
কৃষিবিদ ডা. শাহাদাত হোসেন পারভেজ
শৈশব, পরিবার ও স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট:
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান বীর উত্তম এবং তিনবারের নির্বাচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জেষ্ঠ্য সন্তান তারেক রহমানের জন্ম ১৯৬৫ সালের ২০ নভেম্বর তারিখে। আজ তার ৬১তম জন্মদিন। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে। তারেক রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তিনি এর আগে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন।
জনাব রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং রাজনৈতিক উত্থান-পতনের একজন সাক্ষী এবং অংশগ্রহণকারী। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, যখন তার পিতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং দেশকে স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ শুরু করেন, তখন তাকে, তার মা বেগম খালেদা জিয়ার এবং তার ভাই আরাফাত রহমান কোকো কে, অন্যান্য আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা সামরিক কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে গ্রেফতার করা হয়। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য কারাবন্দী হওয়া সর্বকনিষ্ঠ কারাবন্দীদের একজন।
শিক্ষাজীবন ও রাজনৈতিক চিন্তার বুনিয়াদ:
মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ থেকে। এরপর উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে, যেখানে তিনি একদিকে পড়াশোনার পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা বিকাশের কাজ চালিয়ে গেছেন। ১৯৮৪ সালে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে আইন বিভাগে ও পরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে, যেখানে তিনি আরও গভীরভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি দলীয় রাজনীতি, গণসংযোগ এবং সংগঠন শক্তিশালী করার প্রাথমিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
এই সময় থেকেই রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত ও নেতৃত্ব বিকাশের বীজ রোপিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, হবস, লক, রুশো, ভলতেয়ার, কার্ল মার্কস এবং অন্যান্য ব্যতিক্রমী চিন্তাবিদদের রাজনৈতিক চিন্তাধারা পড়েছিলেন।
এরশাদবিরোধী আন্দোলন ও রাজনীতিতে সক্রিয়তা:
১৯৮৬ সালে, এরশাদ সরকারের পাতানো নির্বাচনের প্রাক্কালে, তিনি গৃহবন্দিত্ব এড়িয়ে এবং প্রেসক্লাবে একটি প্রেস কনফারেন্সে কীভাবে নিরাপত্তা সংস্থাগুলি একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলনকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল তাঁর বর্ণনা করেন। ফলস্বরূপ, তার কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার জন্য, জেনারেল এইচ এম এরশাদের স্বৈরাচারী সরকার তাকে তার মায়ের সাথে গৃহবন্দী করে রাখে একাধিকবার। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি তার মায়ের সাথে রাজপথে আন্দোলনে যোগ দেন এবং ১৯৮৮ সালে দলের বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলা ইউনিটে সাধারণ সদস্য হিসেবে বিএনপিতে যোগদান করেন। তিনি তৃণমূল থেকে জনগণকে সংগঠিত করেছিলেন এবং এইচ এম এরশাদের সরকারের পতনে অবদান রেখেছিলেন।
তৃণমূল থেকে নেতৃত্বের উত্থান:
১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে তিনি তার মা বেগম খালেদা জিয়ার সাথে দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় প্রচারণা চালিয়ে নির্বাচনে বিজয় অর্জন করেন। তার মা বেগম জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তিনি বগুড়ায় তৃণমূল থেকে নেতা নির্বাচনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সূচনা করেছিলেন, যেখানে জেলা বিএনপির একজন নির্বাহী সদস্য ছিলেন। ১৯৯৩ সালে বগুড়া জেলা ইউনিটে তিনি একটি সম্মেলনের আয়োজন করেন যেখানে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়। বগুড়ায় সফল সম্মেলনের পর তিনি অন্যান্য জেলা ইউনিটকে গণতান্ত্রিকভাবে নেতা নির্বাচন করতে উৎসাহিত করেন।
২০০১ সালের নির্বাচনের আগে, তিনি স্থানীয় পর্যায়ের সমস্যা এবং সুশাসনের উপর গবেষণা করার জন্য ঢাকায় একটি অফিস প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের সদস্যদের সঙ্গেও তিনি আলোচনা করেন। তার প্রচেষ্টায় ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে।
দলের দায়িত্ব, সাংগঠনিক সংস্কার ও নীতিনিষ্ঠ রাজনীতি:
বিএনপি চেয়ারপারসনের ছেলে হয়েও এবং তৃণমূল থেকে ব্যাপক সমর্থন পাওয়া সত্ত্বেও তিনি স্বজনপ্রীতি করে কোনো মন্ত্রিত্ব বা সংসদ সদস্যপদ গ্রহণ না করে দলের তৃণমূলের ক্ষমতায়নে মনোনিবেশ করেন। দল সংগঠনে তার প্রচেষ্টার স্বীকৃতি হিসেবে ২০০২ সালে জাতীয় স্থায়ী কমিটি তাকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব পদে মনোনীত করে। ২০০৫ সালে, তিনি দেশব্যাপী তৃণমূল সম্মেলন আয়োজন করেন এবং বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলা ইউনিট ও ইউনিয়ন প্রতিনিধিদের সাথে মতবিনিময় করেন। এই সম্মেলনের সময় তিনি তৃণমূল নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলা, স্থানীয়দের সাথে মতবিনিময় করা এবং সমর্থকদের চিন্তাধারা শোনেন এবং জনগণের কাছে বিএনপির কর্মসূচী প্রচার করেছেন। তিনি কৃষকদের জন্য সরকারী ভর্তুকি, বয়স্কদের জন্য ভাতা, পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য প্লাস্টিক ব্যাগ বিরোধী আন্দোলন, এবং নারী শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি বিতরণ সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করেন, যা স্কুলে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য কমিয়ে ভারসাম্য আনতে সহায়ক হয়। তিনি ব্যক্তিগতভাবে সম্মেলনে নিবন্ধনকারীদের অন্তত ১৮,০০০ চিঠির উত্তর দেন।
ব্যক্তিজীবন ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি:
তারেক রহমানের ব্যক্তিগত জীবনও অনুপ্রেরণাদায়ক। ১৯৯৪ সালে, তারেক রহমান বাংলাদেশের প্রাক্তন নৌবাহিনী প্রধান এবং পরবর্তী সরকারের দুই বারের মন্ত্রী প্রয়াত রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খানের কন্যা ডাঃ জোবায়দা রহমানকে বিয়ে করেন। ডাঃ জোবায়দা রহমান একজন খ্যাতনামা কার্ডিওলজিস্ট যিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করেছেন। তাদের একমাত্র কন্যা ব্যারিস্টার জাইমা রহমান পেশাগতভাবে আইনজীবী। পরিবারের মধ্যে বিশেষভাবে স্মরণীয় হল আরাফাত রহমান কোকো, যাকে হারানোর যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা তাঁকে মানবিক ও সহনশীল নেতৃত্বে আরও দৃঢ় করেছে।
কারাবরণ, নির্যাতন ও রাজনৈতিক দৃঢ়তা:
২০০৭ সালের ৭ মার্চ, কোনো পরোয়ানা, মামলা, জিডি বা স্পষ্ট অভিযোগ ছাড়াই সেনা সমর্থিত মঈনউদ্দিন ও ফখরউদ্দিনের সরকার জরুরি বিধিমালায় গ্রেফতার করে তাকে। এই সময়ে একটানা ৫৫৪ দিন বা ১৮ মাস কারাবাস এবং পুলিশ রিমান্ডে নির্যাতন এবং অমানবিক আচরণ সহ্য করতে হয় তাকে। এরপর ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর, চিকিৎসাধীন অবস্থায় পিজি হাসপাতাল থেকে মুক্তি পান। এই অভিজ্ঞতা তার চরিত্রকে আরও দৃঢ় করেছে এবং দল ও দেশের জন্য তাঁর দায়িত্ববোধকে শক্তিশালী করেছে।
বিএনপির গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক কৃষিবিদ শামীমুর রহমান শামীম বলেন-কারাগারে নিক্ষেপের সময় জনাব তারেক রহমান ছিলেন সম্ভাবনাময় এক উদীয়মান নেতা। কিন্তু পরবর্তী দুই দশকই প্রমাণ করেছে তার প্রকৃত শক্তি ও নিষ্ঠা। প্রতিকূলতার প্রতিটি মুহূর্তে তিনি দেশ ও দলের পক্ষে লড়ে গেছেন অবিচলভাবে-স্বৈরশাসনের অন্যায়ের সামনে কখনও মাথা নত করেননি, কখনও পিছিয়ে যাননি। তার এই অটল অধ্যবসায় ও ধৈর্যই শুধু প্রতিরোধের শিখা জ্বালিয়ে রাখেনি, বরং বিএনপিকে গড়ে তুলেছে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও শক্তিশালী ও সুসংগঠিত এক শক্তিতে।
তারেক রহমানের নেতৃত্বের বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কিছু দিক: বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতিতে তারেক রহমান এমন একজন নেতা, যার নেতৃত্ব গুণকে কেবল দলীয় পরিমণ্ডলে নয়, বিস্তৃত জাতীয় প্রেক্ষাপটেও ক্রমাগত মূল্যায়ন করা হচ্ছে। তার নেতৃত্বের কেন্দ্রে রয়েছে প্রতিশোধমুক্ত রাজনীতি-যা বাংলাদেশের দীর্ঘ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক ধরনের নতুন বার্তা নিয়ে আসে। সহিংস প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবর্তে তিনি রাষ্ট্র পুনর্গঠন, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে অগ্রাধিকার দিয়ে রাজনীতিকে আরও নীতিনিষ্ঠ পথে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
তৃণমূলের প্রতি তার ঘনিষ্ঠতা কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় রাজনীতির শীর্ষে অবস্থান করেও তিনি দলকে পুনর্গঠনের প্রধান শক্তি হিসাবে তৃণমূলে সংগঠন শক্তিশালী করার দিকে মনোনিবেশ করেন। ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে থাকা অবস্থাতেও বিভিন্ন অঞ্চলের তথ্য, অভিযোগ, এবং সংগঠনগত দুর্বলতা সম্পর্কে তার অবহিত থাকা তার সাংগঠনিক দক্ষতারই প্রমাণ।
কঠোর পরিশ্রম ও তথ্যনির্ভর সিদ্ধান্ত গ্রহণ তার রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতিকে আলাদা করে তোলে। ঘনিষ্ঠজনদের মতে, তিনি দলীয় পুনর্গঠন, আন্দোলন পরিচালনা এবং নীতি নির্ধারণে দীর্ঘ সময় ব্যয় করেন এবং প্রতিটি বিষয়ে গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। সাধারণ ও সংযত জীবনযাপনও তার রাজনৈতিক ভাবমূর্তিকে শক্তিশালী করে। বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত নেতৃস্থানীয় জীবনের বাইরে গিয়ে তিনি ‘অপ্রদর্শনমূলক নেতৃত্ব’-এর উদাহরণ তৈরি করেছেন।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে তার ভূমিকা বিশেষভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন পরিচালনায় তার সাহস, ধৈর্য ও কৌশলগত সংযম নেতৃত্বের পরিপক্বতা নির্দেশ করে। একতা, সহনশীলতা, সততা ও সাম্যের প্রশ্নে তার আপোষহীন অবস্থান তাকে রাজনৈতিক সংস্কারক নেতায় পরিণত করেছে। যে সময়ে ঘৃণা ও বিভাজন রাজনীতির প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠছিল, সে সময়ে তিনি উদার ও মধ্যপন্থী রাজনৈতিক ভাষা নির্মাণের চেষ্টা করেছেন-যা বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থানকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও গ্রহণযোগ্যতার দিকে নিয়ে গেছে।
নীরবে মানবসেবা করা এবং নেতা-কর্মীদের ব্যক্তিগত সংকটে সরাসরি যোগাযোগ রাখা-এ দুটি দিক রাজনৈতিক বিশ্লেষণে প্রায়ই উপেক্ষিত হয়, কিন্তু বাস্তবে এগুলো তারেক রহমানের নেতৃত্ব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এতে একটি বার্তা যায়: রাজনীতি কেবল ক্ষমতার লড়াই নয়; এটি মানুষের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন সম্পর্কের জায়গা। দলীয় কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিক-সবার বিপদে তার ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও সহমর্মিতা রাজনৈতিক নেতৃত্বের মানবিক মাত্রাকে শক্তিশালী করে।
সব মিলিয়ে, তারেক রহমানের নেতৃত্বের এই দিকগুলো দেখায়-তিনি শুধু একটি দল পরিচালনাই করছেন না, বরং বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতিকে একটি নতুন কাঠামো, নতুন বয়ান ও নতুন কৌশলের পথে পরিচালিত করছেন। তার নেতৃত্ব বিশ্লেষণে তাই দেখা যায়-এটি কেবল একটি ব্যক্তির জীবনী নয়, বরং একটি রাজনৈতিক ধারার বিবর্তনের গল্প।
নাগরিকদের সঙ্গে কথোপকথন ও মতামত আদান-প্রদানের মাধ্যমে তিনি বিএনপি'র নীতি ও রূপকল্প পৌঁছে দিয়েছেন জনগণের দোরগোড়ায়। কৃষকদের জন্য সরকারি ভর্তুকি, বয়স্ক ভাতা বরাদ্দ, পরিবেশ রক্ষার্থে প্লাস্টিক বিরোধী আন্দোলন, শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি-এসব উদ্যোগের সরাসরি প্রভাব লক্ষ্য করা যায় সারা দেশে। এই গণসংযোগের ফলে স্কুল পর্যায়ে কিশোর-কিশোরীর শিক্ষায় সমতা, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও মিথ্যা অপবাদ: বাস্তবতার বিশ্লেষণ
একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা থেকে শুরু করে দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদের অভিযোগ-এ সবই ছিল তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচেষ্টা। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় তদন্তে এসব অভিযোগ অসত্য প্রমাণিত হলেও তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে। একই সময়ে দেশজুড়ে সীমাহীন দুর্নীতি, কুইক রেন্টাল, পদ্মাসেতু, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বা মেট্রোরেলের অস্বচ্ছ ব্যয়-এসব থেকে মনোযোগ সরাতে তাঁকে টার্গেট করা হয়।
শত দমন-পীড়ন ও আন্দোলনে তারেক রহমানের নেতৃত্বের বাস্তব চিত্র:
২০০৮-এর প্রহসনের নির্বাচনের পর ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা প্রমাণ করতে শুরু করেন, তিনি বাকশাল কায়েম করা শেখ মুজিবের কন্যা। গুম, হত্যা, নির্যাতন, বিরোধী মত দমনের এক স্টিম রোলার চালনা শুরু করে তারা। পরপর তিনটি নির্বাচনে মানুষের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র হত্যার নীল নকশা বাস্তবায়ন করে। রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপি কখনো এ ফ্যাসিবাদ মেনে নেয়নি এবং মাঠ ছাড়েনি।
একটা পরিসংখ্যান দেখলেই পাঠকেরা বুঝতে পারবেন, গত ১৫ বছরে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৪২ হাজার ৮২৫টির বেশি মামলা হয়েছে, মামলায় আসামির সংখ্যা ৫০ লাখ ৩২ হাজার ৬৫৫ জনেরও বেশি। এটা একটা সংখ্যা মাত্র, কিন্তু এর ব্যপ্তি এত বেশি যে তা লিখে বোঝানো যাবে না। বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী নিঃস্ব হয়ে গেছে, সামাজিকভাবে হেয় হয়েছে, শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেছে নির্যাতনে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান একদিনে সাধিত হয়নি। এর প্রেক্ষাপট তৈরিতে বিএনপির চেয়ে বেশি এবং দীর্ঘ সময় ত্যাগ আর কোনো একক রাজনৈতিক দলের নেই। এত নির্যাতন ও দমনপীড়নের পরও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একক ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে বিএনপি পথ হারায়নি।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান এবং আন্দোলনের পরিণতি:
আজকে কেউ কেউ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে নিজেদের আন্দোলনের ফসল বলে দাবি করছেন। আসলে বিএনপির এক দফা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় জুলাই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, যার নেতৃত্ব দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বিএনপির ১৫ বছরের আন্দোলনের সঙ্গে যখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন যুক্ত হয়েছে এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনার বন্দুকের নল থেকে বুলেট এসে ছাত্র-জনতার বুকে বিদ্ধ হয়, তখন জনতার পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে।
আরেকটি তথ্য দেখলেই বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে! ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে বিএনপির ৪২২ জন শহিদ হন। এর আগে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিএনপির ১ হাজার ৫৫১ জন শহিদ হন। গুম হন ৪২৩ জন। আর সব রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ মিলিয়ে এ সময়ে গুমের সংখ্যা প্রায় ৭০০।
ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলন শুধু ছাত্রদের দাবির প্রতিবাদ ছিল না, বরং তা বিএনপির দেখানো পথ ধরে রাজনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে রূপ নেয়। বিএনপির নেতাকর্মীরা সক্রিয়ভাবে এ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। তারেক রহমানের রাজনৈতিক দিকনির্দেশনায় প্রাণবাজি রেখে রাজপথে সোচ্চার থাকেন এবং ছাত্র-জনতাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেন। এর ফলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং রাজনৈতিক মুক্তির পথ সুগম হয়।
তারেক রহমান ঘোষিত বিএনপির ৩১ দফা: রাষ্ট্র সংস্কারের ভবিষ্যৎ নকশা
খালেদা জিয়ার ভিশন ২০৩০-এর ওপর ভিত্তি করে ২০২৩ সালে তারেক রহমান যে ৩১ দফা প্রস্তাব ঘোষণা করেন, তা এখন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র কাঠামো নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। এতে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, সাংবিধানিক ভারসাম্য, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদসীমা, ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার, মানবাধিকার সুরক্ষা, শিক্ষিত বেকারের ভাতা, পরিবার-নারীবান্ধব কার্ড, ব্রিটিশ মডেলের স্বাস্থ্যব্যবস্থা-সবই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
সব মিলিয়ে বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতির ভিত্তি এখন ৩১ দফাই। দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব, বিশেষ করে তারেক রহমান, প্রতিদিনের রাজনৈতিক বক্তব্য ও সব কর্মসূচিতে ৩১ দফাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। ফলে এটি আর শুধু রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নয়-বরং বিএনপির আগামী রাষ্ট্র পরিচালনার রূপরেখা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
উপসংহার: সংগ্রাম, সাহস ও গণতন্ত্রের সমন্বিত প্রতীক:
দীর্ঘ দমন-পীড়ন, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, ৫৫৪ দিনের কারাবাস, নির্বাসন, দলের ওপর পরিকল্পিত হামলা-সবকিছু সত্ত্বেও তারেক রহমান গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে অটল থেকেছেন। তিনি শুধু বিএনপির নেতা নন; বরং গণতন্ত্র প্রত্যাশী জনগণের কাছে তিনি এক দৃঢ় আশা-আকাঙ্খার প্রতীক।
তাঁর জীবন আমাদের শেখায়-ধৈর্য, তৃণমূল সংযোগ, নীতি, সংগঠন ও মানবিক নেতৃত্ব-একটি জাতিকে পুনরুজ্জীবিত করার শক্তিশালী উপাদান। তারেক রহমানের সংগ্রাম, নেতৃত্ব ও অবদান বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক অনিবার্য অধ্যায় হয়ে থাকবে, যা আগামী প্রজন্মকে পথ দেখাবে।
-লেখক: সাংগঠনিক সম্পাদক, ভেটেরিনারি ডক্টরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- ভ্যাব।।
























