প্রফেসর আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ ও সমীরণ বিশ্বাস: বর্তমান বিশ্বে স্বাস্থ্য সচেতনতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং এর সঙ্গে সঙ্গে নিরাপদ খাদ্যের গুরুত্বও বহুগুণে বেড়েছে। খাদ্য শুধু পেট ভরানোর উপকরণ নয়, এটি আমাদের শরীরের গঠন, রোগ প্রতিরোধ এবং মানসিক সুস্থতার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। কিন্তু দূষিত, ভেজাল ও রাসায়নিকযুক্ত খাদ্য আমাদের সুস্থ জীবনযাত্রার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। তাই, নিরাপদ খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস গড়ে তোলা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা সুস্থ জীবনের জন্য অপরিহার্য।
নিরাপদ খাদ্য ও সুস্থ জীবন অন্বেষণ:
মানুষের জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে খাদ্য অন্যতম। কিন্তু শুধু খাদ্য গ্রহণই নয়, খাদ্যের গুণগত মান, নিরাপত্তা, এবং পুষ্টিগুণই নির্ধারণ করে আমাদের সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু। আজকের এই দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে, যেখানে প্রযুক্তি, ভোগবাদ, এবং বাজার অর্থনীতি খাদ্য ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করছে, সেখানে "নিরাপদ খাদ্য" শুধু একটি স্বাস্থ্যগত বিষয় নয়, এটি একটি সামাজিক, নৈতিক এবং মানবিক প্রশ্ন।
খাদ্য-জীবনের মৌলিক ছন্দ:
খাদ্য আমাদের জীবনের ছন্দে এক অনিবার্য সুর। গরম ভাতের গন্ধে জেগে ওঠে শৈশবের স্মৃতি, মাছ ভাজার শব্দে ফিরে আসে মায়ের রান্নাঘরের উষ্ণতা। প্রতিটি পদ যেন একেকটি গল্প,সংস্কৃতির, ভালোবাসার, এবং আত্মিক বন্ধনের। কিন্তু এই আবেগঘন সম্পর্কের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক নীরব উদ্বেগ: আমাদের প্রতিদিনের খাবার কি সত্যিই নিরাপদ? আজকের বাজারে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, ফরমালিন, এবং প্রিজারভেটিভের ছায়া দীর্ঘ। ফলের রঙে, মাছের টেক্সচারে, এমনকি শিশুখাদ্যেও মিশে আছে অজানা বিপদ। খাদ্য শুধু স্বাদ নয়, এটি স্বাস্থ্য, ভবিষ্যৎ, এবং জীবনের স্থায়িত্বের প্রশ্ন। অথচ আমরা অনেক সময়ই অজান্তে গ্রহণ করি সেই খাবার, যা শরীরের ক্ষতির কারণ হতে পারে। এই দ্বন্দ্ব, আত্মার আহার বনাম শরীরের নিরাপত্তা, আমাদের সচেতনতার দাবি করে। খাদ্য যেন শুধু স্মৃতির বাহক না হয়ে, হয় নিরাপত্তার প্রতীক। কারণ, সুস্থ জীবন শুরু হয় একটি নিরাপদ থালা থেকে। খাদ্য শুধু খাওয়া নয়, এটি বেঁচে থাকার শিল্প।
নিরাপদ খাদ্যের সংকট:
বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশে খাদ্য নিরাপত্তা একটি জটিল সমস্যা। রাসায়নিক সার, কীটনাশক, ফরমালিন, কার্বাইড, এবং বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহারের ফলে খাদ্য বিষাক্ত হয়ে উঠছে। বাজারে বিক্রি হওয়া ফল, শাকসবজি, মাছ, এমনকি শিশুদের খাবারেও বিষাক্ত উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। এই খাদ্য আমাদের শরীরে ধীরে ধীরে রোগের বীজ বপন করছে, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, কিডনি রোগ, হরমোনজনিত সমস্যা, সবই এর পরিণতি।
খাদ্য ও স্বাস্থ্য, অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক:
শরীরের প্রতিটি কোষ খাদ্য থেকে শক্তি ও পুষ্টি গ্রহণ করে। নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য মানেই সুস্থ শরীর, সক্রিয় মন, এবং দীর্ঘ জীবন। অপরদিকে, দূষিত খাদ্য মানেই রোগ, দুর্বলতা, এবং অকাল মৃত্যু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ খাদ্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে এই প্রভাব আরও মারাত্মক, তাদের বৃদ্ধি, বুদ্ধি, এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়।
ভোক্তার দায়িত্ব ও সচেতনতা:
নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে শুধু সরকার বা উৎপাদক নয়, ভোক্তার ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সচেতন হতে হবে, কোথা থেকে খাদ্য কিনছি, কীভাবে সংরক্ষণ করছি, এবং কীভাবে রান্না করছি। বাজারে গেলে চোখে দেখে, গন্ধ নিয়ে, এবং প্রয়োজনে পরীক্ষিত উৎস থেকে খাদ্য সংগ্রহ করা উচিত। প্যাকেটজাত খাদ্যের ক্ষেত্রে লেবেল পড়ে তার উপাদান, মেয়াদ, এবং উৎপাদন পদ্ধতি সম্পর্কে জানা জরুরি।
রাষ্ট্রের ভূমিকা:
সরকারের উচিত খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে "নিরাপদ খাদ্য আইন" এবং "বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ" গঠিত হয়েছে। কিন্তু আইন থাকলেই হয় না, প্রয়োজন কার্যকর মনিটরিং, জবাবদিহিতা, এবং জনসচেতনতা। খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে পরিবহন, সংরক্ষণ, এবং বিক্রয় পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
কৃষকের প্রতি দৃষ্টি:
খাদ্য উৎপাদনের মূল কারিগর কৃষক। কিন্তু তারা অনেক সময় বাজারের চাপে, লাভের আশায়, কিংবা অজ্ঞতার কারণে ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করেন। তাদের প্রশিক্ষণ, সচেতনতা, এবং প্রণোদনা দেওয়া জরুরি। জৈব কৃষি, নিরাপদ সার, এবং পরিবেশবান্ধব উৎপাদন পদ্ধতি প্রচলন করতে হবে। কৃষক যদি নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করেন, তাহলে পুরো জাতি উপকৃত হবে।
সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে খাদ্য:
বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে খাদ্য কখনোই শুধু আহারের উপকরণ ছিল না; এটি ছিল আত্মার আহ্বান, সম্পর্কের বন্ধন, এবং সমাজের প্রতিচ্ছবি। "ভাত দে হারামজাদা" রবীন্দ্রনাথের এই উচ্চারণে ক্ষুধা যেমন আছে, তেমনি আছে এক সামাজিক প্রতিবাদ। খাদ্য এখানে হয়ে উঠেছে শ্রেণি-বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক তীব্র ভাষ্য। আবার শরৎচন্দ্রের "মায়ের রান্না" আমাদের নিয়ে যায় এক আবেগঘন স্মৃতির জগতে, যেখানে প্রতিটি পদে মিশে থাকে ভালোবাসা, যত্ন, এবং মমতার ছোঁয়া। বাংলা লোককথা, গান, নাটক, সবখানেই খাদ্য এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক উপাদান। পল্লীগীতিতে পান্তা-ইলিশ যেমন উৎসবের প্রতীক, তেমনি গৃহবধূর হাতে রান্না করা খাবার হয়ে ওঠে সংসারের শান্তির প্রতীক। খাদ্য শুধু শরীর নয়, মন ও সমাজকেও পুষ্ট করে। এটি আমাদের ঐতিহ্য, স্মৃতি, এবং পরিচয়ের অংশ। কিন্তু আজকের বাস্তবতা ভিন্ন। ভেজাল, রাসায়নিক, এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্য আমাদের শুধু শারীরিকভাবে নয়, সাংস্কৃতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। যদি সেই "মায়ের রান্না"ই বিষে ভরা হয়, তাহলে সেই স্মৃতিও বিষাক্ত হয়ে ওঠে। সাহিত্য তখন আর আশ্রয় নয়, হয়ে ওঠে আতঙ্কের প্রতিচ্ছবি। খাদ্য যখন নিরাপদ নয়, তখন সংস্কৃতিও নিরাপদ থাকে না। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রাণ রক্ষায় নিরাপদ খাদ্য অপরিহার্য। এটি শুধু স্বাস্থ্য নয়, আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন। আমাদের সাহিত্য যেন আবার "ভাত"কে প্রতীক করে তুলে ধরতে পারে জীবনের, ভালোবাসার, এবং প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে, সেই আশাই করি। খাদ্যকে যদি আমরা আবার তার প্রকৃত মর্যাদায় ফিরিয়ে আনতে পারি, তাহলে সাহিত্যও ফিরে পাবে তার প্রাণ। কারণ, সাহিত্য তো জীবনেরই প্রতিচ্ছবি, আর জীবন শুরু হয় এক থালা ভাত দিয়ে। আমাদের সংস্কৃতির প্রাণ রক্ষার জন্যও নিরাপদ খাদ্য অপরিহার্য।
সুস্থ জীবনের পথ:
নিরাপদ খাদ্য গ্রহণের পাশাপাশি সুস্থ জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজন, নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম, মানসিক প্রশান্তি, বিশুদ্ধ পানি, সামাজিক সংযোগ। খাদ্য যদি নিরাপদ হয়, তাহলে শরীর সুস্থ থাকবে। শরীর সুস্থ থাকলে মনও প্রশান্ত থাকবে। আর মন প্রশান্ত থাকলে জীবন হবে আনন্দময়।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট:
বিশ্বজুড়ে নিরাপদ খাদ্য নিয়ে গবেষণা, আন্দোলন, এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন চলছে। ইউরোপ, আমেরিকা, জাপানসহ উন্নত দেশগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কঠোর আইন ও মানদণ্ড রয়েছে। আমাদেরও সেই পথে হাঁটতে হবে। প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, এবং নৈতিকতা, এই তিনের সমন্বয়ে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব।
নিরাপদ খাদ্য শুধু ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয় নয়, এটি একটি জাতির সামগ্রিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। সুস্থ জীবনযাত্রা গড়ে তুলতে হলে আমাদের খাদ্য নির্বাচন, সংরক্ষণ এবং প্রস্তুত প্রণালী সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। সরকার, উৎপাদক এবং ভোক্তা, তিন পক্ষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব। মনে রাখতে হবে, "সুস্থ শরীরেই সুস্থ মন" এবং সেই সুস্থতার মূল ভিত্তি হলো নিরাপদ খাদ্য। তাই, আজ থেকেই আমাদের খাদ্যাভ্যাসে সচেতনতা আনতে হবে, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ ও নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা যায়। নিরাপদ খাদ্য শুধু একটি স্বাস্থ্যগত দাবি নয়, এটি একটি মানবাধিকার। এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি অঙ্গীকার। সুস্থ জীবন চাইলে, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, এবং রাষ্ট্র, সবাইকে একসাথে এগিয়ে আসতে হবে। একটি কবিতার মতো করে বলা যায়, ”খাদ্য যদি হয় বিষময়, জীবন হবে ক্ষয়, নিরাপদ খাদ্যই হোক, সুস্থ জীবনের আশয়”।
লেখক: ১, অধ্যাপক, শেরোবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও রেজিস্ট্রার্ড ট্রেইনার -গ্লোবালগ্যাপ; ২, কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা।