ড. মোঃ গাজী গোলাম মর্তুজাঃ আজ ০৭ অক্টোবর ২০২৪ বিশ্ব তুলা দিবস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৩০ আগস্ট, ২০২১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ৭ অক্টোবরকে বিশ্ব তুলা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তুলার বিশ্বব্যাপী গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরার জন্য ২০১৯ সাল থেকে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।
এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে "তুলার জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ বুনি"। পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক তন্তু তুলার গুরুত্ব বিবেচনা করে গত বছর ০৭ অক্টোবর, ২০১৯ প্রথমবারের মত ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের (WTO) জেনেভা সদর দফতরে বিশ্ব তুলা দিবস ২০১৯ উৎযাপিত হয়। তুলা উৎপাদনকারী, ব্যবহারকারী দেশ থেকে প্রায় সাত শতাধিক ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেছিল।
বিশ্ব তুলা দিবস প্রতিষ্ঠার জন্য তুলা উৎপাদনকারী চার দেশ- বেনিন, বুরকিনা ফাসো, চাদ এবং মালি ২০২০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে (UNGA) একটি আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব (A/RES/75/318) দেয়। সে মোতাবেক জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৩০ আগস্ট, ২০২০ আনুষ্ঠানিকভাবে ৭ অক্টোবরকে বিশ্ব তুলা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বিশ্বজুড়ে তুলার বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবকে স্বীকার করে এবং স্বীকৃতি দিয়ে জাতিসংঘ বিশ্ব তুলা দিবস ঘোষণা করে এবং এটি জাতিসংঘের স্থায়ী ক্যালেন্ডারে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এর পর থেকে প্রতিবছর ৭ অক্টোবর, তুলার গুরুত্ব বিশ্বব্যাপী তুলে ধরার জন্য বিশ্ব তুলা দিবস পালন করা হচ্ছে। প্রাকৃতিক তন্তু হিসাবে বিশ্বজুড়ে তুলার উৎপাদনকারী, ব্যবসায়ী এবং ব্যবহারকারী কিভাবে উপকৃত হবে, তা তুলে ধরা হবে। বিশ্ব তুলা দিবস তুলার উপর ইতিবাচক প্রভাব প্রদর্শন করার একটি বিরাট সুযোগ।
বিশ্বের ৭৫ টিরও বেশি দেশে তুলা উৎপাদিত হয়। এটি বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশে দারিদ্র্য-বিমোচনকারী ফসল, যা মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে। এটি একমাত্র কৃষি পণ্য যা আঁশ এবং খাদ্য উভয়ই সরবরাহ করে। শুষ্ক, খড়া ও লবনাক্ততা জমিতে ও তুলা উৎপাদন করা যায়, যা অন্য ফসলে সম্ভব নয় । বিশ্ব তুলা দিবস ২০২৪-এর উদ্দেশ্য হল স্বল্পোন্নত দেশগুলিতে (এলডিসি) কর্মসংস্থান সৃষ্টি, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে এর ভূমিকা তুলে ধরার একটি সুযোগ, টেকসই বাণিজ্য নীতিকে উৎসাহিত করা এবং উন্নয়নশীল দেশগুলিকে তুলার প্রতিটি ধাপ থেকে উপকৃত হতে সক্ষম করা।
১০০ টিরও বেশি দেশ তুলা আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যে জড়িত। তুলা উৎপাদন, জিনিং, টেক্সটাইল, গার্মেন্টস, ভোজ্যতেল এবং সাবান শিল্প ইত্যাদির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ লোকের জীবিকা নির্বাহ করে। তুলা বিশ্বের অন্যতম টেক্সটাইল তন্তু এবং তুলা অর্থনৈতিক ও সামাজিক কল্যাণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।
বিশ্বের গ্রীষ্মমন্ডলীয় ও নাতিশীতোষ্ঞ অঞ্চলের জন্য তুলা ফসল পুরোপুরি উপযুক্ত। সামগ্রিকভাবে, তুলা বিশ্বের আবাদযোগ্য জমির মাত্র ২.১ শতাংশ দখল করে এবং এখনও বিশ্বের টেক্সটাইল সেক্টরের ২৭ শতাংশ পূরণ করে।
বিশ্বে তুলা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্থকরী ফসল। প্রতি বছর ৩৩-৩৫ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে বিশ্বের গ্রীষ্মমন্ডলীয় ও নাতিশীতোষ্ঞ অঞ্চলের সত্তরটিরও বেশি দেশের তুলা চাষ করা হয়, যা সমস্ত পৃথিবীর আবাদকৃত জমির ২.৫ শতাংশ। ১০০ মিলিয়নেরও বেশি পরিবার সরাসরি তুলা উৎপাদনের সাথে জড়িত এবং ২৫-২৬ মিলিয়ন টন কাঁচা তুলা উৎপাদন করে, যেখানে প্রতি হেক্টরে গড়ে প্রায় ৮০০ কেজি আঁশতুলা উৎপাদিত হয়। কৃষি ফসলের মধ্যে অনন্য হলো তুলা। বীজতুলা থেকে প্রথমত আমরা আঁশ পেয়ে থাকি, এছাড়া উপজাত হিসেবে বিশ্বে প্রতি বছর পাঁচ কোটি টনেরও বেশি তুলাবীজ উৎপাদিত হয়। তুলাবীজ থেকে আমরা ভোজ্য তেল ও খৈল পেয়ে থাকি। খৈল গবাদি পশু ও মাছের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
প্রাকৃতিক তন্তু তুলা ব্যবহার দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এক সময় পঞ্চাশ ভাগের অধিক প্রকৃতিক তন্তু তুলার ব্যবহার ছিল, বর্তমানে তা ২৭ ভাগে নেমে এসেছে। এই কারণে, প্রকৃতিক তন্তুর গুরুত্ব বিবেচনা করে ২০০৯ সালকে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক তন্তুবছর ঘোষণা করেছিল।
বর্তমানে বস্ত্র এবং গার্মেন্টস খাত বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত। বাংলাদেশে বস্ত্র খাতের ৪৫০ টি সুতাকলের জন্য বছরে প্রায় ৮০-৮৫ লক্ষ বেল আঁশ তুলার প্রয়োজন হয়, যার সিংহভাগ বিদেশ থেকে আমদানী করে মেটানো হচ্ছে এবং এই চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ পরিমান তুলা আমদানী করতে প্রতিবছর প্রায় ২৫-৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। বর্তমানে আমাদের দেশে মোট চাহিদার মাত্র তিন ভাগ পূরণ করতে পারে, বাকী ৯৭ ভাগ তুলা বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়। ৫০০০ গার্মেন্টস ও তৈরী পোশাকের অন্যান্য খাতে প্রায় ৫০ লক্ষ লোক সরাসরি জড়িত। এসব বিবেচনায় বিশ্ব তুলা দিবস বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪৬.৯৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে বস্ত্রখাত থেকে। তাছাড়া আমাদের বৈদেশিক মূদ্রা আয়ের ৮৪ ভাগই আসে তৈরী পোশাক খাত থেকে। এক টন তুলা গড়ে পাঁচ জনকে প্রায় বছরব্যাপী কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়। কৃষি ফসলের মধ্যে তুলাই একমাত্র ফসল, যা থেকে খাদ্য ও বস্ত্র দুই ই পাওয়া যায়। বীজতুলা থেকে প্রথমত আমরা আঁশ পেয়ে থাকি, এছাড়া উপজাত হিসেবে বিশ্বে প্রতি বছর পাঁচ কোটি টনেরও বেশি তুলাবীজ উৎপাদিত হয়। তুলাবীজ থেকে আমরা ভোজ্য তেল ও খৈল পেয়ে থাকি। খৈল গবাদি পশু ও মাছের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এ জন্য বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক গুরুত্বের বিচারে বিশ্ব তুলা দিবস ২০২৪ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্ব তুলা দিবস ২০২৪ এর উদ্দেশ্যগুলি হলো, তুলার ব্যবহার ও চাহিদা বৃদ্ধি করা এবং তুলার উপকারিতা এবং মূল্য সম্পর্কে জনগনকে অবহিত করা, বিশ্বজুড়ে তুলার জন্য ইতিবাচক মিডিয়া কভারেজ তৈরি করা, তুলার গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলির সরকারী প্রতিনিধিদের কাছ থেকে সমর্থন পাওয়া, ডাব্লুটিও এবং ইউএনকে জড়িত করা এবং বিশ্ব তুলা দিবসটিকে আনুষ্ঠানিক ইউএন ক্যালেন্ডারে যুক্ত করা, ব্র্যান্ড এবং খুচরা বিক্রেতাদের তাদের স্টোরগুলিতে বা তাদের ওয়েবসাইটে তুলার ব্যাপক প্রচার করা।
বিশ্ব তুলা দিবস ২০২৪-এর মধ্য দিয়ে তুলা উৎপাদন, জিনিং, স্পিনিং, গার্মেন্টস, ব্র্যান্ড বা খুচরা বিক্রেতা, গ্রাহক, শিক্ষাবিদ, গবেষক, মিডিয়া কর্মী, এনজিও এবং সরকারী কর্তৃপক্ষের মতো প্রতিটি অংশীজন গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবে । উৎপাদকরা তুলা উৎপাদন করে, জিনিং স্পিনিং ও গার্মেন্টসে তুলা ব্যবহার করে এবং তুলার পণ্য উৎপাদন করে, ব্র্যান্ড বা খুচরা বিক্রেতা তুলা পছন্দের সিদ্ধান্তে প্রভাবিত করে, সবশেষে গ্রাহক বা ব্যবহারকারী তুলার জন্য চাহিদা এবং পছন্দ বৃদ্ধি করে। শিক্ষাবিদরা ইতিবাচক ধারণা অর্জনের জন্য তুলা সম্পর্কে প্রশিক্ষিত করেন, গবেষকরা তুলা শিল্পে ক্রমাগত উন্নতি এবং নতুনত্ব আনতে গবেষণার জন্য অর্থায়নকে উৎসাহিত করেন। মিডিয়া তুলা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারনা তৈরীতে সহায়তা করে, এনজিওগুলি ইতিবাচক অংশীদারিত্ব করে এবং সর্বশেষে তবে সরকারী কর্তৃপক্ষ তুলা উৎপাদন এবং বাণিজ্য নীতি তৈরীতে সহায়তা করেন।
প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ লোক তুলা থেকে উৎপাদিত পোশাক ব্যবহার করছে এবং আগামীতে তুলার চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। এই চাহিদা বৃদ্ধির ফলে টেকসই তুলার প্রয়োজন বাড়বে। আমাদের পরিবেশকে ঠিক রেখে তুলা উৎপাদন করতে হবে। বিশ্বব্যাপী প্রচলিত তুলা উৎপাদনে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পরিবেশ দূষিত হয়। তাই টেকসই তুলা উৎপাদন এই সমস্যার সবচেয়ে ভালো সমাধান। বিপজ্জনক রাসায়নিকের ব্যবহার হ্রাস করে ও কম পানি ব্যবহার করে টেকসই তুলা উৎপাদন করতে হবে। এতে কৃষকের আয় বৃদ্ধি পাবে ও দারিদ্র্য হ্রাস পাবে। বাংলাদেশে ও কটন কানেক্ট এর সহযোগিতায় টেকসই তুলা উৎপাদন শুরু হয়েছে।
তুলা পৃথিবীর অনেক দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে মূল ভূমিকা পালন করে যে কারণে এটিকে বিশ্বের অনেক দেশের কাছে হোয়াইট গোল্ড হিসেবে পরিচিত। অনরূপভাবে বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক গুরুত্বের বিচারে বিশ্ব তুলা দিবস ২০২৪ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং, বিশ্ব তুলা দিবস ২০২৪ অর্থনৈতিক বিচারে গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
লেখকঃ মৃত্তিকা উর্বরতা ও পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ
তুলা উন্নয়ন বোর্ড, ঢাকা