রোটারিয়ান ড. মো. হেমায়েতুল ইসলাম আরিফ: ১৪ জুন, বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। এই দিনটি বিশ্বজুড়ে রক্তদাতাদের নিঃস্বার্থ অবদানকে শ্রদ্ধা ও ধন্যবাদ জানানোর দিন। ২০০৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সমাবেশ এই দিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে, আর সেই থেকে প্রতি বছর সারা বিশ্বে নিষ্ঠাবান রক্তদাতাদের সম্মানিত করা হয়। রক্তদাতারা হলেন সমাজের নিরব নায়ক, যাদের একটিমাত্র দান অসংখ্য মানুষের জীবনে ফিরিয়ে আনে আশার আলো, দেয় দ্বিতীয়বার বাঁচার সুযোগ। সারা দেশের অসংখ্য রোগী ও তাদের পরিবারের জন্য এঁদেরই দান হয়ে ওঠে জীবনের স্পন্দন।
"রক্ত দিন, আশা দিন: একসাথে আমরা জীবন বাঁচাই" – এ বছরের এই প্রতিপাদ্যটি গভীরভাবে সত্য। এটি শুধু একটি স্লোগান নয়, বরং আমাদের সামাজিক দায়িত্বের এক মর্মস্পর্শী প্রকাশ। আশা একটি অমূল্য উপহার, যা আমরা সহজেই অন্যদের সাথে ভাগ করে নিতে পারি রক্তদানের মাধ্যমে। প্রতিটি ইউনিট রক্তই একজন মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর জন্য হয়ে ওঠে জীবনের সোপান।
রক্তদাতা কেন নায়ক?
জীবনদান: রক্তদান সরাসরি জীবন রক্ষা করে। অস্ত্রোপচার (হাঁটু প্রতিস্থাপন থেকে জটিল অপারেশন), দুর্ঘটনাজনিত রক্তক্ষরণ, ক্যান্সার চিকিৎসা (কেমোথেরাপি), প্রসবকালীন জটিলতা, থ্যালাসেমিয়া, রক্তশূন্যতা সহ নানাবিধ চিকিৎসায় রক্ত সঞ্চালনের বিকল্প নেই। একটি মাত্র সম্পূর্ণ রক্তদান (প্রায় ৪৫০ মিলিলিটার বা ১ ইউনিট) তিনটি আলাদা জীবন বাঁচাতে পারে – লোহিত রক্তকণিকা, প্লাজমা ও প্লেটলেট হিসেবে আলাদাভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে।
নিঃস্বার্থতা: রক্তদান হল মানবতার সর্বোচ্চ প্রকাশ। এর জন্য দাতা পায় না কোনও আর্থিক লাভ, কেবল পায় মানসিক তৃপ্তি ও সম্মান। এটি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়, মানবিক দায়িত্ববোধ থেকে করা এক অনন্য সেবা।
অসাধারণ এক রেকর্ড: জেমস হ্যারিসনের গল্প
রক্তদানের ইতিহাসে জেমস ক্রিস্টোফার হ্যারিসন ("দ্য ম্যান উইথ দ্য গোল্ডেন আর্ম") এক কিংবদন্তি। এই অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক তার অনন্য অ্যান্টিবডি সমৃদ্ধ রক্ত দিয়ে ৮১ বছর বয়সে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত (১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫) মোট ১,১৭৩ বার রক্তদান করে অসংখ্য নবজাতকের জীবন রক্ষা করেছিলেন। তার মতো লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষই প্রতিদিন নায়কে পরিণত হচ্ছেন রক্তদানের টেবিলে।
রক্তদান প্রক্রিয়া ও সচেতনতা:
সময় ও পুনরুৎপাদন: লোহিত রক্তকণিকা পূর্ণ পুনরুৎপাদনে প্রায় ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ সময় লাগে। এজন্যই পরবর্তী সম্পূর্ণ রক্তদানের মধ্যে কমপক্ষে ৫৬ দিন (৮ সপ্তাহ) বিরতি রাখা বাধ্যতামূলক, যাতে দাতার শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে পারে।
যোগ্যতা:বয়স: সাধারণত ১৭ বছর বা তার বেশি (কিছু স্থানে পিতামাতার সম্মতিতে ১৬ বছর)।
স্বাস্থ্য: ভালো স্বাস্থ্যবান, নির্দিষ্ট ওজনের উপরে (সাধারণত ৪৫-৫০ কেজি+) হতে হয়।
যারা দান করতে পারবেন না: হেপাটাইটিস বি/সি, এইচআইভি, ম্যালেরিয়া, সিফিলিস, গনোরিয়া, ক্রুটজফেল্ড-জ্যাকব রোগ, ইবোলা, জিকার সংক্রমণ বা ঝুঁকির ইতিহাস; সক্রিয় যক্ষ্মা; সাম্প্রতিক রক্ত সঞ্চালন (৩ মাস); গর্ভাবস্থা ইত্যাদি। (নির্দিষ্ট মানদণ্ড স্থানীয় রক্ত কেন্দ্রে জেনে নিন)।
বিরল রক্তের গ্রুপ: AB নেগেটিভ হল সবচেয়ে বিরল প্রধান রক্তের গ্রুপ (মাত্র ~১% দাতা)। তবে অন্যান্য আরও বিরল গ্রুপও আছে যেগুলোর চাহিদা বেশি। আপনার গ্রুপ জানা এবং নিয়মিত দান করা গুরুত্বপূর্ণ।
পরিবারের দান সতর্কতা: খুব কাছের জৈবিক আত্মীয়ের (বাবা-মা, ভাই-বোন, সন্তান) রক্ত দান কখনো কখনো বিরল জটিলতা (TA-GVHD) তৈরি করতে পারে। রক্ত কেন্দ্রগুলো সাধারণত এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করে।
তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা:
প্রথমবার রক্তদাতাদের একটি বড় অংশই ১৮-২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণী। তাদের এই সচেতনতা ও মানবিকতাই ভবিষ্যতে নিরবচ্ছিন্ন রক্ত সরবরাহের চাবিকাঠি। বারবার দাতাদের মধ্যে ৩৫-৫৪ বছর বয়সীরাও সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ও Cerus-এর ভূমিকা:
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বে বছরে ১১৮.৫ মিলিয়নেরও বেশি রক্তদান সংগ্রহ হয়, যার প্রায় ৪০% সংগ্রহ হয় বিশ্বের মাত্র ১৬% সম্পন্ন জনগোষ্ঠীর দেশগুলোতে। Cerus এর মতো প্রতিষ্ঠান রক্তের নিরাপত্তা বৃদ্ধি (প্যাথোজেন রিডাকশন টেকনোলজির মাধ্যমে) এবং রক্তদানের যোগ্যতার সীমা প্রসারিত করে আরও বেশি মানুষকে দান করতে ও আরও বেশি রোগীকে প্রয়োজনীয় রক্ত পেতে সহায়তা করছে। Cerus এর প্রেসিডেন্ট ও সিইও ওবি গ্রিনম্যানের ভাষ্যে, "নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য রক্ত সরবরাহ বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভিত্তি... বিশ্ব রক্তদাতা দিবস এই নিঃস্বার্থ দাতাদের ধন্যবাদ জানানোর এবং রক্তদানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির সুযোগ।"
উপসংহার:
বিশ্ব রক্তদাতা দিবস কেবল একটি দিবস নয়, এটি একটি বার্তা, একটি অঙ্গীকার। রক্তদান শুধু একটি চিকিৎসা পদ্ধতি নয়, এটি এক মহৎ মানবিক কর্ম, আশা ও প্রাণের বিনিময়। জেমস হ্যারিসন থেকে শুরু করে আমাদের পাশের বাড়ির সেই স্বেচ্ছাসেবী প্রতিটি রক্তদাতাই একজন জীবন্ত নায়ক। এবারের প্রতিপাদ্য আমাদের আহ্বান জানায়: আসুন, আমরা সবাই মিলে রক্ত দিই, আশা দিই। কারণ, একসাথে আমরা জীবন বাঁচাতে পারি। আপনার একটুখানি সময় আর এক ইউনিট রক্তই হতে পারে কারও জন্য বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল। রক্তদান করুন, নায়ক হোন।