ফলফলাদি এবং সবজির উৎপাদন এবং রপ্তানির সম্ভাবনা

সমীরণ বিশ্বাস: বাংলাদেশের কৃষিখাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হলো হর্টিকালচার (Horticulture), যা ফল, সবজি, ফুল, মসলা ও ওষধি গাছের চাষ অন্তর্ভুক্ত করে। উর্বর মাটি, অনুকূল জলবায়ু এবং ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে বাংলাদেশে হর্টিকালচার ফসলের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ফলের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় রপ্তানির সম্ভাবনাও উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি মেট্রিক টনের বেশি ফল উৎপাদিত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১০০-১৫০ কোটি টাকার ফল ও সবজি রপ্তানি করা হয়। আম, কাঁঠাল, লিচু, মাল্টা, সবজি, ফুল এবং মসলা বিশ্ববাজারে রফতানি করা সম্ভব। নিম্নলিখিত বাংলাদেশে প্রচুর হর্টিকালচার ফসল উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো—

ফলফলাদি:

আম: চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর, সাপাহার এবং দিনাজপুরে ব্যাপকভাবে উৎপাদিত হয়। উৎপাদন: বছরে প্রায় ২৫-৩০ লাখ মেট্রিক টন। রপ্তানি: ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়।

কাঁঠাল: জাতীয় ফল হিসেবে পরিচিত এবং প্রায় সব জেলাতেই পাওয়া যায়। : অঞ্চল: নরসিংদী, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম। উৎপাদন: বছরে ১৫-১৮ লাখ মেট্রিক টন। ব্যবহার: স্থানীয়ভাবে খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি, প্যাকেটজাত কাঁঠালের চাহিদা বাড়ছে।

কলা: নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, বগুড়া ও কুমিল্লায় ব্যাপকভাবে চাষ হয়। অঞ্চল: নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, বগুড়া, ময়মনসিংহ, যশোর। উৎপাদন: বছরে ১২-১৫ লাখ মেট্রিক টন। রপ্তানি: সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।

লিচু: দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা, মেহেরপুর ও কুষ্টিয়াতে প্রধানত চাষ হয়। উৎপাদন: বছরে ১.৫-২ লাখ মেট্রিক টন। রপ্তানি: কম পরিমাণে রপ্তানি হয়, তবে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে এর চাহিদা বাড়ছে।

কমলা ও মাল্টা: পার্বত্য চট্টগ্রাম, মৌলভীবাজার, সিলেটে ও চুয়াডাঙ্গা বেশি উৎপাদিত হয়। অঞ্চল: দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা, মেহেরপুর। উৎপাদন: বছরে ১.৫-২ লাখ মেট্রিক টন। রপ্তানি: কম পরিমাণে রপ্তানি হয়, তবে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে এর চাহিদা বাড়ছে।

পেঁপে, আনারস ও মাল্টা: অঞ্চল: পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ। উৎপাদন: পেঁপে ও আনারসের উৎপাদন ১০-১২ লাখ মেট্রিক টন এবং মাল্টার উৎপাদন ১-২ লাখ মেট্রিক টন। রপ্তানি: রপ্তানির পরিমাণ কম হলেও ভবিষ্যতে সম্ভাবনা রয়েছে।

প্রধান রপ্তানি বাজার: মধ্যপ্রাচ্য: সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, কুয়েত। ইউরোপ: যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি। এশিয়া: ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর।

রপ্তানিযোগ্য ফল: আম: ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে সর্বাধিক রপ্তানি হয়। কলা: সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও সৌদি আরবে জনপ্রিয়। লিচু ও কাঁঠাল: রপ্তানির পরিমাণ কম, তবে চাহিদা আছে। ড্রাগন ফল ও স্ট্রবেরি: সম্ভাবনাময় রপ্তানি পণ্য।

ফল রপ্তানির সম্ভাবনা:

বাংলাদেশের ফল এবং সবজি রপ্তানি বাজার দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। ভবিষ্যতে এই খাতকে আরও এগিয়ে নেওয়ার কিছু সম্ভাবনা ও উদ্যোগ: গুণগত মান উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা । গ্লোবাল গ্যাপ (Global GAP) এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানদণ্ড মেনে উৎপাদন বাড়ানো গেলে রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে। জৈব ও নিরাপদ ফল উৎপাদনের দিকে নজর দিলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সহজ হবে।

 প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণ প্রযুক্তির উন্নয়ন: হিমায়িত ও প্রক্রিয়াজাত ফলের চাহিদা বাড়ছে (যেমন: ম্যাংগো পাল্প, ড্রাই ফ্রুটস, জুস)।

চ্যালেঞ্জ ও সমাধান: সঠিক সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণের অভাব, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গুদাম ও হিমাগার স্থাপন প্রয়োজন। উন্নত চাষাবাদ প্রযুক্তির অভাব, কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। উন্নত কোল্ড স্টোরেজ ও প্যাকেজিং সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে। নতুন বাজার খোঁজা ও রপ্তানি নীতি সহজ করাইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার দেশগুলোতে বাংলাদেশি ফলের চাহিদা বাড়ছে। সরকারিভাবে রপ্তানি সহায়তা ও লজিস্টিকস সুবিধা বাড়ালে রপ্তানি সহজ হবে। রপ্তানিকারকদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা। রপ্তানিতে ভর্তুকি ও ব্যাংক ঋণ সুবিধা দিলে কৃষকরা বেশি উৎসাহী হবে। সরকার ও বেসরকারি খাত মিলে রপ্তানিযোগ্য ফলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে কাজ করছে।

সবজি: বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১.৭ কোটি মেট্রিক টন সবজি উৎপাদন হয়। বেগুন, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, শিম, মিষ্টি কুমড়া, লাউ, করলা, শসা, ঢেঁড়স ইত্যাদি প্রধান সবজি। উন্নত জাত ও চাষপদ্ধতি ব্যবহারের ফলে সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। বাংলাদেশ থেকে সবজি রপ্তানির পরিমাণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সবজি রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৮২ মিলিয়ন ডলার, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কমে মাত্র ৭৫ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। অন্যদিকে, ফল ও সবজি মিলিয়ে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল ২৩৯.১৯ মিলিয়ন ডলার, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে কমে ৭৪.৯৩ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এই হ্রাসের পেছনে উচ্চ রপ্তানি ব্যয়, গুড এগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস (GAP) অনুসরণের অভাব এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবসহ বিভিন্ন কারণ ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া, বিমান পরিবহন খরচ বৃদ্ধি এবং প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়াও রপ্তানি হ্রাসের অন্যতম কারণ।  এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের কৃষি রপ্তানি খাতের জন্য উদ্বেগজনক এবং এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন।

মসলা ফসল: রসুন, পেঁয়াজ, আদা, হলুদ, ধনিয়া, জিরা, মরিচ ইত্যাদি মসলা ফসলের চাষ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে পেঁয়াজ ও রসুনের চাহিদা বাড়ায় এগুলোর উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

ফুল চাষ: গোলাপ, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, গাঁদা ও জারবেরা প্রধানত উৎপাদিত হয়। যশোরের গদখালীকে বাংলাদেশের "ফুলের রাজধানী" বলা হয়।

ওষধি গাছ: তুলসী, অশ্বগন্ধা, কালোজিরা, নিম, মেহেদী, ঘৃতকুমারী, বাসক ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ওষধি গাছ হিসেবে চাষ হয়।

নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার: টিস্যু কালচার, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, গ্রিনহাউজ, কৃষিতে AI প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ফলন বাড়ানো সম্ভব। হাইব্রিড ও জিএমও জাতের ফসলের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ছে।

নতুন জাতের উন্নয়ন: বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI) ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করছে। দেশীয় ও বিদেশি বাজারে প্রতিযোগিতার জন্য উন্নত মানের জাত উৎপাদন করা হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা: খরা, বন্যা ও লবণাক্ততা সহনশীল জাতের উন্নয়ন করা হচ্ছে। উচু জমিতে ফল ও সবজি চাষ করে  এবং ফসল ইনসুরেন্স ব্যবস্থাপনা করে ক্ষতির পরিমাণ কমানো হচ্ছে। ।

ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের বিকাশ: প্যাকেজিং, সংরক্ষণ, ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। ম্যাঙ্গো জুস, ফ্রোজেন সবজি, ড্রাই ফ্রুট ইত্যাদির চাহিদা বাড়ছে।

শহুরে কৃষি ও ছাদ বাগান: শহরে হাইড্রোপনিক্স, অ্যারোপনিক্স এবং ছাদ বাগান চাষ বাড়ছে। এতে পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে এবং ফরমালিনমুক্ত ফল-সবজি পাওয়া যাচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ: জলবায়ু সহনশীল জাতের উন্নয়ন ও বিকল্প কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। দুর্যোগ মোকাবেলায় ফসল ইনসুরেন্স ব্যবস্থাপনা করা।

বাংলাদেশে হর্টিকালচার খাতের সম্ভাবনা ব্যাপক। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ, আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ, এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে এই খাতকে আরও সমৃদ্ধ করা সম্ভব। সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ শুধু দেশীয় চাহিদা মেটানোই নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রতিযোগিতা করতে পারবে। বাংলাদেশে ফল উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে এবং রপ্তানির সম্ভাবনাও ব্যাপক। আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ, মানসম্মত সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ, এবং আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে এই খাতকে আরও লাভজনক করা সম্ভব। সরকারের সঠিক নীতি ও কৃষকদের উদ্ভাবনী প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে বৈশ্বিক ফল রপ্তানির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হতে পারে।

লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।