এক জীবন্ত কিংবদন্তীর অবিরাম ছুটে চলার গল্প

মিজানুর রহমান-শাজাহানপুর (বগুড়া) প্রতিনিধিঃ দুর থেকে মনে হবে এক দুরন্ত যুবক মাইলের পর মাইল হেঁটে চলেছেন দূর্গম চরাঞ্চলের তপ্ত বালিয়াড়িতে। দলে তিনি এগিয়ে থাকেন সবার সামনে-পথ দেখিয়ে চলেন নতুন প্রজন্মকে। সরকারি দায়িত্ব থেকে অবসর নিয়েছেন ২০১৮তে। কিন্তু কাজ থেকে অবসর নেননি এক দিনের জন্যও। কাজের মাঝেই তিনি খুজেঁ পান তারুন্যের উৎস। তার অগ্রাধিকার তালিকায় থাকে সবচেয় অবহেলিত, সুবিধা বঞ্চিত আর হত দরিদ্র মানুষ। তাইতো তিনি তার কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন দূর্গম চরাঞ্চল আর হাওড় অঞ্চল যেখানে ঐ মানুষগুলির বসবাস বেশি। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত অঞ্চলে ক্ষতিগ্রস্থ স্থানীয় জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থান আর কোভিড-১৯ মোকাবেলায় তার নেতৃত্বে ও বেশ সুনামও রয়েছে। এ ধরনের মানুষরাই দেশ ও সমাজের অনুকরণীয়। এ কারনেই হয়তো বাংলাদেশ সরকার তাঁকে অনুসরনীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

প্রচলিত অর্থে তিনি শিক্ষক না হলেও দেশ-বিদেশে তার ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা নেহায়েত কম না। তার শিক্ষা-অধিবেশন গুলি সাজানো হয় মূলত: গ্রামীন উদ্ভাবনীকে কেন্দ্র করে। ভিজিটিং সায়েন্টিষ্ট হিসেবে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে গেলে তার ছাত্র-ছাত্রীরা তাকে Ever Green Teacher (EGT) বলে ডাকে। এই ডাক তাকে প্রেরণা দেয়, তারুন্যের শক্তিতে উজ্জীবিত করে। একবার এক আন্তর্জাতিক কর্মসূচিতে তাকে লক্ষ্যে করে ড. এপিজে আব্দুল কালাম বলেছিলেন- His simplicity is his geneous trademark, he can make farmers happy with nothing."

টিভি ম্যাগাজিন ইত্যাদির ২৫ বছরের ইতিহাসে যে ক'জন কৃত্বিমান মানবিক মানুষকে উপস্থাপন করা হয়েছে-সেই তালিকায় বই পাগল পলান সরকারের পাশে তার নামও অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। নন্দিত উপস্থাপক হানিফ সংকেত তাকে ফসলের ডাক্তার বলে ডাকেন। ইত্যাদির দুই এপিসোডে তার গবেষণা কর্মের উপর বিটিভিতে প্রচারিত হয়েছিল প্রতিবেদন। জলবায়ু সহিষ্ণু পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি, গ্রামীন নারীর বীজ প্রযুক্ত, পল্লী ফসল ক্লিনিক প্রভৃতি উদ্ভাবনীর গল্প গাঁথা জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো, যায়যায় দিন, কালের কণ্ঠ, ডেইলি স্টার কভার স্টোরি হিসেবে প্রকাশ করেছিল। বিটিভির মাটি ও মানুষ তার গবেষণাকে অবলম্বন করে অসংখ্য এপিসোড প্রচার করেছে যা এখনও অব্যাহত আছে।

তার ক্রেডিটে রয়েছে দেশ-বিদেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রকাশিত দেড় শতাধিক গবেষণা প্রতিবেদন ও ভিডিও। তার লেখা প্রবন্ধ ইউনিভার্সিটি অব ফিলিপিন্স এ্যাট লস ব্যানোসের টেক্সট বইয়ে স্থান পাওয়ার মর্যাদা পেয়েছে। তার সংগ্রহে রয়েছে সহশ্রাধিক গ্রামীন উদ্ভাবনী যা প্রকৃত পক্ষ্যে জলবায়ু সহিষ্ণু টেকসই কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা ও নারীর ক্ষমতায়নকে নির্দেশ করে।

পেশাগত জীবনের প্রারম্ভিক পর্যায়ে তার একটি গবেষণার ফলাফল দেশের জন্য বয়ে আনে বিশাল এক সুসংবাদ। উচ্চমূল্যে আমদানী নির্ভরতাকে পাশকাটিয়ে দেশের অভ্যন্তরে হাইব্রীড ভুট্টা বীজ উৎপাদনের টেকনিক্যাল প্রটোকল আবিস্কারের ফলে নব্বই দশকের প্রথম দিক থেকে দেশে ভুট্টা চাষাবাদ দ্রুত সম্প্রসারণ হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পোলট্রি ও ডেইরী শিল্প গড়ে উঠতে শুরু করে। অন্যান্য অর্জনের সাথে তার এ অসামান্য অবদানকে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ২০০৪ সালে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক স্বীকৃতি স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রদান করে।

কৃষি অর্থনীতি ভিত্তিক বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদনের একমাত্র মৌলিক উপাদান বীজের ঘাটতি প্রায় ৭০%। গ্রামীন নারীরা এই ৭০% বীজ সরবরাহ করে কৃষি উৎপাদনকে অব্যাহত রেখেছে। তাদের এই ঐতিহাসিক অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে দীর্ঘ ২০ বছরের গবেষণায় উদ্ভাবিত হয় গ্রামীন নারীর বীজ প্রযুক্তি (মারিয়া) মডেল। এ মডেলের কার্যকারিতা এতটাই শক্তিশালী যে, তা দেশ ও দেশের গন্ডি পেরিয়ে সার্কভূক্ত দেশ সমূহে এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ভাষান্তরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। জাতীয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুপরিচিতি লাভ করেন এই গবেষক। দেশের অভ্যন্তরে লাভ করেন কৃষি সেক্টরে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি জাতীয় কৃষি পুরস্কার। এছাড়া এশিয়ার একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে গ্রামীন উদ্ভাবনী (বীজ প্রযুক্তি) বহি: বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার কৌশল উদ্ভাবনের স্বীকৃতি স্বরূপ লন্ডন থেকে তাকে International Communication Award, 2004, এশিয়া মহাদেশে উন্নয়নের আলোক বর্তিকা হিসেবে স্বীকৃতির পাশাপাশি ভারত থেকে Flame Asia Award (Gold Medal) প্রদান করা হয়। সরকার কর্তৃক অনুসরনীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্বীকৃতির পাশাপাশি অর্জন করেন জাতীয় পল্লী উন্নয়ন পুরস্কার (গোল্ড মেডেল)।

এছাড়া খাদ্য নিরাপত্ত, গ্রামীন নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, ক্লাইমেট স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবনের স্বীকৃত স্বরুপ যথাক্রমে ফুড এন্ড এগ্রি এ্যাওয়ার্ড, আইটেব এ্যাওয়ার্ড ও ক্লাইমেট এ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। একুশে পদকের জন্য তিনি দুইবার মনোনয়নও পেয়েছিলেন। তবে এসব নিয়ে তার কোন আগ্রহ নাই। দূর্গম চরাঞ্চলে বসবাসকারী হত দরিদ্র মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে বাস্তবতার নিরিখে কাজ করাই তার স্বপ্ন, তার গতির উৎস।

তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সরকারি অনুমোদনে আরডিএতে প্রতিষ্ঠিত হয় চর উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্র। ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত এ কেন্দ্রের তিনি প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। অবসরের পর তিনি এই কেন্দ্রটির ভার তুলে দিয়েছে তার যোগ্য উত্তরসূরী ড. মোঃ আব্দুল মজিদের উপর। আর তিনি এমিরেটাস সায়েন্টিষ্ট হিসেবে পূর্নদ্দোমে চর উন্নয়ন কেন্দ্রিক গবেষণায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন একজন তরুন গবেষকের মত। সম্প্রতি এ কেন্দ্র থেকে প্রায়োগিক গবেষণা ভিত্তিক জার্নাল এবং চরাঞ্চল উপযোগী ২০টি ক্লাইমেট স্মার্ট প্রযুক্তি সম্বলিত বই প্রকাশিত হয়েছে। এভাবে কেন্দ্রটি ইতোমধ্যে অন্যতম চর উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে দেশে-বিদেশে সুপরিচিতি লাভ করেছে। এক দল নিবেদিত প্রাণ কর্মী সমন্বয়ে এ কেন্দ্রটি দূর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। সেমিনার বা টেলিভিশনের পর্দায় টক শো গুলিতে যখন জলবায়ু সংকট নিয়ে বিশেজ্ঞদের কথার ফুলঝড়ি ফুটতে থাকে তখন তিনি তার অনুজ সহকর্মীদের নিয়ে চরাঞ্চলের মানুষের উন্নয়নে বাস্তব কিছু করার নেশায় এগিয়ে চলেন অবিরাম। তাই এই গল্পের শেষ হয় না।
যাকে নিয়ে এই গল্প তিনি পল্লী উন্নয়ন একাডেমী, বগুড়া সাবেক পরিচালক, বগুড়া জেলার শাজাহানপুর উপজেলার কৃষি সন্তান তথা বাংলাদেশের গর্ব, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কৃষি বিজ্ঞানী- এ সময়ের এক জীবন্ত কিংবদন্তী ড. একেএম জাকারিয়া।

ড. একেএম জাকারিয়ার উদ্ভাবনী সমূহ
 মারিয়া সীড টেকনোলজি
 উইমেন ইন সীড এন্ট্রারপ্রেনীয়রশীপ
 র‌্যুরাল প্লান্ট ক্লিনিক
 গ্রীন ফার্মেসী
 উইমেন টু উইমেন এক্সটেনশন
 ইনোভেশন ট্রি-এ নিউ পিআরএ ট্যুল
 সবুজ শিল্প গ্রাম-ইকোট্যুরিজন
 জিরো ইমিশন ইরিগেশন
 ওয়াটার সেভিং টেকনোলজিস
 ই. সীড: ইন্টারএকটিভ কন্টেন্ট
 বায়োফার্টিলাইজার। বায়োপেষ্টিসাইড
 রিজেনারেটিভ ফার্মিং
 হাইব্রীড সীড প্রোডাকশন প্রটোকল
 ফার্মারস্ সেফটি জোন

ড. একেএম জাকারিয়ার পারদর্শীতা:
• বিগ বাজেট পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট
• ষ্ট্রাটেজিক লিডারশীপ
• এক্সটারনাল নেটওয়ার্কিং
• কমিউনিটি এনগেজমেন্ট
• ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স
• লাইভলিহুড ডিনামিক্স
• কারিকুলাম ডেভেলাপমেন্ট
• নলেজ ম্যানেজমেন্ট
• এসেট ট্রান্সফার
• পলিসি এ্যাডোকেসী
• গ্রীন সিএসআর
• হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলাপমেন্ট
• ফুড সিকিউরিটি। নিউট্রিশন সিকিউরিটি
• দারিদ্র বিমোচন
• এ্যাকশন রিসার্চ
• উইমেন ইকোনোমিক এমপাওয়ারমেন্ট
• এন্ট্রারপেনয়রশীপ ডেভেলাপমেন্ট
• সিস্টেমেটিক চেঞ্জ ইন মার্কেট
• দূর্গম অঞ্চল উন্নয়ন