সমীরণ বিশ্বাস: উৎপাদন ভালো । ভরপুর ফলনেও, কৃষকের হৃদয় ভেঙ্গে চুরে, চুরমার ! ফুলকপি ,বাঁধাকপি, মুলা, শিম এবং আলু সহ কয়েকটি সবজির দাম এযাবৎ কালের সর্বনিম্নে এসে পৌছিআছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংশ্লিষ্ট কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঠিক নির্দেশনার অভাব, পর্যাপ্ত প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবস্থা না থাকা, বিভিন্ন প্রকার সবজি সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত কোল্ডেস্টোরেজ না থাকা, স্থানীয় পর্যায়ে বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা না থাকা, রপ্তানি যোগ্য সবজি উৎপাদন পরিকল্পনায় উত্তম কৃষি চর্চা না থাকা, সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর গুলোর মনিটরিং সুপারভেশনের এর দুর্বলতা এবং মূল্য নির্ধারণের সুনির্দিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ এর সক্রিয় ভূমিকা না থাকায়, দাম নিয়ে কৃষকের এমন দুর্গতি, কপালের দুর্ভোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে । নিম্নমানের বীজ, ভেজাল সার, ডিলারদের সিন্ডিকেট, কৃষি ঋণের ভোগান্তি, প্রণোদনায় প্রভাবশালীদের দাপট, কীটনাশকের চড়ামূল্য এবং সেচের শৃঙ্খলে পড়ে, আগে থেকেই আর্থিক কষ্টে আছে প্রান্তিক ও বর্গা চাষিরা। তার উপর বর্তমানে যোগ হয়েছে, বাম্পার ফলনের কারণে সবজির দামে চরম নিম্ন গতি।
সবজির দামে চরম নিম্ন গতি ! উপরোক্ত বিষয়গুলোই কি এর প্রধান কারণ ? এখানে উৎপাদনকারী কৃষক এবং সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান এবং কর্মকর্তাদের কি কোনই দায় পড়ে না ? তাদের নিজেদের দায়বদ্ধতাও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নাই বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
কৃষকের সমস্যা, কৃষকদেরকেই সর্বাগ্রে চিহ্নিত করে পরিকল্পনামাফিক ফসল উৎপাদন করতে হবে। অঞ্চলভিত্তিক কৃষক ভাইয়েরা সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগের সহায়তায় ফসল উৎপাদন ক্রোপজোনিং এলাকা নির্ধারণ করতে কবে । অর্থাৎ কোন এলাকায়, কোন কোন ফসল হয়, সেই অনুযায়ী কৃষক দল তৈরি করে পরিকল্পনা মাফিক, ফসল উৎপাদন করতে হবে। একটি এলাকায়, একই জাতীয় ফসল উৎপাদনের সময় ক্রোপ-ক্যালেন্ডার লক্ষ্য রাখে আগাম, মধ্যম এবং নাভি জাত চাষ পরিকল্পনায় রাখতে হবে। একটি কমিউনিটির সকল চাষী একসাথে একই ফসল চাষ করা যাবে না। সাথে সাথে চাহিদা এবং সাপ্লাই চেইন বিবেচনায় রেখে ফসলের উৎপাদন টার্গেট নির্ধারণ করতে হবে। অর্থাৎ অপরিকল্পিত বা চাহিদার সাথে মিল না রেখে উৎপাদন করা ঝুঁকিপূর্ণ হবে। এসকল ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কৃষকদের সাথে কৃষিসম্প্রসারণ এবং কৃষি বিপণন অধিদপ্তরকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
ক্রোপজোনিং এবং ক্রোপ-ক্যালেন্ডার পরিকল্পনা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট এলাকার কৃষক দলকে (ফসলভিত্তিক) চাহিদা এবং সাপ্লাই চেইন এর কথা মাথায় রেখে ফসল উৎপাদনের কার্যকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এখানে একটি কথা খুবই গুরুত্বের সাথে মনে রাখতে হবে, আমাদের কৃষক ভাইয়েরা যেন কোনোভাবেই একই সময়, একই সাথে ,সকলে মিলে, একই জাতের সবজি ফসল চাষ না করি। নিজেদের পরিকল্পনার ভুলে, নিজেরা যেন, কোন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হই; সেই বিবেচনাটা কৃষক ভাইদেরকে মনে রাখতে হবে। যে কোন ফসলের উৎপাদন সময় এবং তার সংগ্রহের সময় কখন ? সেই সময় জ্ঞানটুকু মাথায় রেখে ফসল উৎপাদন পরিকল্পনা করতে হবে। আমরা যেন সবাই মনে রাখি, আমার ফসলটি যখন উত্তোলন হবে, তখন তার চাহিদা কি রকম থাকবে? সাপ্লাইচেইন কেমন হবে বা কেমন থাকবে ? তা কৃষক ভাইদের ভাবনায় রাখতে হবে। উৎপাদিত সবজির সঠিক মূল্য পেতে হলে; এ সকল বিষয়গুলি অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। আগামীতে কৃষক ভাইয়েরা সতর্ক থাকবো, উৎপাদিত পণ্য নিয়ে আমরা নিজেরাই যেন নিজেদের প্রতিযোগী হয়ে সবজির দামে চরম হতাশার পরিস্থিতি তৈরি না করি । সবাই যদি সবার স্বার্থ দেখে, তাহলে আমি কৃষক হিসাবে আমার স্বার্থ আমাদেরকেই দেখতে হবে, এবং রক্ষা করতে হবে। তাহা হলেই কৃষকরা তার সবজি পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাবেন।
যে কৃষক যোগায় ক্ষুদায় অন্ন, সে কৃষক আজ চরমভাবে বিপন্ন ! সারাদেশের সকল কৃষকদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ এবং এক হতে হবে। কৃষকদের আজ আওয়াজ তোলার সময় এসেছে; উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশিত করা। বীজ সার কীটনাশক সিন্ডিকেটের মুক্ত করা। প্রতিটি উপজেলাতে কল্ডেস্টোরেজ ব্যবস্থা করা। কৃষকের উৎপাদন খরচ কমাতে বিনামূল্যে উত্তম কৃষি চর্চা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা চালু করা। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের কৃষি ঋণ ও সুদ মওকুফের ব্যবস্থা করা। বয়স্ক পঙ্গু অসহায় কৃষকদের কৃষক ভাতা এবং পেনশন চালু করা। উপজেলা পর্যায়ে কৃষক বাজার তৈরি করে সরাসরি ভোক্তার কাছে মালামাল বিক্রির ব্যবস্থা করা। কৃষি পণ্য চলাচলে রেল বগি বরাদ্দ ও টোল প্রথা বিলুপ্ত করা। কৃষকের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ফসল ভিত্তিক লোন ব্যবস্থা চালু করা। জলবায়ু পরিবর্তন তথা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে কৃষকদের জন্য কৃষি বীমা চালু করা। আজ সময় এসেছে, কৃষকের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় কৃষকদেরকেই ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ তুলতে হবে।
কৃষকরা সবজির ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলো:
মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব: কৃষকরা সরাসরি ভোক্তাদের কাছে সবজি বিক্রি করতে পারেন না। মাঝখানে মধ্যস্বত্বভোগী (ফড়িয়া, আড়তদার) সবজির দাম কমিয়ে নেন এবং ভোক্তাদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করেন।
প্রযুক্তি ও সংরক্ষণ সুবিধার অভাব: সবজি সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় হিমাগার বা কোল্ড স্টোরেজের অভাব থাকায় কৃষকরা উৎপাদনের পরপরই পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হন। ফলে তারা ন্যায্য মূল্য পান না।
বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা: অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় বাজার ব্যবস্থাপনা দুর্বল থাকে এবং কৃষকরা সঠিক মূল্য নির্ধারণের সুযোগ পান না।
বাজার তথ্যের অভাব: কৃষকদের কাছে বাজারের চাহিদা ও দাম সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য থাকে না। ফলে তারা সঠিক সময় ও সঠিক স্থানে পণ্য বিক্রি করতে ব্যর্থ হন।
উৎপাদন বেশি, চাহিদা কম: কোনো মৌসুমে কোনো বিশেষ সবজির উৎপাদন বেশি হলে তার চাহিদা তুলনামূলক কমে যায়, যার ফলে দাম কমে যায়।
পরিবহন সমস্যার কারণে ক্ষতি: সময়মতো সবজি পরিবহন করা না গেলে তা নষ্ট হয়ে যায় বা মান কমে যায়। এতে বাজারে কম দামে বিক্রি করতে হয়।
খাদ্য অভ্যাস : আমাদের দেশের প্রায় শতভাগ মানুষ প্রধান খাদ্য হিসেবে ভাতকেই পছন্দ করে। যে কোনো সবজির চহিদা বৃদ্ধির কল্পে, ভাতের পাশাপাশি বেশি বেশি সবজি খাওয়ার অভ্যাসে পরিবর্তন আনা জরুরি।
উত্তম কৃষি চর্চা (good agriculture practices) : কৃষকদের তার কৃষি পণ্য উৎপাদনের সময়, সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা এবং উত্তম কৃষি চর্চার মাধ্যমে ফসল তথা নিরাপদ সবজি উৎপাদন করলে ন্যায্য মূল্য পাবার সম্ভাবনা বাড়ে
সরকারি নীতির অসঙ্গতি: অনেক সময় কৃষকদের সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত নীতিমালা কার্যকর হয় না বা বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারি পর্যবেক্ষণ দুর্বল থাকে। ভোক্তা পর্যন্ত সরাসরি পৌঁছানোর সুযোগ নেই: কৃষকদের সরাসরি ভোক্তার কাছে বিক্রি করার ব্যবস্থা (যেমন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বা কৃষি মেলা) খুব সীমিত, যার ফলে তাদের লাভ কম হয়। এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন, প্রযুক্তি ব্যবহার, এবং সরকারি সহযোগিতা বৃদ্ধি করা জরুরি।
লেখক: সমীরণ বিশ্বাস, কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।