ড. এম মনির উদ্দিনঃ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (ব্রি) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে আর্ন্তজাতিক ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (ইরি) ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশে প্রথম উচ্চ ফলনশীল আধুনিক ধানের জাত; আইআর-৮ প্রবর্তন করে এবং এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কৃষিতে আধুনিক কৃষির চর্চা শুরু হয়। বিশেষ করে, স্বাধীনতার পর দেশে বিএডিসি আধুনিক ধান চাষের সুবিধার্থে ধানের জমিতে পানিসেচ সহজলভ্য করার জন্য ভু-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের জন্য গভীর নলকুপ স্থাপন করে এবং এর সাথে সাথে দেশে আইআর-৮ আধুনিক জাতের ধানের চাষ বাড়তে থাকে যা বাংলাদেশকে খাদ্য ঘাটতির দেশ থেকে আজকের খাদ্য নিরাপত্তার দেশে পরিণত করার এক মাইলফলক হিসেবে কাজ করে।
দেশের সনাতনী কৃষির পরিবর্তে জমিতে সার, বালাইনাশক, পানিসেচ ব্যবহারের মাধ্যমে আইআর-৮ জাতটি হেক্টরে ফলন দেয় ৮-৯.৫ টন। আধুনিক কৃষির ছোয়ায় কৃষকদের মাঝে প্রানচাঞ্চ্যলতা ফিরে আসতে থাকে এবং প্রথমদিকে জমির উর্বরতা মান ভালো থাকায় মোটা জাতের আরআই-৮ ধানের ব্যাপক ফলনে বাঙ্গালীর ভাতভিত্তিক খাদ্যাভাসের সহজীকরন হতে থাকে। এই জাতটি দীর্ঘদিন কৃষকের জমিতে ভাল ফলন দিতে সক্ষম হয় তবে ১৯৯০ এর শুরুর দিক থেকে জাতটি রোগ পোকার প্রতি সংবেদনশীল হতে থাকে যার কারনে ফলনও কমতে থাকে।
ইতিমধ্যে, দেশে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (ব্রি) কাজ শুরু করে এবং বেশ কয়েকটি আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবন করে যা অঞ্চল ও মৌসুমভিত্তিক ক্রমান্বয়ে মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারিত হতে থাকে। তবে, ফলন কম হলেও কৃষক আইআর-৮ এর চাষ ছাড়তে চায়না। এমন অবস্থায় ধানের বিকল্প জাতের মাধ্যমে দেশের খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে ব্রি দেশের সকল এলাকার জন্য চাষাপোযোগী দুইটি ধানের জাত; ব্রি ধান২৮ এবং ব্রি ধান২৯ ১৯৯৪ সালে অবমুক্ত করে এবং এই দুইটি ধানের জাত পরবর্তীতে দেশের ধানের উৎপাদন বাড়াতে নুতন মাইলফলক হিসেবে কাজ করে। তবে, এই জাত দুইটি মাঠ পর্যায়ে খুব সহজে সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়নি। কারন, আইআর-৮ যখন বিঘায় ১০-১২ মন ফলন দিচ্ছে তখনো কৃষক বিকল্প কোন জাত ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছিলো না। অর্থ্যাৎ, কৃষকেরা দীর্ঘদিন ধরে চাষ করার ফলে আইআর-৮ এর মোহ থেকে বের হয়ে আসতে পারছিলোনা। এভাবে, দেশে ২০০০ সালের পরেও আইআর-৮ এর চাষ অব্যাহত ছিলো।
পরবর্তী সময়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নিবিড় প্রদর্শনী স্থাপনসহ বিভিন্ন সচেতনতামুলক কার্যক্রমের ফলে ধীরে ধীরে ব্রি ধান২৮ এবং ব্রি ধান২৯ এর সম্প্রসারণ হতে থাকে এবং ২০১৮ সাল পর্যন্ত কৃষকেরা অন্যান্য আরো উচ্চ ফলনশীল অনেক জাত ব্রি থেকে বের হলেও মুলত ব্রি ধান২৮ এবং ব্রি ধান২৯ এর চাষ অব্যাহত রাখে। কয়েক বছর ধরেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় কৃষকেরা ব্রি ধান২৮ চাষ করে বিড়ম্বনায় পড়ে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে বোরো মৌসুমে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ব্রি ধান২৮ জাতটি ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হওয়ায় কৃষকেরা মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ইতিমধ্যে জাতটি ব্লাস্ট রোগে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হওয়ার কারনে কৃষি বিভাগ এর চাষ নিষিদ্ধ করেছে এবং কৃষকেরাও বিকল্প জাত চাষ শুরু করছে।
ব্রি ধান২৯ এর ফলন হেক্টরে ১০ টন পর্যন্ত কৃষকের জমিতে পাওয়া গেছে এবং দেশের বোরো ধানের অধিকাংশ এলাকা একসময় ব্রি ধান২৯ চাষের আওতায় চলে আসে। সম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের জনপ্রিয় এই ব্রি ধান২৯ জাতটিও ব্লাস্ট রোগের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে এবং বর্তমানে এই জাতটির চাষেও একটি বড় ধরনের ঝুঁকি রয়েছে। কারন, ব্রি ধান২৯ জাতটি যদি আবহাওয়াজনিত কারনে আংশিকভাবেও ব্লাস্ট রোগের শিকার হয় তাহলে বোরো মৌসুমের মোট ধানের উৎপাদনে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলবে।
ব্রি বিগত দিনগুলোতে গবেষণা চালিয়ে জলবায়ুর পরিবর্তন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে জলবায়ু বান্ধব, উচ্চ ফলনশীল এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ বেশ কয়েকটি ধানের জাত অবমুক্ত করেছে বোরো মৌসুমে চাষ করার জন্য। পক্ষান্তরে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ব্রি ধান২৮ এবং ব্রি ধান২৯ এর পরিবর্তে কৃষকদেরকে উচ্চ ফলনশীল নুতন জাতগুলো চাষাবাদের জন্য উদ্বুদ্ধ করছে। তবে, কৃষক ঐ আইআর-৮ এর মত ব্রি ধান২৮ ও ব্রি ধান২৯ এর মায়ায় পড়ে রয়েছে।
দেশের প্রধান খাদ্য ফসল ধানের ৩টি মৌসুম যেমন বোরো, আমন, আউশ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী ফলন আসে বোরো মৌসুম থেকে। বোরো মৌসুম থেকে আরো বেশী ধানের উৎপাদন নিয়ে আসা সম্ভব এবং এটি দেশের ক্রমবর্ধমান মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটাতে আবশ্যক। তবে, এর জন্য সঠিক জাত নির্বাচন একটি অতীব গুরুত্বপুর্ন বিষয়। বর্তমানে ব্রি কর্তৃক অবমুক্ত হওয়া উচ্চ ফলনশীল বোরো জাতের মধ্যে ব্রি ধান ৭৪, ব্রি ধান৮৯, ব্রি ধান৯০, ব্রি ধান৯২, ব্রি ধান১০০, ব্রি ধান১০২, ব্রি ধান১০৪, ব্রি ধান১০৫, ব্রি ধান১০৭, ব্রি ধান১০৮ এবং বিনা ধান২৫ উল্লেখযোগ্য।
ইতিমধ্যে জলবায়ুর পরিবর্তন দেশের কৃষি উৎপাদন বিশেষ করে ধানের ফলনে প্রভাব ফেলেছে। গত বোরো মৌসুমে মার্চ-এপ্রিলে তাপমাত্রা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৪০-৪৩ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের মধ্যে উঠানামা করেছে যা আমাদের গতানুগতিক বোরো ধানের জাতগুলোর ফুল ফোটার সময়ে অতিরিক্ত তাপমাত্রা ফলনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতেই পারে। সেইসাথে, তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে আশংকা বেড়ে যায় ব্লাস্ট রোগের যার আক্রমনের শিকার হতে পারে ব্রি ধান২৮ এবং ব্রি ধান২৯।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, বেশ কয়েকটি প্রাইভেট বীজ বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ব্রি ধান২৮ এবং ব্রি ধান২৯ এর বীজ বিক্রয়ের জন্য ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছে। কোন একটি বীজ বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান যে, ব্রি ধান২৯ এখনো দেশের মেগা ভ্যারাইটি এবং বোরো মৌসুমে ব্রি ধান২৯ এর চাষের এলাকা বেশী। তাদের মতে, ব্রি ধান২৯ কে টেক্কা দেয়ার মত এখনো সেইরকম কোন জাত বের হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির মতে, ব্রি ধান২৯ এখনো ব্রি ধান৫৮, ব্রি ধান৮৯, ব্রি ধান৯২, ব্রি ধান১০২ থেকে বিঘায় ২-৩ মন ফলন বেশী দেয়। দেশের উত্তরাঞ্চল বিশেষ করে ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুরে ব্রি ধান২৯ এর বীজ ১,০০০ কেজি বিক্রয় হলে অন্যান্য জাতের বীজ নাকি বিক্রয় হয় ৫০ কেজি।
এখন বিবেচ্য বিষয় হলো যে, ব্রি ধান২৯ নিঃসন্দেহে একটি ভাল ধানের জাত যার ফলনও বেশ সন্তোষজনক। তবে, ব্রি ধান২৮ এবং ব্রি ধান২৯ অবশ্যই ব্লাস্ট রোগের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং যদি ব্লাস্ট রোগের বড় ধরনের কোন বিপর্যয় হয় তাহলে বোরো উৎপাদনে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটবে এই ব্রি ধান২৮ এবং ব্রি ধান২৯ চাষের কারনে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ব্রি ধান২৮ এবং ব্রি ধান২৯ এর চাষ কমিয়ে যেখানে নুতন জাতগুলো প্রবর্তনের চেষ্টা করছে সেখানে প্রাইভেট বীজ প্রতিষ্ঠানগুলো কিভাবে অপরিকল্পিতভাবে ব্রি ধান২৮ এবং ব্রি ধান২৯ এর বীজ বিক্রয় করে চলছে তা বোধগম্য নয় এবং এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সরকারী প্রতিষ্ঠানের কোন মনিটরিং আদৌ আছে কিনা সন্দেহ।
চলতি আমন মৌসুমে দেশের পুর্বাঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলে বন্যার কারনে আমনের ফলন কিছুটা কমে যেতে পারে যা উত্তোরনের জন্য আসন্ন বোরো মৌসুমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল মিলে বোরোর আওতায় জমির পরিমান বাড়ানোর জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যসুত্রে জানা যায়, আগামী বোরো চাষের আওতায় জমির পরিমান দাড়াতে পারে প্রায় ৫১ লাখ হেক্টর যা অর্জিত হলে দেশের বোরো ধানের উৎপাদন অনেকাংশে বেড়ে যাবে যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় অত্যন্ত সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়। আরো জানা যায়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আগামী বোরো মৌসুমে ৩০ লাখ বিঘার জন্য প্রনোদনার আওতায় কৃষকের মাঝে বীজ ও সার বিনামুল্যে বিতরন করবে। প্রনোদনার আওতায় বিতরনকৃত বোরো ধানের জাতগুলো হবে ব্রি ধান৬৭, জিংক সমৃদ্ধ ব্রি ধান৭৪, ব্রি ধান৮৮, ব্রি ধান৮৯ এবং ব্রি ধান৯২।
বোরো মৌসুমে চাষের জন্য কৃষক পর্যায়ে মানসম্পন্ন বীজ ব্যবহারের মাত্রা বেড়েছে। কারন বীজের মোট চাহিদা প্রায় ১.৫ লাখ টন যার মধ্যে বিএডিসি ৫০ হাজার টনের উপরে সরবরাহ করছে এবং প্রাইভেট সেক্টরও সমপরিমান বীজ সরবরাহ করছে। কৃষক পর্যায়েও কিছু মানসম্পন্ন বীজ সংরক্ষন ও ব্যবহার হচ্ছে যা নিঃসন্দেহে উৎপাদনে ভাল প্রভাব ফেলবে। যে কোন একটি ধানের উন্নত জাত থেকে ভাল ফলন পাওয়ার জন্য তা অবমুক্ত হওয়ার ৫ বছরের মধ্যে মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণ করতে হবে এবং মাঠ পর্যায়ে চাষের জন্য ১০ বছর রাখা সঠিক হবে। তারপর, জাতটি বিভিন্ন কারনে তার গুনাগুন হারাতে থাকায় ফলন ভাল দিতে সক্ষম হবে না বিধায় নুতন জাত পুনরায় সম্প্রসারণ কতে হবে। কিন্তু, ব্রি ধান২৮ এবং ব্রি ধান২৯ এ দুটি জাত ১৯৯৪ সালে অবমুক্ত হওয়ার পর এখন তার বয়স হয়েছে প্রায় ৩০ বছর যা এখনো মাঠে আছে। এটি বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য নিশ্চয়ই একটি হুমকি।
বিএডিসি ব্রি ধান২৮ এর বীজ আসন্ন বোরো মৌসুমে সরবরাহ করার কথা না থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি ব্রিধান ২৮ এর বীজ সরবরাহ করছে। ব্রি ধান২৯ এর বীজ উৎপাদনে বিএডিসি’র সকল বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এবারো দ্বিতীয় অবস্থানে (১৩,২৭০ টন)। অথচ, দেশের খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে কৃষকের মাঠে কমপক্ষে ৪/৫ ধানের জাতের প্রাধান্য থাকা উচিত যেখানে দেশের বোরো মৌসুমে বর্তমানে ৩০ বছরের পুরনো ব্রি ধান ২৯ এর প্রাধান্য বিরাজ করছে।
পলিসি পর্যায়ে যারা এ সকল বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কাজ করার কথা তারা কতটুকু দায়িত্ব পালন করছেন জানিনা। তবে, আগামীদিনগুলোতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিকে আরো বেশী গুরুত্ব দিয়ে কৃষকের মাঠে সঠিক সময়ে সঠিক জাতটি যাতে পৌছে দেয়া যায় তার জন্য সচেতন হবেন বলে আশা করছি।
লেখকঃ এগ্রোনমিস্ট অ্যান্ড কনসালট্যান্ট, গেইন বাংলাদেশ