কৃষিবিদ শামীমুর রহমান শামীমঃ বাংলাদেশের রাজনীতিতে শহীদ রাস্ট্রপতি জিয়াউর রমান অমর ও একটি অবিস্মরণীয় নাম। তিনি একই সাথে সৈনিক, সেনাবাহিনী প্রধান, চট্রগ্রাম কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করে মুক্তি সংগ্রামের যোদ্ধাদেরকে অনুপ্রেরণা প্রদানকারী, রাজনীতিক, রাষ্ট্রনায়ক, কোটি কোটি বাঙালির 'জনতার জিয়া' ইত্যাদি নানান নাম ও সম্মানে ভূষিত। প্রকৃত ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমান নামটি গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। তাঁর গড়া দল বিএনপির প্রধান নেতা এখন তাঁরই সুযোগ্য পুত্র তারেক রহমান। শেখ হাসিনা সরকারের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটার পরে এসময়ে তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির ৩১ দফা এখন রাজনীতির মাঠে আলোচিত এক দলিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কিছু কথা সংক্ষেপে তুলে ধরা যাক।
একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা দেশপ্রেমিক নেতা হঠাৎ এসেই কোটি কোটি বাঙালির প্রাণের মানুষ হয়ে উঠেননি। কোন বিশেষ মানুষকে মানুষের ভালোবাসার মানুষ হিসেবে হয়ে উঠার পিছনে থাকে সাহস, কর্তব্যের প্রতি একনিষ্ঠতা, সততা, দেশপ্রেম এবং সর্বোপরি মানুষের প্রতি ভালোবাসা। জিয়াউর রহমানের মধ্যে মানুষের মন জয় করে গণমানুষের নেতা হয়ে উঠার গুণাবলী ছিলো। এজন্যই স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মাঝে তিনি অতি আপনজন হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন।
ইতিহাস ঘাটলে জানা যায় জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ খ্রীষ্টিয় সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়া জেলার বাগবাড়ী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। জিয়াউর রহমানের ডাক নাম ছিলো কমল। তাঁর পিতার নাম মনসুর রহমান এবং মায়ের নাম জাহানারা খাতুন (রাণী)। তাঁর পিতা তৎকালীন বৃটিশ ভারতের কলকাতা শহরের এক সরকারি দপ্তরে রসায়নবিদ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জিয়াউর রহমানের পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর শৈশবের প্রথম দিকে কিছু কাল কেটেছে বগুড়ার গ্রামাঞ্চলে এবং কলকাতার নগর জীবনে। তাঁর পিতা চাকরি করতেন, তাই তিনিও পিতার সাথে থাকতেন এবং সেখানে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়। তখন কলকাতার হেয়ার স্কুলে তিনি পড়াশোনা করতেন। কিন্তু তৎকালীন বৃটিশ-ভারতের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের নানানরকম ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পরে অর্থাৎ ভারতবর্ষ ভারত ও পাকিস্তান দুই নামে দুটি পৃথক দেশ হিসেবে ভাগ হওয়ার পরে তাঁর পিতা কলকাতা শহর ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচী নগরীতে চলে যান এবং সেখানেই জিয়াউর রহমান করাচী একাডেমি স্কুলে ভর্তি হন।
জানা যায়, ওই করাচী একাডেমি স্কুল থেকেই তিনি ১৯৫২ সালে কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জন করেন। এরপর তিনি কলেজে ভর্তি হন ১৯৫৩ সালে করাচীর ডি.জে. কলেজে। জিয়াউর রহমান অত্যন্ত সাহসী ও মেধাবী ছিলেন। একই বছর তিনি পাকিস্তানের কাকুল মিলিটারি একাডেমিতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। জিয়াউর রহমান প্রথম থেকেই সকল ক্ষেত্রে তাঁর মেধা খাটিয়ে নিজেকে যোগ্য করে তুলেছেন এবং দক্ষতা দ্বারা সুনাম অর্জন করে এগিয়েছেন বীরের বেশে।
তিনি ছিলেন সামরিক বাহিনীতে একজন বিচক্ষণ অফিসার এবং কমান্ডো। এক্ষেত্রে তিনি তাঁর দক্ষতা দেখিয়ে অল্প সময়ে সেনাবাহিনীর অফিসার ও সাধারণ সৈনিকদের মাঝে সুপরিচিত একজন হয়ে উঠেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি স্পেশাল ইন্টেলিজেন্স কোর্সে ভর্তি হন এবং উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সামনে এগিয়ে চলার পথ তৈরি করেন।
ইতিহাসের খোঁজে পাওয়া যায়, ১৯৬৫ সালের ভারত ও পাকিস্তানের ভয়াবহ যুদ্ধের কথা। তৎকালীন ঐতিহাসিক ওই যুদ্ধে জিয়াউর রহমান একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে তাঁর জীবনের অসীম সাহস নিয়ে খেমকারান সেক্টরে যুদ্ধ পরিচালনা করে যে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন তা ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে। ওই যুদ্ধে তাঁর সাহসিকতার পরিচয় পেয়ে পাকিস্তান সরকার জিয়াউর রহমানকে হিলাল-ই-জুরাত খেতাবে ভূষিত করে। এ গৌরব বাঙালি সৈনিকের।
হিলাল-ই-জুরাত খেতাব পাওয়ার পর জিয়াউর রহমান ১৯৬৯ সালে সেনাবাহিনীর মেজর পদে উন্নীত হন। জিয়াউর রহমান জয়দেবপুরে সেকেন্ড ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন-কমান্ড পদের দায়িত্ব লাভ করেন। এরপর তিনি দেশের বাহির থেকে নিয়মিত সামরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি অ্যাডভান্সড মিলিটারি অ্যান্ড কমান্ড ট্রেনিং কোর্স শেষ করে ১৯৭০ সালে একজন মেজর হিসেবে দেশে ফিরে আসেন এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চট্রগ্রামে নব গঠিত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন কমান্ড পদের দায়িত্ব লাভ করেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে ১৯৭১ সালের এক ভয়াবহ যুদ্ধ স্মরণীয়। এখানেও সেই বীর যোদ্ধার বীরত্বের পরিচয় পেয়েছে বাঙালি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা ঢাকার বুকে ভারী অস্ত্র নিয়ে আক্রমন করে নির্বিচারে গুলি চালায় ও মানুষ মারে, তখন জিয়াউর রহমান দেশ ও বাঙালির টানে চট্টগ্রামে থাকাকালীন তাঁর সিনিয়র অফিসার পাকিস্তানি অধিনায়ককে বন্দী করেন এবং বিদ্রোহ করেন। তৎকালীন সময়ে শক্তিশালী পাকিস্তানি মিলিটারির বিরুদ্ধে এমন দুঃসাহসিক অভিযান কেবল দেশমাতৃকার জন্যে এবং দেশের মানুষের মুক্তির জন্যে সম্ভব। জিয়াউর রহমান সেই সাহসী কাজটি করেছিলেন। এখানে বলে রাখা ভালো শেখ মুজিবুর রহমান যখন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী তখনও নেতাহীন বাঙালি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পুরোপুরি প্রস্তুতি নিতে পারেনি। অনেকটা দিশাহারা বাঙালি জাতি তাদের নেতা বিহীন। ঠিক সেসময়ে তখন প্রথমে ২৬ তারিখ ও পরে ২৭ মার্চ তারিখে চট্রগ্রামের কালুরঘাটের বেতার কেন্দ্র থেকে একজন বাঙালি আর্মি অফিসারের সাহসী কন্ঠের ঘোষণা শুনতে পেয়ে মানুষ দারুন সাহসী হয়ে উঠে। মেজর জিয়াউর রহমানের কন্ঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা তখন বারবার প্রচার করা হয়।
সে যা-ই হোক, শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ। প্রায় ত্রিশ লক্ষ বাঙালি প্রাণের বিনিময়ে ও প্রায় দুই লক্ষ বাঙালি নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়াউর রহমান ছিলেন অন্যতম সেক্টর কমান্ডার এবং তিনি ছিলেন জেড ফোর্সের অধিনায়ক। জিয়াউর রহমান সময়ের সাহসী সন্তান। যখনই দুর্যোগের ঘনঘটা তখনই জিয়াউর রহমান উপস্থিত হয়েছেন বুদ্ধি ও সাহসে। স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর বীরত্বের জন্যে পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত করে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তখন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দিকে নানান অস্থিরতা দেশজুড়ে। 'এখানে রাজনৈতিক টানাটানির নানান ঘটনা ঘটে যায়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। ১৯৭২ এর সংবিধানের ভিত্তিতে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার হলো। কিন্তু ১৯৭৩ এর মার্চেই সংবিধান সংশোধন হলো। ১৯৭৫ এর ২৫ জানুয়ারী দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথ বন্ধ হয়ে গেল এবং ঐ বছরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হলো। এরপর একের পর এক পরিবর্তন। তৎকালীন ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লব আবারো জিয়াউর রহমানকে সামনে নিয়ে আসে। সেনাবাহিনীর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় জিয়াউর রহমান এক সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব পান। তখন দেশে এক এলোমেলো পরিস্থিতি। এমন দুঃসময়েও এগিয়ে এলেন জিয়াউর রহমান।
মাঝে রাজনীতি ও সেনাবাহিনীতে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনার পর ১৯৭৮ সালের ৩ জুন দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তখন জনগণের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। সেই থেকে তিনি এদেশের সাধারণ মানুষের কাছে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। এরপর ১৯৭৯ সালে দেশে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ গঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চার পাশাপাশি নানামুখী উন্নয়ন কার্যক্রম চলছিলো গ্রাম থেকে শহরে। সবুজ বিপ্লবে ছেয়ে গিয়েছিল দেশ। উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল বহুগুণে। বিদেশেও যোগাযোগ বাড়িয়ে সুনাম অর্জন করে এগিয়ে যাচ্ছিলো বাংলাদেশ।
এত আত্মত্যাগের পরও 'কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্রগ্রামে কিছু সংখ্যক দুষ্কৃতিকারী জিয়াউর রহমানকে হত্যা করে। সারা পৃথিবী জানলো এক বীরের মৃত্যু সংবাদ। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের জনতার জিয়া ১৯ জানুয়ারি ১৯৩৬ সাল থেকে ৩০ মে ১৯৮১ সালের আয়ুষ্কাল নিয়ে ইহকালে অর্জন করেছেন সুনাম সুখ্যাতি এবং মরেও বেঁচে আছেন মানুষের অন্তরে। আর এভাবেই তিনি যুগ যুগ ধরে মানুষের হৃদয়ের মনিকোঠায় বেচেঁ থাকবেন অমর হয়ে।
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরে তাঁর পরিবার ও তাঁর গড়া রাজনৈতিক দল বিএনপি তাৎক্ষণিক একটি বড় ধাক্কা খেল। দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান তখন ছোটো ছিলো। কিন্তু জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর সাথে সাথেই বেগম খালেদা জিয়াও রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েননি। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটিয়ে ১৯৯১ সালে ১৪০টি আসন জিতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে সংসদীয় সরকার গঠন করে বিএনপি। আর তখন বেগম খালেদা জিয়া হন বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। এরপর আবারও ২০০১ খ্রীষ্টিয় সালের ১ অক্টোবরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ৩০০টি আসনের ১৯৩টি আসনে জয়ী হয় এবং বেগম খালেদা জিয়া আবার দায়িত্ব নিয়ে ক্ষমতাসীন হন। এরপর দীর্ঘ ১৭ বছর যাবৎ বিএনপি অনেক ত্যাগ স্বীকার করে যাচ্ছে। বিএনপি দীর্ঘ বহু বছর জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করে আসছে।
বর্তমান অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের সময়ও বিএনপি চায় দেশে দ্রুত জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সংসদ ও সরকার। বর্তমান সময়ে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি বাংলাদেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহান শিক্ষা ও তাৎপর্যকে লালন করে নিজস্ব সংস্কৃতি ও গৌরব নিয়ে এই জাতিসত্তাকে সামনের দিকে এগিয়ে চলার প্রশস্ত নতুন মহাসড়ক গড়ে দিয়ে গেছেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। এখন এই পথ অনুসরণ করে তাঁরই সুযোগ্য উত্তরসূরী তারেক রহমান পিতার লালিত স্বপ্নকে বাস্তবায়নে আবারো দেশ বিনির্মাণে মনোনিবেশ করবেন এটাই এখন আপামর জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা।
-লেখক: , গবেষণা সম্পাদক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও কৃষিবিদ নেতা