কৃষিবিদ ড. এম আব্দুল মোমিন:গল্পটা এমন, ষাটের দশকে এদেশে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে পাঁচ কোটির কাছাকাছি কিন্তু অভাব ছিল সীমাহীন। অনেকটা নূন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। মুরুব্বিদের কাছে শুনেছি তখন সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষেরা ক্ষুধা নিবারণের জন্য এক পেয়ালা ভাতের মাড়ের জন্য বিত্তবানদের কাছে ধরনা দিতো। এমন এক পরিস্থিতিতে তৎকালীন রাজকীয় কৃষি কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭০সালের ১অক্টোবর পূর্ব-পাকিস্তান ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ১৯৭১সালে বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলন যখন শুরু হলো তখন মানুষের অন্ন বস্ত্রের অধিকার প্রতিষ্ঠাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। তাই স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেকগুলো শ্লোগানের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ছিল শ্লোগান ছিল- বাংলার প্রতি ঘর, ভরে দিতে চাই মোরা অন্নে। এই শ্লোগান তখন কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত করেছিল।
বহুকাঙ্খিত স্বাধীনতা অর্জনের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শুরু হয় আরেক নতুন সংগ্রাম। সেটি খেয়ে পরে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা বলতে মূলতঃ ধান বা চালের নিরাপত্তাকেই বোঝায়। কেননা, আমরা ভেতো বাঙালি! ধানের নিরাপত্তাই এদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির উপায়। আবহমানকাল থেকে ধানকে এদেশের জাতীয় সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ক্রিশ্চিয়ান সাইন্স মনিটর পত্রিকায় ২০১৫ সালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছে, অতীতের তীব্র খাদ্য ঘাটতির বাংলাদেশ বর্তমানে উদীয়মান অর্থনীতির নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে, যা সম্ভব হয়েছে কেবল চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূণর্তা অর্জন বা খাদ্যশস্য উৎপাদনের লক্ষ্য পূরণের মাধ্যমে। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে ব্রি পরিদর্শনে এসে বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডবিøও মজিনা খাদ্য নিরাপত্তায় এর অবদানের উচ্ছ¡সিত প্রশংসা করে বলেছিলেন, অতীতের তলাবিহীন ঝুড়ি কীভাবে উদীয়মান অর্থনীতির নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হলো, সে প্রশ্নের উত্তর তিনি পেয়েছেন ব্রি’তে এসে।
মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার প্রথমটিই খাদ্য, আর বাংলদেশের ৯০ভাগ লোকের প্রধান খাবার ভাত। কোন দেশের শিল্প, সাহিত্য, অর্থনীতি কিংবা রাজনীতি সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় এই খাদ্য নিরাপত্তা দিয়ে। দেশের জনসংখ্যা যখন ১৭কোটি, তখন এত মানুষের খাবারের যোগান দেয়া সহজ কথা নয়। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এই বিশাল চ্যালেঞ্জই গত ৫৫বছর ধরে মোকাবেলা করে যাচ্ছে দেশের ধান বিজ্ঞানীরা। সত্তরের দশকের প্রথম দিকে সদ্য স্বাধীন দেশে প্রবর্তন করা হলো উফশী জাত আইআর৮। ব্রির বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করলেন তিন মওসুমে চাষ উপযোগী উচ্চ ফলনশীল ধানের আধুনিক জাত বিআর৩ যা বিপ্লব ধান নামে ব্যাপক পরিচিতি পায় এবং সত্যিকার অর্থেই এই জাতটি দেশের ধান উৎপাদনে বিপ্লবের সূচনা করে। আইআর৮ ও বিপ্লব এই দুটি উফশী জাত প্রবর্তন ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে মূলতঃ আধুনিক ধান চাষের গোড়াপত্তন হয়। শুরু হয় খাদ্য উৎপাদনে নতুন এক অধ্যায়।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত সাড়ে পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে ব্রি এদেশের ক্রমর্বধমান জনসংখ্যার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে অসামান্য অবদান রেখে চলেছে। গত ৫৫ বছরে ১১৩ ইনব্রিড ও ৮টি হাইব্রিড মিলিয়ে মোট ১২১টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে ব্রি। বাংলাদেশের ভৌগলিক বৈচিত্র্য যেমন-উত্তরে খরা, দক্ষিণে লবণাক্ততা, মধ্যাঞ্চলে বন্যা ও জলমগ্নতাসহ প্রতিক‚ল পরিবেশ মোকাবিলায় ব্রি উদ্ভাবন করেছে লবণাক্ত সহনশীল, খরা সহনশীল, জলমগ্নতা সহনশীল, ঠান্ডা সহনশীল, জোয়ার-ভাটা সহনশীলসহ নানা ধরনের ৩৭টি জাত। শুধু প্রতিক‚ল পরিবেশ সহনশীলতাই নয়, ২৭টি পুষ্টিসমৃদ্ধ ও ১৪টি সরু ও সুগন্ধি চালের ধানও উদ্ভাবন করেছে ব্রি। যেগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানিযোগ্য। বিশ্বের প্রথম জিঙ্কসমৃদ্ধ ধান ব্রি ধান৬২সহ ৭টি জিঙ্কসমৃদ্ধ জাত উদ্ভাবন করে বাংলাদেশকে বিশ্বে গৌরবময় অবস্থানে নিয়ে যায়। বর্তমানে জিঙ্ক, আয়রন, প্রোটিন সমৃদ্ধ জাত কৃষকের হাতে পৌঁছেছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে ব্রি’র গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল অল্প জমি থেকে বেশী পরিমাণ ধান উৎপাদন করা। বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটানোই ছিল তখনকার মুল লক্ষ্য। বর্তমানে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে সেই সঙ্গে মানুষের চাহিদা ও রুচির পরিবর্তন এসেছে। তাই উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি সরু-সুগন্ধি এবং রপ্তানীর উপযোগি প্রিমিয়াম কোয়ালিটির বেশ কয়েকটি জাত উদ্ভাবন করেছে ব্রি। ধান গবেষণায় যুগান্তকারী সাফল্যের কারণে অনেকে ব্রিকে একটি অন্নদাতা প্রতিষ্ঠান হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন। ভিটামিন এ সমৃদ্ধ ধান, আয়রন ও প্রোটিন সমৃদ্ধ ধান, ডায়বেটিক ধান, রক্ত শূণ্যতা ও ডায়রিয়া রোগীদের জন্য বিশেষ উপকারী প্রায় ২০-২৭ পিপিএম জিংক সমৃদ্ধ ব্রি ধান৬২, ৬৪, ৭২, ৭৪, ৮৪, ১০০ ও ১০২ অবমুক্ত করার ফলে এখন পুষ্টিদাতা প্রতিষ্ঠান হিসাবেও স্বীকৃতি লাভ করছে ব্রি।
ধান গবেষণার পাশাপাশি কৃষি যান্ত্রিকীকরণেও ব্রি রেখেছে যুগান্তকারী অবদান। ব্রি’র ফার্ম মেশিনারি অ্যান্ড পোস্ট-হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত ৫০টিরও বেশি কৃষি যন্ত্র উদ্ভাবন করেছে। এসব কৃষিযন্ত্র কৃষকের শ্রম সাশ্রয় করছে, উৎপাদন খরচ কমাচ্ছে এবং সময়মতো চাষাবাদ নিশ্চিত করছে। জাত উদ্ভাবন ও যান্ত্রিকীকরণ ছাড়াও মাটি, পানি, সার ও বালাই ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত ৩০০ এর অধিক ধান উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে ব্রি।
প্রতিষ্ঠালগ্নে ব্রির কার্যক্রম ছিল সীমিত পরিসরে। কয়েকটি গবেষণা বিভাগ এবং হাতে গোনা কিছু বিজ্ঞানী নিয়ে কাজ শুরু হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্রি প্রসারিত হয়েছে। এখন সদর দপ্তরে রয়েছে ১৯টি গবেষণা বিভাগ, ২০টিরও বেশি আধুনিক গবেষণাগার, উন্নতমানের জার্মপ্লাজম সেন্টার বা জিন ব্যাংক, গ্রিন হাউজ, নেট হাউজ ও ৭৬ একরেরও বেশি পরীক্ষণ মাঠ। সারা দেশে ১৭টি আঞ্চলিক কার্যালয় এবং ৬টি স্যাটেলাইট স্টেশনের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে এখানে ৩১৮জন বিজ্ঞানীসহ ৮০০ জনেরও বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছেন, যাদের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ উচ্চতর ডিগ্রিধারী।
বিগত চার দশকে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেলেও খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে চারগুণেরও বেশি। ১৯৭০-১৯৭১ সালে এদেশে জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি আর চালের উৎপাদন ছিল মাত্র ১কোটি টন। ৫৫ বছরের ব্যবধানে আজ ২০২৫ সালে এসে দেশে যখন জনসংখ্যা প্রায় ১৭কোটি। আগে যে জমিতে আগে হেক্টরপ্রতি ২-৩ টন ফলন হতো এখন উফশী জাতের ব্যবহারের কারণে ফলন হচ্ছে ৬-৮টন। বর্তমানে চাল উৎপাদন হচ্ছে ৪ কোটি ১৯ (২০২৪-২৫ অর্থবছর) লক্ষ টনের বেশি। এই উৎপাদন বৃদ্ধির পেছনে ব্রি উদ্ভাবিত জাতের অবদান প্রায় ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ। বর্তমানে দেশের মোট ধান জমির প্রায় ৭৭ শতাংশে ব্রি উদ্ভাবিত জাত চাষ করা হয়। বোরো মৌসুমের ধানের ৮২ শতাংশ, আউশ মৌসুমের ৩৬ শতাংশ এবং আমন মৌসুমের ৪৭ শতাংশ জমিতে ব্রি জাতের ধান চাষ হচ্ছে। একসময় নিয়মিত চাল আমদানি করত বাংলাদেশ। কিন্তু ব্রির আধুনিক জাত ও প্রযুক্তির কারণে ১৯৯০ সালের দিকে দেশ খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্প‚র্ণতার কাছাকাছি পৌঁছায়। বর্তমানে বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়।
অর্থনীতিতেও ব্রির অবদান অপরিসীম। একটি স্বতন্ত্র জরিপে দেখা যায়, ধান গবেষণা ও স¤প্রসারণে ১টাকা বিনিয়োগ থেকে ৫৬ টাকা সমপরিমাণ মুনাফা হচ্ছে। আধুনিক জাত ও প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে ধান উৎপাদন বেড়েছে, খাদ্য আমদানি কমেছে, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হয়েছে। শুধু তাই নয়, কৃষি ও অকৃষি উভয় খাতেই কর্মসংস্থানের প্রসার ঘটেছে। আধুনিক সেচ, যান্ত্রিকীকরণ ও প্রযুক্তি নির্ভর কৃষি গ্রামীণ অর্থনীতিকে করেছে গতিশীল। সার ব্যবসা, সেচযন্ত্র, পাম্প, যন্ত্র মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের মতো খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় ব্রি প্রণয়ন করেছে ‘রাইস ভিশন ২০৫০’ এবং ‘ডাবলিং রাইস প্রডাক্টিভিটি’ নামে দুটি কৌশলপত্র। এতে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে ধানের উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করা, ২০৪১ সালের মধ্যে টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা প‚রণ। গবেষণার অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে অতি উচ্চ ফলনশীল জাত (১২-১৪ টন/হেক্টর), হাইব্রিড ও ট্রান্সজেনিক ধান, প্রতিক‚ল পরিবেশ সহিষ্ণু জাত, অধিক ভিটামিন ও আয়রন সমৃদ্ধ ধান এবং রপ্তানিযোগ্য সুগন্ধি জাত উদ্ভাবনে। একইসঙ্গে কৃষি যন্ত্রপাতির উন্নয়ন ও ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষিকে স্মার্ট ও আধুনিক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, উৎপাদন গতিশীলতার এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে চালের উৎপাদন হবে ৪ কোটি ৭২ লাখ টন। বিপরীতে ২০৫০ সালে ২১ কোটি ৫৪ লাখ লোকের খাদ্য চাহিদা পূরণে চাল প্রয়োজন হবে ৪ কোটি ৪৬ লাখ টন। অর্থাৎ চালের বর্তমান উৎপাদন প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে দেশে ২৬ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। এই অভীষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কাজ করছে ব্রির বিজ্ঞানীরা।
ধান গবেষণায় ব্রি’র সাফল্য ছড়িয়ে দেশের সীমা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডলেও। ব্রি’র উদ্ভাবিত ধানের জাত দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশেও আবাদ হচ্ছে। বেশ কিছু দেশে যেমন- ভারত, নেপাল, ভুটান, ভিয়েতনাম, মায়ানমার, চীন, কেনিয়া, ইরাক, ঘানা, গাম্বিয়া, বুরুন্ডি ও সিয়েরালিয়েনসহ অনেক দেশে ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত ব্যবহার করছে। পৃথিবীর ১৪টি দেশে বর্তমানে ১৯জাতের ব্রি ধানের আবাদ হচ্ছে। বিজ্ঞান ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ব্রি তিনবার স্বাধীনতা দিবস স্বর্ণপদক ও তিনবার রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক, দুইবার জাতীয় কৃষি পদকসহ জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে ৩০টি পুরস্কার লাভ করেছে।
খাদ্যে স্বনির্ভরতার সংগ্রাম থেকে শুরু করে কৃষিকে আধুনিক ও যান্ত্রিকী কৃষিতে রূপান্তরের প্রতিটি পদক্ষেপে ব্রি’র অবদান স্পষ্ট। বলা যায়, ব্রি কেবল একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান নয় বরং এটি খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষকের উন্নয়ন এবং জাতীয় সমৃদ্ধির প্রতীক। দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় ব্রির সাফল্যের এই ধারা অব্যাহত থাকুক। ৫৬তম প্রতিষ্ঠা দিবসে এই শুভকামনা সংশ্লিষ্ট সকলের।
লেখক: উর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, ব্রি, গাজীপুর।