ফল-ফসলের “জাত” নামকরণে বিদেশি আধিক্য কেন ?

সমীরণ বিশ্বাস: ফল-ফসলের জাত নামকরণে বিদেশি শব্দ বা সংস্কৃতির আধিক্য মূলত বৈজ্ঞানিক, বাণিজ্যিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর কারণে গড়ে উঠেছে। তবে, এতে স্থানীয় কৃষি সংস্কৃতি, ভাষা ও পরিচয়ের জায়গায় এক ধরণের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। কৃষি দেশি, নাম কেন বিদেশি ? ভবিষ্যতে স্থানীয় নাম, ভাষা ও ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দিয়ে ফল-ফসলের জাতের নামকরণ হলে কৃষকের কাছে জাতের গ্রহণযোগ্যতা যেমন বাড়বে, তেমনি তা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির পরিচায়ক হবে। কৃষি জাত বা ভ্যারাইটি (Variety) এর নামকরণ এবং এর আইনি বৈধতা বিষয়টি বাংলাদেশের কৃষি আইন ও আন্তর্জাতিক বাছাইকৃত নিয়ম অনুসারে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে নতুন কোন কৃষি জাত উদ্ভাবনের পর সেটির নামকরণ এবং নিবন্ধনের দায়িত্ব সাধারণত নিচের সংস্থাগুলো পালন করে।

উদ্ভাবক/গবেষক প্রতিষ্ঠান: নতুন জাত বা ভ্যারাইটি উদ্ভাবন করলে তার নাম প্রস্তাব করে উদ্ভাবক/গবেষক বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান (যেমন: BARI, BRRI, BINA)। যেমন, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI) নতুন ধানের জাত উদ্ভাবন করলে “BRRI dhan-89” এর মতো নাম প্রস্তাব করে।

জাত নিবন্ধন কমিটি (Variety Release and Registration Committee): কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন এই কমিটি জাত যাচাই করে নাম অনুমোদন ও রেজিস্ট্রেশন দেয়। এটি জাতের বৈজ্ঞানিক বৈধতা, কৃষিতে উপযোগিতা, ও নতুনত্ব যাচাই করে চূড়ান্ত নাম অনুমোদন করে।

জাতের নামকরণ ও নিবন্ধনের আইনি বৈধতা : বাংলাদেশে কৃষির জাত নামকরণ ও নিবন্ধনের ক্ষেত্রে কয়েকটি আইনি কাঠামো কাজ করে: কৃষি বীজ আইন, ২০১৮ (Seed Act, 2018): এই আইনের আওতায় বীজ জাত নিবন্ধন, মাননিয়ন্ত্রণ, বাজারজাতকরণ এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হয়। এই আইনে বলা আছে, কোন জাত বাজারে বিক্রি বা বিতরণ করতে হলে জাত নিবন্ধন বাধ্যতামূলক।

প্লান্ট ভ্যারাইটি প্রটেকশন অ্যাক্ট (খসড়া পর্যায়ে): নতুন উদ্ভাবিত জাতের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির (IPR) সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এই আইন করার উদ্যোগ আছে। এটি কার্যকর হলে উদ্ভাবকের স্বত্বাধিকার নিশ্চিত হবে, এবং জাতের নাম ও বৈশিষ্ট্য কেউ অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করতে পারবে না।

UPOV কনভেনশন (Union for Protection of New Varieties of Plants): আন্তর্জাতিকভাবে জাত সুরক্ষায় এই কনভেনশন অনুসরণ করা হয়। বাংলাদেশ এখনও সদস্য নয়, তবে জাত সুরক্ষা আইন প্রণয়ন হচ্ছে।

জাতগুলোর নামকরণে বিদেশি শব্দ বা সংস্কৃতির আধিক্য:

কৃষিজাত (শস্য, ফসল, সবজি ইত্যাদি) জাতগুলোর নামকরণে বিদেশি শব্দ বা সংস্কৃতির আধিক্যের পেছনে কিছু বাস্তব কারণ ও প্রেক্ষাপট রয়েছে। নিচে তা বিশ্লেষণ করা হলো:

আন্তর্জাতিক গবেষণার প্রভাব: অনেক কৃষি জাত বিদেশি গবেষণা সংস্থা (যেমন IRRI, CIMMYT, ICRISAT) বা উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় উদ্ভাবিত হয়। এসব জাতের মূল বা মূলে ব্যবহৃত উপাদান, সংকর জাত বা প্রযুক্তি বিদেশি হওয়ায় নামেও সেই ছাপ পড়ে। যেমন: IR64, BRRI dhan29 যেখানে “IR” বা “BRRI” আন্তর্জাতিক বা জাতীয় গবেষণাগারের নাম।

বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত মান বজায় রাখা : বিদেশি শব্দ বা নাম ব্যবহার অনেক সময় বৈজ্ঞানিক শ্রেণিবিন্যাস বা উৎসের স্বীকৃতি হিসেবে রাখা হয়। এতে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী জাতের পরিচিতি নিশ্চিত হয় এবং গবেষণা বা রপ্তানিতে সুবিধা হয়।

উন্নত জাতের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো: বিদেশি নাম অনেক সময় বাজারে জাতটির “উন্নত” বা “উচ্চ ফলনশীল” ভাবমূর্তি তৈরি করে। কৃষকদের মধ্যে ধারণা থাকে, বিদেশি নাম মানেই উন্নত জাত। উদাহরণস্বরূপ: “Hybrid Tomato – Ratan F1”, “Lal Teer 4”

বাণিজ্যিক ও বহুজাতিক কোম্পানির প্রভাব: অনেক জাত বহুজাতিক বীজ কোম্পানির উদ্ভাবিত বা রপ্তানিকৃত। তারা নিজেদের গ্লোবাল ব্র্যান্ড ধরে রাখার জন্য নামকরণে ইংরেজি বা বিদেশি শব্দ ব্যবহার করে। যেমন: BARI Hybrid Tomato-9 (Arka Rakshak), “Super Sweet Corn”।

নামকরণে আইনগত ও নীতিগত সীমাবদ্ধতা: জাত নামকরণে এখনো অনেক সময় স্থানীয় ভাষার চেয়ে প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত রূপ (BRRI, BARI, BU, BAU ইত্যাদি) ও সংখ্যার উপর নির্ভর করা হয়। ফলে নাম হয় নিস্প্রাণ, অথবা বিদেশি নামের প্রতি নির্ভরতা বাড়ে।

স্থানীয় নামের অবমূল্যায়ন ও ভাষাগত প্রান্তিকতা: বাংলা ভাষা বা সংস্কৃতির শব্দকে কৃষি জাতের নামকরণে গুরুত্ব না দেওয়ার একটা মনোভাব বা অভ্যাস রয়েছে অনেক গবেষণা ও উদ্ভাবনী প্রতিষ্ঠানে। এতে স্থানীয় ভাষাভিত্তিক নামকরণ হয়ে ওঠে উপেক্ষিত।

বর্তমানে দেশে বিভিন্ন গাছের নার্সারি, দেশি-বিদেশি বীজ কোম্পানি এবং হর্টিকালচার সেন্টারগুলো কৃষির জাত ও চারা নামকরণে নিজের ইচ্ছামতো নাম ব্যবহার করছে, যা কোনো আইনি কাঠামোর আওতায় নয়। এর ফলে একদিকে যেমন কৃষকেরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে দেশীয় গবেষণা ও উন্নয়নকৃত সুনামধন্য জাতগুলো হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়ছে। অনেক সময় একই জাতের নামে একাধিক ভিন্ন নাম ব্যবহার করা হয়, যা জাতের বিশুদ্ধতা ও গুণগত মান রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়।

এই অনিয়ম রোধে প্রয়োজন একটি সুস্পষ্ট ও বাধ্যতামূলক কৃষির জাত নামকরণ নীতিমালা। ফল-ফসলের জাত নামকরণ এবং চারা বাজারজাতকরণে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সম্পৃক্ততা শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। নামকরণ ও অনুমোদনের জন্য একটি স্বচ্ছ এবং কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রিত কর্তৃপক্ষ থাকা জরুরি, যা জাতের বৈজ্ঞানিক তথ্য যাচাই করে অনুমোদন দেবে। কৃষির বিভিন্ন জাত এবং চারা ইত্যাদির নামকরণে একটি নীতিমালা এবং নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ; অচিরেই আমাদের দেশী ও সুনামধন্য জাত এবং চারাগুলি চিরতরে হারিয়ে যাবে। বাংলাদেশ কৃষি মন্ত্রণালয়ের সরাসরি তদারকি ও কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন ছাড়া এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। পরিবেশ ও কৃষিবিদগণ এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন।

লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।