শহিদ বুদ্ধিজীবী, সিলেট মুক্ত এবং মহান বিজয় দিবস আমাদের জাতীয় জীবনে গভীর তাৎপর্যে সমুজ্জ্বল

প্রফেসর ড. মো: আলিমুল ইসলাম:শহিদ বুদ্ধিজীবী, সিলেট মুক্ত এবং মহান বিজয় দিবস-এই তিনটি ঐতিহাসিক ও গৌরবময় দিবস আমাদের জাতীয় জীবনে গভীর তাৎপর্যে সমুজ্জ্বল। ডিসেম্বরের প্রতিটি দিনই আমাদের মনে করিয়ে দেয় স্বাধীনতার জন্য বাঙালির অকুতভয় সংগ্রাম, অপরিসীম ত্যাগ, অদম্য মনোবল এবং জাতি গঠনের অমর প্রত্যয়। এই মহিমান্বিত মাসে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি সেই সব শহিদ বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধা, সংগ্রামী মানুষ ও গর্বিত সন্তানদের, আত্মত্যাগের ওপর দাঁড়িয়েই আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ।

মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পূর্ববাংলার মানুষ অর্জন করে স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশ। স্বাধীনতা হলো একটি জাতির আজন্ম লালিত স্বপ্ন। দাসত্বের শৃঙ্খলে কেউ বাঁধা পড়তে চায় না। বাঙালি জাতিও চায়নি বছরের পর বছর ধরে শাসনে-শোষণে পাকিস্তানিদের দাস হয়ে থাকতে। তাই তারা শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে পড়েছিল আন্দোলনে, সোচ্চার হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে। অবশেষে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পেয়েছে স্বপ্নের স্বাধীনতা। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনার মাধ্যমে গণহত্যা শুরু করে। যাতে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়।

১৪ ডিসেম্বর শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস আমাদের জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বেদনাবিধুর দিনগুলোর একটি। ১৯৭১ সালের শেষ প্রহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাঙালি জাতির প্রাজ্ঞ, মনন, মেধা, বিবেক ও নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, শিল্পী, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবীদেরকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। তাদের এই নৃশংসতা স্বাধীনতার পথরোধ করতে পারেনি; বরং এই নির্মম হত্যাযজ্ঞই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আমাদের বিজয়কে আরও দৃঢ় ও ত্বরান্বিত করে। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের ত্যাগ আমাদের আলোকিত করেছে জ্ঞান, সত্য ও স্বাধীন চিন্তার পথে; তাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত চেতনা আজ আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও উন্নয়নের ভিত্তি।

১৫ ডিসেম্বর সিলেট মুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এক বিশাল জনগোষ্ঠী শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছিল। সিলেটের মুক্তিকামী মানুষ, মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠক এবং দেশপ্রেমিক নাগরিকদের অবদান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সিলেটের মাটিতে পাকিস্তানি শত্রুবাহিনীর পতন মুক্তিযুদ্ধের এক বিরাট সাফল্যের প্রতীক, যা দেখিয়ে দেয় অন্যায়, অত্যাচার ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালি কখনোই মাথা নত করেনি। সিলেটের মুক্তি ছিল স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাবার এক গৌরবময় চিহ্ন, যা নতুন আত্মবিশ্বাসে উজ্জীবিত করেছিল সমগ্র জাতিকে।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ডাকে শুরু হওয়া স্বাধীনতাযুদ্ধে দেশের অদম্য বীর মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজী রেখে এ বিজয় ছিনিয়ে আনে, 16 ডিসেম্বর আমাদের গর্বিত এবং মহিমান্বিত বিজয় দিবস। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় সত্তার সর্বোচ্চ অর্জনের দিন-মহান বিজয় দিবস। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, অগণিত প্রাণের ত্যাগ, নির্যাতিত মানুষের আহাজারি, লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং অসীম বেদনার বিনিময়ে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র। এই বিজয় আমাদের সম্মান, মর্যাদা ও আত্মনির্ধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। বিজয়ের সুবর্ণ অধ্যায় আমাদের মনে করিয়ে দেয়-স্বাধীনতা কেবল একটি ভূখণ্ডের মুক্তি নয়; এটি মুক্ত চিন্তার, মুক্ত মানবতার এবং ন্যায়বোধ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস, সিলেট মুক্ত দিবস ও মহান বিজয় দিবস আমাদের জাতীয় চেতনার অবিচ্ছেদ্য সম্পদ। এই দিবসগুলো আমাদের সত্য, ন্যায়, দেশপ্রেম, মানবিকতা ও দায়িত্ববোধের পথে চলার অঙ্গীকার নবায়ন করে।

আজকের প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানানো, স্বাধীনতার চেতনা ধারণ করা এবং আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, গবেষণা, নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ হওয়া সময়ের দাবি। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের আদর্শ, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস, এবং বিজয়ের অনুপ্রেরণা আমাদেরকে আধুনিক, উন্নত, প্রযুক্তিনির্ভর ও সমতাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার পথে এগিয়ে রাখবে। শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস, সিলেট মুক্ত দিবস এবং মহান বিজয় দিবস আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য তিনটি গৌরবময় অধ্যায়। এই দিনগুলোতে আমরা গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি সেই সকল অমর শহিদদের, যাদের আত্মত্যাগ, প্রজ্ঞা, সাহস ও দেশপ্রেমের মহিমায় আলোকিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতার পথযাত্রা।

১৯৭১ সালের রক্তঝরা ডিসেম্বর আমাদের জাতিকে এনে দেয় চূড়ান্ত বিজয়ের আনন্দ, আর সিলেটের মুক্তি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যুক্ত করে অবিনশ্বর এক গৌরবগাথা অধ্যায়। একই সঙ্গে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের নির্মম হত্যাকাণ্ড আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়- জাতির মেধা, চেতনা ও সাংস্কৃতিক শক্তিকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা কখনোই স্বাধীনতার অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করতে পারেনি। তাদের আত্মদান আমাদের মুক্তির পথে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। আমাদের সকলের লক্ষ্য হওয়া উচিত স্বাধীনতার আদর্শকে সমুন্নত রাখা, অসাম্প্রদায়িক মানবিক বাংলাদেশ গঠন করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধকে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া।

স্বাধীনতার পর ফ্যাসিষ্ট গোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে মাথাচাড়া দিয়ে আমাদের গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেয়, জনগণের মৌলিক ও মানবিক অধিকার হরণ করে। কিন্তু প্রতিবারই এদেশের গণতন্ত্র প্রিয় মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার পুনরুদ্ধার করেছে। ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে বিজয় দিবস উদযাপন বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা ফিরে পেয়েছি বাক স্বাধীনতা। গত ১৭ বছরে কখনও নিজের মতামত, আবেগ, অনুভূতির কথা আমরা প্রকাশ করতে পারিনি। ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা প্রিয় মাতৃভূমিকে নতুনভাবে পেয়েছি। এজন্য জুলাই অভ্যুত্থানে শহিদদের আত্মার মাগফিরাত এবং আহতদের আশু সুস্থতা কামনা করছি। গত 12 ডিসেম্বরে এক অকুতভয় জুলাই যোদ্ধা ওসমান হাদীকে হত্যার উদ্দেশ্যে মাথায় বুলেটের আঘাতই প্রমাণ করে ঘাতকেরা আবারও আমাদের বাক স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার ছিনিয়ে নেয়ার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, কিন্তু স্বাধীনতার মূল্য রক্ষা করতে হলে দেশপ্রেম, সততা, ন্যায় পরায়ণতা এবং দায়িত্বশীলতা অপরিহার্য। দুর্নীতি, অবিচার, বৈষম্য ও অসদাচরণের বিরুদ্ধে আমাদের সকলকেই এক হয়ে দাঁড়াতে হবে । কেননা দেশ গড়া শুধু সরকারের একার কাজ নয় বরং এটি আমাদের সবার সম্মিলিত দায়িত্ব। তরুণদের হাতে দেশের ভবিষ্যৎ, বিজয়ের চেতনায় তাদের এগিয়ে আসতে হবে। তাদের স্বপ্ন, তাদের পরিশ্রমই একদিন বাংলাদেশকে আরও উন্নত, সমৃদ্ধ, মানবিক রাষ্ট্রে পরিণত করবে। তাই আজ আমাদের অঙ্গীকার হউক , দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জ্ঞান, সততা, ন্যায়-নীতি ও উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবো; বুদ্ধিজীবীদের মতাদর্শ, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব এবং বিজয়ের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে গড়ে তুলবো একটি সমৃদ্ধশালী, প্রযুক্তিনির্ভর, মানবিক ও প্রগতিশীল বাংলাদেশ। শহিদদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা আমাদের দায়িত্ব আরও বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে। এই দায়িত্ব পালনে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে দেশ ও জাতির কল্যাণে।

গৌরবের এই ডিসেম্বরই হোক আমাদের নতুন প্রেরণা, সম্ভাবনা ও অঙ্গীকারের দৃপ্তশপথ।