চরের কৃষি ও কৃষকের জীবন

ড. এম মনির উদ্দিনঃ বাংলাদেশের নদ-নদী বেষ্টিত চর এলাকায় ৬.৫ মিলিয়নের বেশী মানুষ বাস করে যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশ এবং এই চরাঞ্চলের আয়তন দেশের মোট জমির প্রায় ৫ শতাংশ। বদ্বীপ অববাহিকা বরাবর জমে থাকা পলি থেকে চর বা নদী দ্বীপ তৈরী হয়। বাংলাদেশের প্রধান নদ-নদীর উপকুলীয় এলাকা ও মোহনায় শত শত চর রয়েছে।

পলি জমে এবং চর বড় হওয়ার সাথে সাথে প্রান্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠী উর্বর পলি মাটির টানে আকৃষ্ট হয়ে নুতনভাবে বাচাঁর আশায় এই চরগুলোতে বসতি স্থাপন করে কৃষিকাজ শুরু করে। এই সকল চরে বসবাসকারী মানুষ দেশের সবচেয়ে দরিদ্র এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারনে সবচেয়ে বেশী ঝুঁকিপুর্ন। এদের প্রধান আয়ের উৎস কৃষি কিন্তু চরগুলো নিয়মিত বন্যা, নদীভাঙ্গন এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিয়মিত ক্ষতিগ্রস্থ হয় যার কারনে তারা সবসময় দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে। চরগুলো মুল ভুখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এবং প্রয়োজনীয় সরকারী সুবিধা থেকে অনেকক্ষেত্রেই বঞ্চিত। নৌকার মাধ্যমেই তারা মুল ভুখন্ডের সাথে যুক্ত হতে পারে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশী দরিদ্রতম এবং এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় দরিদ্রতম একটি জেলা কুড়িগ্রাম। প্রধান নদী যমুনা, ব্রক্ষপুত্র, তিস্তা, ধরলা, জিঞ্জিরা, দুধকুমারসহ ১৬টি ছোট বড় নদী প্রবাহিত হয়েছে এই কুড়িগ্রাম জেলার মধ্য দিয়ে যা ৪০০টির ও বেশী চরকে সংযুক্ত করেছে। জেলাটির ৭০.৮ শতাংশ মানুষ দরিদ্র এবং ৫৩.২ শতাংশ অতি দরিদ্র। দেশের শিক্ষার দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে এই কুড়িগ্রাম জেলা এবং শিক্ষার হার ৪২.৫ শতাংশ। জেলার ২৪ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে ৫ লাখ মানুষ বাস করে এই চরগুলোতে। ঁজলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বর্ষাকালে সকল নদীর প্রবাহমান পানি দুকুল ছাপিয়ে আঘাত হানে এই সকল চরগুলোতে এবং অনেক সময় ভাসিয়ে নিয়ে যায় মানুষের ঘরবাড়ীসহ সহায় সম্পদ, গবাদিপশু ইত্যাদি। যার ফলে চরগুলো এখন হয়ে উঠেছে আগের চেয়ে অনেকটাই অনিরাপদ।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার অধীনে একটি বিচ্ছিন্ন চর যার নাম খেওয়ার আলগা চর। এই চরের তরুন, যুবক ছেলেমেয়েরা মিলে চরটির নাম দিয়েছে ইয়ুথ নেট চর যার ছোট একটি সাইনপ্লেট টাঙানো আছে। চরটির আশেপাশে রয়েছে আরো ৬/৭টি চর। যাত্রাপুর ঘাট থেকে নৌকায় চরটির ঘাটে পৌছতেই আরেকটি নৌকায় অপেক্ষামান কয়েকটি শিশুকে দেখে জানতে চাইলে শিশুগুলো জানালো যে, তারা পাশের চর থেকে এই চরের স্কুলে পড়তে এসেছিল এবং পড়াশেষে তারা তাদের নিজ চরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। উল্লেখ্য যে, আশেপাশের ৬/৭টি চর ঘিরে কোন প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালো, যেহেতু এই চরগুলোতে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই সেহেতু, তারা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার কথাও ভাবেনা। মেয়েরা একটু বড় হলেই বিয়ে দেয়া হয় আর ছেলেরা চরের কৃষিকে আগলেই জীবন চালায়। তবে, সম্প্রতি ফেন্ড্রশিপ নামক একটি এনজিও ইয়ুথ নেট চরে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় করে দিয়েছে যেখানে ৩০ জন ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করতে পারে। অন্য চর থেকেও কয়েকজন শিশু পড়তে আসে এই বিদ্যালয়টিতে। স্কুলের মাঠটি ফ্রেন্ডশিপ এনজিও বাড়ীগুলোর থেকে বেশী উচু করে দিয়েছে যাতে বর্ষায় ঘরবাড়ীতে পানি উঠলে চরের মানুষ এখানে আশ্রয় নিতে পারে।

চরগুলোতে কোন স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ব্যবস্থা নেই। চরবাসীর তথ্যমতে, চরের অনেক মানুষ বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলা সন্তান প্রসবের জটিলতায় পড়ে নৌকায় করে হাসপাতালে নেয়ার পথেই মারা যাওয়ার বেশ কয়েকটি নজির আছে। যে কোন অসুস্থতার জন্য তাদেরকে শহরের দিকে ছুটতে হয়। হঠাৎ করে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে সেক্ষেত্রে চিকিৎসার কোন সুযোগ নেই। এগুলোকে মেনে নিয়েই চরে বসতি গড়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা অতি দরিদ্র মানুষগুলো।

এই সমস্ত চরের খাস জমিগুলো কৃষক ইচ্ছে করলেই চাষবাস করতে পারেনা। প্রতি বিঘা জমি নির্দিষ্ট পরিমান টাকা দিয়ে লিজ নিতে হয় দখলসুত্রে হওয়া কোন প্রভাবশালী মালিকের কাছ থেকে। অথচ, সরকার এই জমিগুলোকে ভুমিহীন ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে বিতরনের ব্যবস্থা করে ঢাকা শহরের বস্তিতে আশ্রয় নেয়া অনেক বানভাসী মানুষকে পুর্নবাসন করে কৃষি উৎপাদনের আওতায় নিয়ে আসতে পারে যার মাধ্যমে বাড়তে পারে দেশের উৎপাদন এবং জীবনের নুতন ঠিকানায় আশ্রয় পেতে পারে অনেক মানুষ।

বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার ৫ নং কাজলা ইউনিয়নের নিশ্চিতপরল চরে দীর্ঘদিন ধরে বাস করা অভিজ্ঞ কৃষক জহুরুল বেপারী, আশরাফ আলী, ঝন্টু প্রামানিক এর সাথে কথা বলতে বলতে জানা গেলো চরকে ঘিরে তাদের সংগ্রামী জীবনের কথা। সরকার থেকে অনেক প্রনোদনার কর্মসুচী থাকলেও তার কোন কিছুই পৌছায় না এই চরে। তারা অধিকাংশ সময় স্থানীয় পর্যায়ের মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে মুলধন সংগ্রহ করে কৃষিতে বিনিয়োগ করে। ফসল তোলার সাথে সাথে সেই মহাজনেরাই বাজার মুল্যের চাইতে কমদামে ফসল কিনে নিয়ে যায় সেইসাথে কেটে নেয় সুদসহ দেয়া মুলধন। অর্থ্যাৎ, কৃষকের হাতে থাকেনা তেমন কোনই লাভ। এইভাবেই, এই চরের কৃষকেরা উর্বর পলিতে ঘাম ঝরা পরিশ্রম করে মরিচ, ভুট্টা, মিষ্টি কুমড়া, পাট, ধান, তিল ইত্যাদি অর্থকরী ফসল ফলায় ঠিকই কিন্তু মৌসুম শেষে কৃষকেরা হিসেব মিলাতে পারেনা। চরের দরিদ্র মানুষগুলো হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে দেশের মানুষের জন্য খাদ্য ফলায় আবার সেই মানুষগুলোর ঘরেই অনেক সময় খাবার থাকেনা।

ইয়ুথ নেট চরের বাসিন্দাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে বেরিয়ে আসলো বেশ কয়েকজনের কষ্টের গল্প। তাদের অনেকের ঘরবাড়ী ৪/৫ বার ভাঙতে হয়েছে নদী ভাঙনের কারনে। বর্ষাকালে প্রতিনিয়ত তাদের ভয়ে ও আতংকে থাকতে হয় কখন নদীর তীব্র ¯্রােত মুহুর্তের মধ্যে বিলীন করে দেয় পুরো চরটিকে। নিশ্চিতপরল চরের ঘরবাড়ীতে বর্ষার পানি উঠার দাগ দেখে জানা গেল যে, প্রতিবছরই এই চরের সকল ঘরবাড়ীতে পানি উঠে যায় এবং শুরু হয় তাদের মানবেতর জীবন। প্রতি পরিবারে রয়েছে দু চারটি করে গবাদিপশু এবং তাদের জন্য তৈরী করা হয় বাড়ীর উচ্চতা থেকে আরো উচু করে একটু ভিটা যেখানে বর্ষার সময় এই গবাদিপশুর ভিটার একপাশে থাকে গবাদিপশুগুলো আর অন্যপাশে থাকে পরিবারের সকলে মিলে। বর্ষার পানি নেমে না যাওয়া পর্যন্ত এভাবেই রাতদিন কাটাতে হয় এই চরবাসীর।

দেশের অবহেলিত কয়েক মিলিয়ন চরবাসীর উৎপাদিত কৃষি খাদ্যপণ্য চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। দেশের মানুষের খাদ্যের যোগানে নীরবে, নিভৃতে অবদান রেখে চলেছে এই চরের দরিদ্র মানুষগুলো অথচ এই মানুষগুলো জানেনা রাস্ট্রের কাছে তাদের অধিকার রয়েছে শিক্ষা, চিকিৎসা, অন্ন, বস্ত্রের, বাসস্থানের। যে চরবাসী দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় অবদান রাখে তারাই আবার নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে হারিয়ে ফেলে তাদের শেষ সহায় সম্বল ঘরবাড়ী ও চাষের জমি। তাদের নিজেদেরই আর খাবারের কোন নিরাপত্তা থাকেনা। তখন এই বানভাসী পবিারগুলোর পেটের ক্ষুধা মেটাতে শেষ পর্যন্ত আশ্রয় হয় ঢাকা শহরের কোন বস্তি।

হয়তো জেগে উঠে নুতন কোন চর যেখানে কোন প্রভাবশালী মহল লাল পতাকা তুলে জানান দেয় তার নুতন চরের রাজত্বের। আবার নুতন কোন পরিবার টাকা পয়সা দিয়ে লিজ নেয় কিছু জমি এবং আশায় বুক বেধেঁ শুরু করে সংগ্রামী জীবন। এভাবেই ভাঙ্গাগড়ার মধ্য দিয়েই এই দরিদ্র মানুষগুলো অবদান রেখে যায় দেশের জন্য যদিও শেষ পর্যন্ত তাদের জীবনের গন্তব্য থাকে অজানা। প্রতিবছর কয়েক লাখ মানুষ দেশের চরগুলোর ভাঙ্গনের শিকার হয়ে পরিনত হচ্ছে জলবায়ু উদ্ভাস্তুতে এবং এরা আশ্রয় নিচ্ছে বড় বড় শহরের বস্তিগুলোতে। যারা আজকে বিশ্বের জলবায়ুকে অস্থির করে তুলেছে তাদেরকে বাংলাদেশের এ সকল জলবায়ু উদ্ভাস্তুদের পুনর্বাসন করার দায়িত্ব নিতে হবে। উন্নত দেশগুলোর গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গমনে বাংলাদেশের বাতাস যদি উত্তপ্ত হতে পারে, যদি বঙ্গোপসাগরের পানির উচ্চতা বেড়ে মানুষ ঘরবাড়ী ছাড়া হতে পারে, জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে তাহলে সেই সকল ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের আশ্রয়ের অধিকার রয়েছে বিশ্বের যেখানে অনিরাপদ বাসস্থান রয়েছে। অবশ্যই বাংলাদেশের সকল জলবায়ু উদ্ভাস্তুদের ভাল আশ্রায়নের ব্যবস্থা করতে হবে সেই সকল দেশকে যারা বিশ্বের গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গমনে রেকর্ড তৈরী করছে।

অবহেলিত চরবাসীর তথা প্রান্তিক কৃষি পরিবারের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, উচ্চ ফলনশীল, নিরাপদ এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ ফসলের নুতন জাত সম্প্রসারনের মাধ্যমে তাদের ফসলের উৎপাদন বাড়ানো সেইসাথে উৎপাদিত ফসলের সঠিক মুল্য পাইয়ে দিতে গেইন বাংলাদেশ দুটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান; কৃষি স্বপ্ন এবং এগ্রিভেঞ্চার এর মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করেছে এই চরগুলোর মধ্যে দুটি চর যথাক্রমে খেওয়ার চর এবং নিশ্চিতপরল চরে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট এর উদ্ভাবিত বিশেষ কয়েকটি জলবায়ু বান্ধব তথা খরা বা উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল, পুষ্টিসমৃদ্ধ, স্বাস্থ্যকর এবং উচ্চমুল্যের ফসল যেমন বারি চিনা-২, বারি কাউন-২, বারি কাউন-৪, বারি বার্লি-৮, বারি বার্লি-৯, বারি সরগম-১, বারি কালোজিরা-১ ইত্যাদি এই চরগুলোতে সম্প্রসারনের জন্য গেইন তার দুটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করছে। ইতিমধ্যে, গেইন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট এর উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. রেশমা সুলতানাসহ কয়েকজন বিজ্ঞানীর সাথে যৌথভাবে কাজ করার জন্য একমত হয়েছেন এবং একটি সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া চলছে। বারি’র কারিগরী সহযোগীতা পেলে গেইন চরের কৃষকদের জন্য এই ফসলের উন্নত জাতগুলো সম্প্রসারনের মধ্য দিয়ে চরের কৃষকদের চলমান কৃষিকে বানিজ্যিক কৃষিতে রুপান্তরে সহযোগীতা করতে পারবে।

সবশেষে, যেটি বলা যায় যে, দেশের চরগুলোতে বসবাসকারী কৃষকদের যদি সরকার থেকে সামান্য সহযোগীতা দেয়া যায়, চরের উর্বর পলিতে চাষের জন্য সামান্য বীজ কৃষকের হাতে তুলে দেয়া যায়, তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের বাজারজাতকরনের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে এই চরবাসী কৃষকেরা দেশের বর্তমান কৃষি উৎপাদনের সাথে যুক্ত করতে পারে অতিরিক্ত কয়েক লক্ষ টন খাদ্যপণ্য এবং কৃষকের জীবনযাত্রার মানকে পরিবর্তন করা সম্ভব। আমরা যারা কৃষকের উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল এবং কৃষকের ঘামঝরা পরিশ্রমে উৎপাদিত কৃষিপণ্য খেয়ে জীবন চালাই সকলেই এদেশের অবহেলিত কৃষকের পাশে দাঁড়াই। থাকি কৃষির সাথে, কৃষকের পাশে।

লেখকঃএগ্রোনমিস্ট এ্যান্ড কনসালট্যান্ট, গেইন বাংলাদেশ