শক্তিশালী প্রাণিসম্পদ গঠনে করণীয়

প্রফেসর ড. মোঃ মাহবুব আলম (সভাপতি, ভ্যাব), ডাঃ কবির উদ্দিন আহমেদ(মহাসচিব,ভ্যাব) ও ডাঃ মোঃ ইউনুস আলী (সদস্য, বিসিএস লাইভস্টক ক্যাডার)
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে গবাদিপশু-পাখির উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ, মানব সম্পদ উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, নিরাপদ প্রাণিজাত পণ্যের (দুধ, ডিম, মাংস) উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধিতে সহায়তা, গবাদি-পশু,পাখির জেনেটিক রিসোর্স সংরক্ষণের মত সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে এবং সবার জন্য নিরাপদ, পর্যাপ্ত এবং মান সম্মত প্রাণিজ আমিষ সরবরাহের অভিলক্ষ্য নিয়ে অত্যন্ত সফলতার সাথে কাজ করছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি কৃষি হলেও প্রাণিসম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। গবাদিপশু ও হাঁসমুরগী পালন গ্রামীণ জনপদের অনেক পুরোনো পেশা বা ঐতিহ্য যা কালের পরিক্রমায় পরিবর্তিত হয়ে অর্থনীতির মজবুত ভিত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে জিডিপিতে স্থির মূল্যে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১.৮০%, প্রবৃদ্ধির হার ৩.১৫% এবং জিডিপিi আকার প্রায় ৮২০১৪ কোটি টাকা (বিবিএস, ২০২৪) । মোট কৃষিজ জিডিপিতে প্রাণি সম্পদ খাতের অবদান ১৬.৩৩% জন সংখ্যার প্রায় ২০% প্রত্যক্ষ এবং ৫০% পরোক্ষ ভাবে প্রাণিসম্পদ খাতের পরনির্ভরশীল।

প্রাণিসম্পদের বিস্তৃতি আজ গ্রাম থেকে শহরে। লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত তরুণ এবং উদ্যমী জনগোষ্ঠির স্বপ্ন জড়িয়ে আছে এই প্রাণিসম্পদে। তাদের শ্রমঘন বিনিয়োগে খুঁজে পেয়েছে মর্যাদার সাথে বেঁচে থাকার এক আলোকিত পথ। গ্রামীণ জনপদে প্রতিটি পরিবারে পারিবারিকভাবে গবাদিপশু ও হাঁসমুরগী পালন একটি পরমপরা এবং পারিবারিক পুষ্টি ও আয়ের অন্যতম উৎস্য। প্রতিদিনই হাজার হাজার তরুণ যুক্ত হচ্ছে এই স্বপ্ন ছোঁয়ার সিঁড়িতে। বিবর্তনের এই ধারায় প্রথাগত গবাদিপশু ও হাঁস মুরগী পালন ব্যবস্থাপনায় এসেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। ক্রমাগত সম্প্রসারিত হচ্ছে প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক বানিজ্যিক খামার। প্রাণিজ আমিষের সরবরাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই এই খাত দেশে প্রাণিজ আমিষের অন্যতম যোগানদাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রাণিসম্পদ খাত পুষ্টি নিরাপত্তা, মেধাবী ও বুদ্ধিদিপ্ত জাতিগঠন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং জাতীয় অর্থনীতিতে অনবদ্য ভূমিকা রাখছে ।

গবাদিপশু ও হাঁসমুরগীর জাত উন্নয়ন এবং লাগসই সেবা সম্প্রসারণের মাধ্যমে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে এই খাতে। উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। বর্তমানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে গরুর সংখ্যা ২৫০.১৩ কোটি, মহিষ ১৫.২৪ লক্ষ, ছাগল ২৭১.১৭ কোটি, ভেড়া ৩৯.০৩ লক্ষ, হাঁস ৬৮২.৬১ কোটি এবং মুরগি ৩৯৬০.৩৮ কোটি। তাছাড়া মানুষের জীবনমান উন্নয়নের সাথে সাথে উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে বিভিন্ন ধরণের সৌখিন পোষা পশু-পাখি পালন। এখন আর দেশের কোথাও ৮০’র দশকের মত খর্বাকায়, রুগ্ন, হাড্ড্সিার গরু দেখতে পাওয়া যায়না যা আধুনিক ব্যবস্থাপনা এবং প্রাণিসম্পদের বাণিজ্যিকিকরণ, নারীর ক্ষমতায়ন, কর্মসংস্থান এবং সমৃদ্ধ গ্রামীণ অর্থনীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

শুধু গবাদিপশু বা হাঁস-মুরগীর সংখ্যাই বৃদ্ধিই পেয়েছে তা নয়, পরিবর্তন এসেছে প্রাণিজ পণ্য উৎপাদনেও। স্বাধীনতা উত্তর ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে দুধ, মাংস এবং ডিমের উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ১০ লক্ষ মেট্রিক টন, ৫ লক্ষ মেট্রিক টন এবং ১৫০ কোটি। যা বর্তমানে অসংখ্য ক্ষুদ্র, মাঝারী এবং বড় উদ্যোক্তার বিনিয়োগ, ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠা এবং প্রাণিসম্পদের বহুমাত্রিক আধুনিক সেবা সম্প্রসারণের ফলে (২০২৩-২৪ অর্থবছরে) এই উৎপাদন যথাক্রমে ১৫০.৪৪ লক্ষ মেট্রিক টন, ৯২.২৫ লক্ষ মেট্রিক টন এবং ২৩৭৪.৯৭ কোটিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাণিজ পণ্য উৎপাদনের ধারাবাহিকতায় দেশ আজ মাংস ও ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ, দুধ উৎপাদনেও এসেছে কাঙ্খিত সাফল্য। আশা করা যায় অতি অল্প সময়েই দেশ দুধ উৎপাদনেও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে।

মুসলিম উম্মাহর সর্ববৃহৎ উৎসব ঈদ-উল আজহা। একটা সময় ছিল যখন কোরবাণির পশুর চাহিদা মেটাতে পার্শ্ববর্তী দেশের অনুগ্রহের উপর তাকিয়ে থাকতে হতো কিন্তু বর্তমান সেই চিত্র আর নেই। বিগত কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে দেশীয় উৎস্য হতে এই চাহিদা শতভাগ পূরণ করেও গবাদিপশু উদ্বৃত্ত থেকেছে। আমদানী নির্ভরতা থেকে গবাদিপশু উদ্বৃত্তের দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। শুধু তাই নয় এ সময় ঈদ কেন্দ্রিক নানা ধরণের ব্যবসা গ্রামীণ অর্থনীতিতে যুক্ত করে নতুন মাত্রা । মৌসুমী এই ব্যবসায় লেনদেনকৃত অর্থের সিংহ ভাগ ধনিক শ্রেণী থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছেই স্থানান্তরিত ‍হয়।

বাংলাদেশে পুষ্টি উন্নয়নে ব্যাপক সাফল্য রয়েছে তথাপি এখনও বিপুল জনগোষ্ঠি পুষ্টি হীনতায় ভুগছে। গ্লোবাল ফুড সিকিউরিটি ইনডেক্স-২০২২ অনুযায়ী দেশে কম ওজন সম্পন্ন শিশুর সংখ্যা ২২.৬ ভাগ, খর্বাকৃতি শিশুর সংখ্যা ৩০.২ ভাগ এবং ১১.৪ ভাগ মানুষ অপুষ্ঠির স্বীকার। এই অবস্থার উন্নয়নে এবং জাতীয় পুষ্টি নিরাপত্তায় প্রাণিসম্পদের ভূমিকা অপরিসীম।

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার এই দেশে প্রতিদিনই আবাদযোগ্য জমির পরিমান কমে যাচ্ছে অন্য দিকে বৃদ্ধি পাচ্ছে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যসহ প্রনিজ আমিষের চাহিদা। ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান এবং জলবায়ুর পরিবর্তন আমাদের দেশকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। পৃথিবীর ১৮৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৭ম দুর্যোগ প্রবণ দেশ ফলে প্রতিবছরই হিট ওয়েভ, বন্যা, ক্ষরা, ঘুর্ণিঝড়ের প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে যার ফলে দেশে গবাদিপশু ও হাঁস মুরগির সংক্রামক, ইমার্জিং এবং রি-ইমার্জিং রোগের প্রকোপ বেড়ে যাচ্ছে। গবাদিপশু ও হাঁস মুরগীর রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ প্রাণিসম্পদের অন্যতম একটি কার্যক্রম। প্রান্তিক এবং নিম্ন আয়ের মানুষের গবাদিপশু ও হাঁসমুরগীর রোগের চিকিৎসায় ভেটেরিনারি হাসপাতালসমূহ অন্যতম আশ্রয়স্থল। দেশের ৪৯৫ টি উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল, ৬৪টি জেলা ভেটেরিনারি হাসপাতাল, কেন্দ্রীয় ভেটেরিনারি হাসপাতালসহ প্রাণিসম্পদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ নানাবিধ সীমাবধ্যতার মাঝেও এই সেবা প্রদান করে যাচ্ছে।

আগামীর বাংলাদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পুষ্টি নিরাপত্তা, মেধাবী, বুদ্ধিদীপ্ত এবং মজবুত অর্থনীতির দেশ গঠনে দেশের প্রাণিসম্পদকে আরও গতিশীল ও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। এই লক্ষে নিম্ন বর্ণিত কর্মসূচী/কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবেঃ

১) প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে কৃষির সাব সেক্টর হতে পৃথক করে পূর্ণাঙ্গ সেক্টর করা।
২) মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কেদুইটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করা|
৩) প্রাণিসম্পদ সেবাকে অত্যাবশকীয় পরিষেবা হিসেবে ঘোষণা করা-সকল ভেটেরিনারি হাসপাতালে দুই শিফট চালু করা (সকাল ৮টা হতে বিকাল ২টা এবং বিকাল ২টা হতে রাত ৮টা পর্যন্ত)।
৪) প্রাণিজ পণ্য দুধ, ডিম, মাংস উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ এবং বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য বিপনন উইং গঠন করা।
৫) প্রাণিজ পণ্য দুধ, ডিম, মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া ও আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ করা।
৬) জলবায়ু সহিষ্ণু খামার স্থাপন এবং জাত উন্নয়নের মাধ্যমে প্রাণিসম্পদের উৎপাদন বাড়াতে হবে।
৭) প্রাণিসম্পদ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ জোনt Integrated Processing Plant for Livestock Products and by-products.
৮) খামার ভিত্তিক কর্মসংস্থান ও তরুণ উদ্যোক্তা সৃষ্টি/ খামারীদের রেজিস্ট্রেশন কার্ড প্রদান।
৯) খামারীদের মাঝে পশু বীমা চালু করা
১০) পিপিপি মডেলের মাধ্যমে অঞ্চলভিত্তিক ফিডমিল ও হ্যাচারী স্থাপন, বড় ডেইরী ও পোল্ট্রি ফার্ম, ৮টি বিভাগে ৮টি ভ্যাকসিন প্লান্ট স্থাপন এবং চলমান হ্যাচারীসমূহের আধুনিকায়ন
১১) নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, রোগমুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত পশুপালন এবং উৎপাদিত পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরন, সংরক্ষণ ও বাজারজাত নিশ্চিত করা।
১২) Bio-informatics Surveillance and Epidemiologic unit স্থাপন।
১৩) Public Health and Food Safety নিশ্চিতকল্পে Vet. Public health unit স্থাপন।
১৪) Invitro Fertilization (IVF) এর মাধ্যমে অধিক বাচ্চা উৎপাদন, Sexed Semen তৈরী, Local Germplasm এর সংরক্ষণের মাধ্যমে দেশীয়
প্রজাতির উন্নয়ন।