বর্ষবরণের আতশবাজি: জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের জন্য এক অদৃশ্য হুমকি

রোটারিয়ান ড. মো; হেমায়েতুল ইসলাম আরিফ
ইংরেজি বর্ষবরণ আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ নয়; এটি মূলত পশ্চিমা সংস্কৃতির একটি অনুষঙ্গ। সময়ের পরিক্রমায় এই উৎসব আমাদের সমাজেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে আতশবাজি, পটকা, ও নানান আলোকসজ্জার মাধ্যমে আমরা আমাদের আনন্দ ও উদ্দীপনা প্রকাশ করে থাকি। রাতের আকাশ রঙিন আতশবাজির ঝলকানিতে ঝলমল করে ওঠে, শহরজুড়ে তৈরি হয় উৎসবের এক আনন্দঘন পরিবেশ। কিন্তু এই উল্লাসের পেছনে যে অদৃশ্য বিপদ লুকিয়ে রয়েছে, তা অনেকের কাছেই অজানা। আতশবাজির তীব্র শব্দ, বিষাক্ত ধোঁয়া এবং রাসায়নিক পদার্থ আমাদের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করে। বাংলা সংস্কৃতির ঐতিহ্য এবং পরিবেশ রক্ষার জন্য বর্ষবরণের এই উদযাপনে দেশীয় রীতিনীতি ও পরিবেশবান্ধব উপায় অবলম্বন করা অত্যন্ত জরুরি।

আতশবাজির পরিবেশগত প্রভাব

আতশবাজি ও পটকার ব্যবহার বায়ু, পানি, এবং শব্দ দূষণ বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ। এগুলোর মধ্যে থাকা রাসায়নিক উপাদান যেমন সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, ভারী ধাতু (লেড, পারদ, ক্যাডমিয়াম) ইত্যাদি বায়ুমণ্ডলে মিশে গিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে। এগুলোর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব গাছপালা, পশুপাখি, এবং মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক।

১. শব্দ দূষণ:

আতশবাজির বিকট শব্দ পাখি, বন্যপ্রাণী, এবং গৃহপালিত প্রাণীদের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। অনেক পাখি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বাসা ছেড়ে পালিয়ে যায়, ডিম বা বাচ্চা ফেলে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক পাখি আতশবাজির শব্দে হার্ট অ্যাটাক করেও মারা যায়। এছাড়া গৃহপালিত প্রাণী যেমন কুকুর, বিড়াল আতশবাজির শব্দে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ওঠে এবং অনেক সময় পালিয়ে যায়।

২. আলোক দূষণ:

অতিরিক্ত আলোকসজ্জা এবং আতশবাজির তীব্র আলোক ঝলকানি পাখিদের দিকভ্রান্ত করে। রাতজাগা প্রাণীরা তাদের স্বাভাবিক খাদ্য সংগ্রহের রুটিন থেকে বিচ্যুত হয়। বিশেষ করে পরিযায়ী পাখিরা তাদের নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছাতে বাধার সম্মুখীন হয়।

৩. বায়ু দূষণ:

আতশবাজি বিস্ফোরণের সময় বিপুল পরিমাণে কার্বন ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, এবং অন্যান্য বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হয়। এগুলো বাতাসের গুণমানকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিশেষ করে শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগী, শিশু, এবং বৃদ্ধদের জন্য এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক।

৪. পানি মাটির দূষণ:

আতশবাজির অবশিষ্টাংশ মাটিতে মিশে পানি দূষণ ঘটায়। বৃষ্টির মাধ্যমে এই বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ জলাশয়ে প্রবেশ করে এবং জলজ জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।

জীববৈচিত্র্যের ওপর আতশবাজির প্রভাব

আতশবাজির শব্দ এবং আলো শুধুমাত্র পাখি বা গৃহপালিত প্রাণীর ওপর নয়, বন্যপ্রাণীদের জীবনচক্রের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলে।

  • রাতজাগা প্রাণী: বাদুড়, পেঁচা, এবং অন্যান্য নিশাচর প্রাণী আতশবাজির বিকট শব্দ ও তীব্র আলোয় তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।
  • পরিযায়ী পাখি: অনেক পাখি আতঙ্কে দিকভ্রান্ত হয়ে তাদের উড়ানের পথ হারিয়ে ফেলে।
  • বন্যপ্রাণী: আতশবাজির শব্দে অনেক বন্যপ্রাণী তাদের স্বাভাবিক আশ্রয়স্থল ত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং শিকারির হাতে ধরা পড়ার ঝুঁকিতে পড়ে।

মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর আতশবাজির প্রভাব

  • শ্বাসকষ্ট: বিষাক্ত গ্যাস শ্বাসনালিতে ঢুকে শ্বাসকষ্ট এবং অ্যাজমার প্রকোপ বাড়ায়।
  • চোখের সমস্যা: আতশবাজির রাসায়নিক পদার্থ চোখে জ্বালা এবং প্রদাহ সৃষ্টি করে।
  • মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব: বিকট শব্দ শিশু এবং প্রবীণদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করে।
  • দুর্ঘটনা: অসতর্ক আতশবাজি ব্যবহারের কারণে অনেক সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে, যা প্রাণহানি ঘটাতে পারে।

সমাধান কী?

পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যের এই ক্ষতি রোধে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। কিছু বাস্তবসম্মত সমাধান হতে পারে:

  1. আতশবাজি নিষিদ্ধ করা বা নিয়ন্ত্রিত করা।
  2. পরিবেশবান্ধব উৎসব উদযাপন।
  3. জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।
  4. সরকারি কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ।
  5. পরিবেশবান্ধব আলোকসজ্জা বিকল্প বিনোদনের ব্যবস্থা।
  6. পাখি প্রাণীদের সুরক্ষার জন্য নির্দিষ্ট এলাকা আতশবাজিমুক্ত রাখা।

উপসংহার

বর্ষবরণের উৎসব আমাদের জীবনের আনন্দময় একটি অধ্যায়, যা নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনা ও আশার আলো নিয়ে আসে। তবে এই আনন্দ যেন অন্য কোনো প্রাণী বা প্রকৃতির জন্য ক্ষতির কারণ না হয়, সেদিকে আমাদের অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে। আতশবাজি, পটকা, এবং শব্দবাজির বিকট শব্দ ও বিষাক্ত ধোঁয়া কেবল মানবস্বাস্থ্য নয়, পাখি, বন্যপ্রাণী এবং পরিবেশের ওপরও দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই বর্ষবরণের আনন্দ উদযাপনের পদ্ধতিতে আমাদের পরিবেশবান্ধব ও দায়িত্বশীল আচরণ নিশ্চিত করতে হবে। একমাত্র সচেতনতা, সদিচ্ছা এবং যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখতে পারি। আসুন, নতুন বছরকে স্বাগত জানাই শান্তি, ভালোবাসা এবং প্রকৃতির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে, যাতে আগামী প্রজন্মের জন্য আমরা একটি সুস্থ ও টেকসই পরিবেশ রেখে যেতে পারি।