কৃষিবিদ ডক্টর এস. এম. রাজিউর রহমান:বিশ্ব দুগ্ধ দিবস, যা ২০০১ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়, প্রতিবছর ১লা জুন জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহে পালিত হয়ে থাকে, যাতে দুধকে একটি বৈশ্বিক খাদ্য হিসেবে গুরুত্ব প্রদান করা যায়। ২০২৫ সালে “দুগ্ধের শক্তিকে উদযাপন করি” (Let’s Celebrate the Power of Dairy) প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে পুষ্টি, অর্থনীতি ও পরিবেশে দুগ্ধ খাতের অবদানকে নতুন করে মূল্যায়ন করার আহ্বান জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই দিনটির তাৎপর্য আরও গভীর, কারণ জাতীয় পুষ্টি, গ্রামীণ জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দুগ্ধ শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। জনগণের মধ্যে নিরাপদ, পুষ্টিকর ও সহজলভ্য দুগ্ধপান সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি ও উৎসাহ প্রদান করতে এই দিবসটি একটি কার্যকর প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহৃত হতে হয়।
দুধকে একটি পরিপূর্ণ খাদ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে পানি, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিন (A, D, B12), নিয়াসিন, কোলেস্টেরল, রিবোফ্লাভিন এবং উপকারী চর্বি যেমন ওমেগা-৩ ও কনজুগেটেড লিনোলেইক অ্যাসিড (CLA) বিদ্যমান, যা মস্তিষ্কের বিকাশ, পেশি গঠন ও হৃদ্রোগ প্রতিরোধে সহায়ক। দেশে দুধ গ্রহণের প্রতিদিনের চাহিদা পূরণে ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। যেখানে মাথাপিছু সুপারিশকৃত দুধ গ্রহণের পরিমাণ ২৫০ মিলিলিটার, সেখানে গড় গ্রহণ মাত্র ২৩০-২৩৫ মিলিলিটার বলে সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, যা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য আরও উদ্বেগজনক। সেই কারণে, বিশ্ব দুগ্ধ দিবস জাতীয়ভাবে পালন করা এই পুষ্টিগত ঘাটতি পূরণের আহ্বান জানানো হয়।
বাংলাদেশে দুধের বৈজ্ঞানিক এবং আধ্যাত্মিক তাৎপর্য বিদ্যমান। ইসলামী ধর্মগ্রন্থে দুধকে একটি পবিত্র ও উপকারী পানীয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কুরআনুলকারিমে সূরা নাহল আয়াত ৬৬-এ আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন ‘আর গবাদিপশুর মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে শিক্ষা। তার উদরস্থিত গোবর ও রক্তের মধ্য থেকে পান করাই বিশুদ্ধ দুধ, যা পানকারীদের জন্য সুস্বাদু।’ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) দুধকে খাদ্য ও পানীয় উভয় হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আধুনিক বিজ্ঞানেও দুধের উপাদান ল্যাকটোফেরিন সম্পর্কে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, পাস্তুরিত দুধে এই উপাদানটি UHT দুধের চেয়ে বেশি পরিমাণে থাকে এবং এটি ভাইরাস ও জীবাণু প্রতিরোধে সহায়ক । কোভিড-১৯-এর মতো ভাইরাস প্রতিরোধেও ল্যাকটোফেরিন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যা জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে নিরাপদ দুধ গ্রহণের গুরুত্বকে তুলে ধরে।
এছাড়াও, বাংলাদেশে বিশ্ব দুগ্ধ দিবস উদযাপনের মাধ্যমে স্থানীয় দুগ্ধ খামারিদের উন্নয়ন, দুধের গুণগত মান রক্ষা ও টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নয়নকে উৎসাহিত করে। বাংলাদেশের দুগ্ধ খাত গ্রামীণ অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে, বিশেষ করে ক্ষুদ্র খামারিরা গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। তবে, এই খাত এখনও নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন—যেমন অপর্যাপ্ত শীতলীকরণ ব্যবস্থা, দুর্বল খাদ্য ব্যবস্থা, সীমিত চিকিৎসা সেবা এবং অস্বাস্থ্যসম্মত দুধ দোহন পদ্ধতি। এ অবস্থায়, সরকারি নীতিনির্ধারক, এনজিও, বেসরকারি খাত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে দুধের গুণগত মান নিশ্চিতকরণ, উৎপাদকদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং নিরাপদ দুধ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা আবশ্যক ।
২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য “দুধের শক্তি উদযাপন করি”–এই আলোকিত বার্তার মাধ্যমে দুধকে শুধু একটি পুষ্টিকর খাদ্য নয়, বরং অর্থনৈতিক টেকসইতা ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এই দিনে আয়োজন করা প্রচারাভিযান, মেলা ও গণমাধ্যমে আলোচনার মাধ্যমে নিরাপদ দুধ ব্যবস্থাপনা, দুগ্ধ খাতে নারীদের ভূমিকা, বিদ্যালয়ে দুধ সরবরাহ কর্মসূচি এবং অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগের গুরুত্ব তুলে ধরা উচিত। বিশেষ করে মা ও শিশুর জন্য পাস্তুরিত দুধের গ্রহণ বাড়ানোর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্য উন্নত করা সম্ভব হবে এবং দেশব্যাপী একটি সুস্থ ও উৎপাদনশীল জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা সহজ হবে।
“দুধের শক্তি উদযাপন করি” প্রতিপাদ্যটি বিশ্ব দুগ্ধ দিবস ২০২৫-এ পুষ্টি, অর্থনীতি ও পরিবেশের প্রতি দুগ্ধ খাতের বহুমাত্রিক অবদানকে ঘিরে একটি নবায়নকৃত বৈশ্বিক অঙ্গীকারকে প্রতিফলিত করে। এই প্রতিপাদ্য যেমন মানুষের পুষ্টি নিশ্চিতে দুধের ভূমিকা তুলে ধরে, তেমনি এটি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় টেকসই উদ্যোগেরও প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ, যেখানে কার্বন ফাইন্যান্স কর্মসূচির আওতায় উন্নত জাতের গবাদিপশু পালন, বায়োগ্যাস উৎপাদন, উন্নত খাদ্য ব্যবস্থাপনা এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার গৃহীত হলে গবাদিপ্রাণির মিথেন গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস সম্ভব। এসব পরিবেশবান্ধব কার্যক্রম দেশের কার্বন নির্গমন হ্রাসের পাশাপাশি স্থানীয় ও বৈশ্বিক কার্বন বাজারে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করে খামারিদের জন্য আয় বৃদ্ধির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। উন্নত দেশগুলোর মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও এখন নিঃসরণহীন ও টেকসই দুগ্ধ উৎপাদন ব্যবস্থাপনার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে, যা “নেট জিরো” লক্ষ্য অর্জনের পথ সুগম করছে। অতএব, দুধ কেবল পুষ্টির উৎস নয়, বরং পরিবেশবান্ধব উৎপাদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক লড়াইয়ে একটি কার্যকর চালিকাশক্তি হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে। এই সমন্বিত উদ্যোগই দেশের দুগ্ধ খাতকে টেকসই অর্থনীতি এবং জলবায়ুবান্ধব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
তাই ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের সেই হৃদয়স্পর্শী উচ্চারণ—“আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”—এই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে একাত্ম হয়ে আমরা এমন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, যেখানে প্রতিটি শিশুর জন্য পর্যাপ্ত দুধ, খাদ্যের নিশ্চয়তা ও বাসযোগ্য সুন্দর পৃথিবী থাকবে। বিশ্ব দুগ্ধ দিবস ২০২৫-এ আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব নবায়ন করা উচিত, যাতে খাদ্য নিরাপত্তা, শিশুপুষ্টি এবং গ্রামীণ সমৃদ্ধির পথে জাতিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। দুগ্ধ খাতকে উন্নীত করার মধ্য দিয়ে একটি সুস্থ, বুদ্ধিদীপ্ত ও আত্মনির্ভর বাংলাদেশ গড়ে তোলার পথ আরও প্রশস্ত করা যেতে পারে।
লেখক: পিএইচ.ডি.(দুগ্ধবিজ্ঞান), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ
জাতীয় পরামর্শক, বিশ্বব্যাংক গ্রুপ-ইকো সিকিউরিটিজ/এসএসআইএল
মিথেন নির্গমন হ্রাস এবং জলবায়ু অর্থায়ন প্রকল্প