি এবং ২০১৩ সালের পানি আইনের ধারা ১৭ ও ১৯ প্রয়োগের উদ্যোগ সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।
• ধারা ১৭: সরকার পানি সংকটপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ বা নিষিদ্ধ করতে পারে।
• ধারা ১৯: ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের জন্য লাইসেন্স গ্রহণ বাধ্যতামূলক।
এই আইন কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে অবৈজ্ঞানিক নলকূপ স্থাপন ও অনিয়ন্ত্রিত পানি উত্তোলন বন্ধ হবে, যা পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বড় একটি পদক্ষেপ।
৪. সমন্বিত ও টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা
পানি সংকট মোকাবেলায় শুধু নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন একটি সমন্বিত, বহুমাত্রিক ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা।
ক. ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার
• বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ (Rainwater Harvesting)
• পুকুর, খাল, নদী পুনঃখনন
• নতুন জলাধার, দিঘি, খাল নির্মাণ
খ. সেচ পদ্ধতির আধুনিকায়ন
• ড্রিপ ইরিগেশন ও স্প্রিঙ্কলার ইরিগেশন চালু করা
• পানির অপচয় রোধ
গ. কৃষি ফসলের ধরন পরিবর্তন
• উচ্চ পানি নির্ভরশীল ধান চাষ কমিয়ে কম পানি প্রয়োজন হয় এমন ফসল (গম, ভুট্টা, ডাল, তিল, সূর্যমুখী) চাষে উৎসাহ প্রদান
ঘ. ফারাক্কা ও তিস্তা চুক্তি পুনর্বিবেচনা
• বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিতকরণ
• উজানে নতুন প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন ও নিয়ন্ত্রণ
• আঞ্চলিক কূটনৈতিক উদ্যোগ জোরদার
ঙ. সামাজিক সচেতনতা
• পানির মূল্য ও ব্যবহারের গুরুত্ব নিয়ে গণসচেতনতা বৃদ্ধি
• স্থানীয় জনগণকে পানি ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত করা
উপসংহার
বরেন্দ্র অঞ্চলের মরুকরণ রোধ করা কেবল একটি আঞ্চলিক নয়, জাতীয় নিরাপত্তা ও টিকে থাকার প্রশ্ন। সরকারের সাম্প্রতিক ঘোষণা সংকট মোকাবেলার প্রথম পদক্ষেপ হলেও একটি খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন দ্বিমুখী কৌশল
১. আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ফারাক্কা চুক্তি পুনর্বিবেচনা ও ন্যায্য হিস্যা আদায়।
২. জাতীয় পর্যায়ে ২০১৩ সালের পানি আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন এবং সমন্বিত, বৈজ্ঞানিক ও টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা গ্রহণ।
শুধুমাত্র এভাবেই বরেন্দ্র অঞ্চলকে মরুকরণের হাত থেকে রক্ষা করে কৃষি, পরিবেশ ও মানবজীবনের টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), রাজশাহী